‘শিবির’ সন্দেহে বুয়েটের আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছিল ছাত্রলীগের কিছু ছেলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ‘শিবির’ সন্দেহে হামলা করে আহত করেছে একদল শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীকে। যেন শিবির মারা জায়েজ! কী ভয়ানক, তারা প্রতিবাদীর নাম দিয়েছে ‘শিবির’! যেখানে যে-ই সত্য বলবে, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলবে—সে-ই শিবির? এটাই কি তাঁরা বোঝাতে চান? শিবির কি এত বড় সম্মানের যোগ্য? পুরান ঢাকার দরজি যুবক বিশ্বজিৎকেও শিবির বলে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। এভাবে নিপীড়িতদের ‘শিবির’ বলে মিথ্যা জিগির তোলায় লাভ হচ্ছে কার? শিবিরের ধুয়া তুলে ক্যাম্পাসকে খোঁয়াড় আর হলগুলোতে নির্যাতনকেন্দ্র বানাতে বানাতে ছাত্রলীগই যে শিবিরের মতোই ভীতিকর হয়ে উঠেছে; এই সত্য এখন দেয়ালে দেয়ালে আঁকা। জাহাঙ্গীরনগরের বেলায় সেসব দেয়ালচিত্রে মধ্যমণি হয়ে উঠেছেন একজন উপাচার্য। তাঁর নাম ফারজানা ইসলাম।
সন্ত্রাসের পেছনে উন্নয়ন আর উন্নয়নের যমজ হলো সন্ত্রাস। এটাই তো ঘটছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায়। আড়াই শ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ কে পেল, কীভাবে পেল সেসব জানতে বাকি। কিন্তু এর থেকে দুই কোটি টাকা স্বয়ং উপাচার্যের হাত দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের মধ্যে বাঁটোয়ারার সব আলামত হাজির। অথচ তদন্ত হলো না বিচার হলো না। টাকা কেবল ক্ষমতার কথাই বলে না, নোংরামিও প্রকাশ করে দেয়। ছাত্রলীগ মারফতই জানা গেল কে কত টাকা পেয়েছেন এবং কোন হাত দিয়ে সেই টাকাগুলো বিতরিত হয়েছে। এরপরও সেই হাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়, তার হাজারো ছাত্রছাত্রীর ভূত-ভবিষ্যতের ভার ছেড়ে রাখা যায়?
জাহাঙ্গীরনগরকে আদর করে তার সন্তানেরা বলে জানবিবি। বলে দ্বিতীয় জন্মের আঁতুড়ঘর। নব্বই ভাগ ছেলেমেয়ে বাবা-মায়ের কাছ থেকে প্রথম আলাদা হয়ে যেখানে পড়তে আসে, তার নাম বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগরের বেলায় এ কথা আরও বেশি সত্য। অভিভাবকেরা ভাবতে ভালোবাসেন, বাবা-মায়ের সেই জায়গাটা নেবেন উপাচার্য মহাশয়/মহাশয়া। শিক্ষকেরা পালন করবেন পিতা–মাতার ভূমিকা। এমনটা ভাবার দরকার হয় না পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। সেখানে নেতা বা শিক্ষককে পিতা-মাতার চেয়ে বরং বন্ধু বা সহনাগরিক ভাবা হয়। সবার অধিকার যেখানে সুরক্ষিত সেখানে আবেগীয় ডাক ডেকে প্রাপ্য পাওনা পেতে হয় না। আমাদের দেশে হয়। যদি তা-ই হয় তবে ফারজানা ইসলামের মতো স্বৈরাচারীকে দেখে কোনো শিক্ষার্থী কিংবা কোনো অভিভাবক ভরসা পাবেন? যিনি নাকি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী হামলাকে বলেন ‘গণ–অভ্যুত্থান’; আর এটা নাকি তাঁর আনন্দের দিন!
যেখানে গবেষণায় টাকা পাওয়া যায় না, গ্রন্থাগার ও গবেষণাগার উন্নত হয় না, জেলখানা আর হলগুলোর ডাইনিংয়ের খাবারের মান যেখানে সমরূপ, সেখানে শত-হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন চলে কিসের স্বার্থে? সেই টাকার ভাগ-বাঁটোয়ারা ফাঁস হয়েছে বলে শোরগোল হচ্ছে। ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রই জানেন, যতটা ফাঁস হয় তা আদতে হিমশৈলের চূড়ামাত্র—তলায় আরও অনেক কিছু আছে; আছে আরও আরও উপাচার্য ও তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের নাম। এই দুর্বৃত্তচক্রের শিরোমণি হিসেবেই কি তাঁর সন্ত্রাসী কায়দায় ভিসি পদে থেকে যেতে হবে? আড়াই শ কোটি টাকার মায়ায় নিষ্ঠুরতা চালাতে হবে?
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে আর যা-ই হোক টাকার লেনদেন হতো বলে শোনা যায় না। চক্ষুলজ্জার খাতিরে সরাসরি ক্যাডারদেরও শিক্ষক বানানো চলত না। এখন সবই চলে বলে অভিযোগ। অজস্র গাছ কেটে, মাস্টারপ্ল্যান নষ্ট করে ভবন বানাবার নেশা কি সুস্থতা? অভিযোগের পাহাড় জমে কিন্তু তদন্ত বা বিচার কিছুই যখন হয় না, তখন মনের মধ্যে জমে ক্ষোভের বারুদ। সেটা কোনো না কোনো সময় বিস্ফোরিত হবেই। কতটা ক্ষোভ জমলে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের পর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ এবং হলগুলোকে ভ্যাকান্ট ঘোষণার পরও কেউ তা মানল না! মধ্যরাতে মেয়েদের হলের তালা ভেঙে মিছিল বেরিয়ে পড়ে! কত অসহায় হলে নিরস্ত্র ছাত্রছাত্রীরা বিপুল ক্ষমতাশালী ছাত্রলীগ আর উচ্চমহল থেকে ক্ষমতায়িত প্রশাসনের বিরুদ্ধে কেবল মনের জোরে দাঁড়াতে পারে? যাঁরা দেশ নিয়ে হতাশ তাঁরা এমন শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে আশাটা বাঁচিয়ে রাখতে পারেন।
জাবির বর্তমান উপাচার্য ফারজানা ইসলামকে উপাচার্য করা হলে অনেকেই দিলখোলা অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। দেশের প্রথম নারী উপাচার্য তিনি এবং একজন নৃবিজ্ঞানীও বটে। এই অভিনন্দনের সারির সামনেই ছিলেন গত মঙ্গলবার ছাত্রলীগের হাতে নির্যাতিত শিক্ষক অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস। নির্যাতিত হয়েছেন রায়হান রাইনের মতো প্রথম শ্রেণির শিক্ষক, গ্রন্থকার এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত সাহিত্যিক। উপাচার্য চান ক্যাম্পাসে এমন নিষ্ঠাবান গবেষক শিক্ষকেরা না থাকুন, থাকবে শুধু সন্ত্রাসের ঠিকাদার ছাত্রলীগ, মাফিয়া শিক্ষক, নিয়োগ–বাণিজ্যের ঠিকাদার প্রশাসন!
স্বাধীন বাংলাদেশের জীবনী আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনী একাকার। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয় ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের’। তারপর যুদ্ধ, তারপর রোদনভরা ইতিহাস। অবশেষে রক্তগঙ্গা সাঁতরে যে বাংলাদেশ ইতিহাসের কূলে উঠে দাঁড়াল, রক্তের দামে সেই দেশের মানুষ শিখল—সবার রক্তই সমান লাল। জাত পরিচয়ের সাম্প্রদায়িক দাগও সেই রক্তেই ধোয়া হলো। তাই ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে যে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস হলো, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন নাম হলো ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়’।
পাকিস্তান আমলের অন্তিম মুহূর্তে যার জন্ম, যার উদয়কাল হেলে আছে স্বাধীনতার দিকে, তাকে কি স্বাধীনতার সন্তান না বলে পারা যায়? যার জন্ম রাষ্ট্রের সুবহে সাদিকে, সে তো দিনেরই সন্তান। তাই বুঝি জাহাঙ্গীরনগরে এখনো দিন আসে অঢেল আলো উপচানো আবহে। রাতের পূর্ণিমা আর দিনের সূর্য সেই ক্যাম্পাসে আজও অমলিন।
আজও সেই আরিচা রোড আছে। আজও সেই মহাসড়কে বাস থেকে নামলে রক্তে ছোট্ট একটা স্পন্দন জাগে। শৈশব থেকে কৈশোর হয়ে যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ সময় যার শিক্ষার মধ্যে কাটে, শিক্ষায়তন তার দ্বিতীয় মাতৃভূমি। শিশু একবার জন্মে মাতৃগর্ভে, দ্বিতীয়বার জন্মে বিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের তাই দ্বিজ বলা হয়। জাহাঙ্গীরনগর আমাদের অনেকের দ্বিতীয় জন্মের আঁতুড়ঘর।
হাজারো ছাত্রছাত্রীর এই আঁতুড়ঘরটিকে দুরাচার উপাচার্য এবং তাঁর অপকর্মের সঙ্গীসাথিদের কলঙ্কমুক্ত করা হোক। তিনি যা করে যাচ্ছেন এবং গণমাধ্যমে যা যা বলেন, তাতে তাঁকে আর উপাচার্য রাখা চলে না। আড়াই শ কোটি টাকার উন্নয়নের ভাগ পাওয়ার স্বার্থে হেন অন্যায় নাই যে তিনি করতে বিরত হচ্ছেন। সন্ত্রাসী ও দুর্নীতিবাজরা ছাড়া যাঁর পেছনে কেউ নেই, তাঁকে আর যাহোক উপাচার্য কিংবা শিক্ষক বলা যায় না।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com