মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
ভিকারুন নিসা নূন- কে এই মহীয়সী মহিলা? আজ অনেকেই আমরা তার সম্পর্কে অনেক কিছুই জানিনা। তিনি ছিলেন একজন সফল সমাজ কর্মী, যোগ্য রাজনৈতিক এবং দক্ষ সংগঠক। মানবতাবাদী, সমাজসেবী, নারী শিক্ষা উন্নয়ন সহ সামগ্রিক ভাবে নারী উন্নয়ন কামি। সমাজের অবহেলিত মানুষের কাছে ভরসার স্থল। জন্মগত ভাবে তিনি ছিলেন একজন অস্ট্রিয়ান। ১৯২০ সালের জুলাই মাসে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। জন্ম কালীন সময় তাঁর নাম ছিল ভিক্টোরিয়া। বিয়ের পরে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং ভিক্টোরিয়া নাম পরিবর্তন করে ভিকার-উন-নিসা নাম রাখেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন দারুন মেধাবী। কল্যানকামী, মানবতাবাদী ব্যতিক্রমী এক ব্যক্তিত্ব। ছিলেন মিশুক বন্ধুত্ব প্রিয়। উদার এবং পর উপকারী।
১৯৪৭’ এ দেশ ভাগের পর যখন উদ্বাস্তু সমস্যাটি সত্যিকার সংকট হিসাবে দেখা দেয়। তখন তিনি রেড ক্রিসেন্টের সংগে অত্যান্ত ঘনিষ্ট ভাবে যুক্ত থেকে উদ্বাস্তু ক্যাম্প সংগঠন ও উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দেন। এটি ছিল ওই সময়কার হাজার, লক্ষ মানুষের জীবন মরন সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে এবং স্থানীয় সমাজ উন্নয়নে তিনি নিজেকে গভীর ভাবে যুক্ত করেন। এ সময় রিফিউজি, শরণার্থী শিবিরে তিনি ছিলেন স্বর্গীয় দূত, ত্রাণকর্তা। তাদের অর্থাৎ রিফ্যুজিদের- খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থানের পাশে কর্ম সংস্থানের জন্য দিবা রাত প্ররিশ্রম করেছেন।
উদ্ভুত সমস্যা ণ্ডলি সর্ব স্তরে মানবিক দৃষ্টি কোন থেকে বিবেচনা করবার তাগিদ তৈরী করেছিলেন। এটি ছিল তার চিন্তা ধারার মানবিক দিক ও মহানুভবতা। তার যোগ্য ও বলিষ্ট নেতৃত্বে তার অধীনস্ত ব্যাপক ত্রাণ কার্যক্রম পেয়েছিলো গতিশীলতা সেবা মুখী কর্ম উদ্যম। অনিয়ম ও দুর্নীতির ছোয়া মুক্ত। মানুষ মানুষের জন্য – ভাবাদর্শে অনুপ্রাণিত।
বাংলাদেশে মূলত তার পরিচিতি এসেছে ঢাকায় অবস্থিত দেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষা প্রিতিষ্ঠান “ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ” টির জন্য। স্বনাম খ্যাত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ণ্ডলির মাঝে অন্যতম প্রধান। এদেশের মেয়েদের শিক্ষা উন্নয়নে অনেক দূরদর্শী চিন্তা থেকেই তিনি এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫২ সালের ১৪ ই জানুয়ারি শুধুমাত্র মেয়েদের জন্য এই স্কুলটি তার কার্যক্রম শুরু করে। ঢাকায় মূলত তাঁর উদ্যোগেই স্থাপিত হয় ভিকারুননিসা নূন স্কুল। প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পরই ভিকারুননিসা সিনিয়র কেমব্রিজ স্কুল হিসেবে পরিবর্তিত হয়, যা থেকে উচ্চশিক্ষা লাভে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের যুক্তরাজ্যের অঙ্ফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য বৃত্তিসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হতো। তার নামানুসারেই স্কুলটির নামকরণ করা হয়েছে।
স্কুলটির কার্যক্রম প্রধান অফিস বা প্রধান শাখা বেইলি রোডকে কেন্দ্র করে হয়ে থাকে।
এবং একই প্রশাসনের অধীনে স্বতন্ত্র আরও তিনটি শাখা গড়ে তোলা হয়েছে যেণ্ডলো ধানমন্ডি, আজিমপুর ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। চারটি শাখা মিলিয়ে সর্বমোট ২৪০০০ এর অধিক ছাত্রী ভিকারুননিসা নুন স্কুলে নিয়মিতভাবে শিক্ষালাভ করে থাকেন। এই স্কুলের সাথে উপমহাদেশের ইতিহাসের কিছু সংযোগ আছে। রাওয়াল পিন্ডিতেও তিনি ভিকার-উন-নিসা কলেজ ফর উইম্যান নামে একটি কলেজ তিনি স্থাপন করেছেন।
তিনি ১৯৪৫ সালে ফিরোজ খান নুনকে বিয়ে করেন। ভিকারুন্নিসা, ফিরোজ খানের রাজনৈতিক জীবনেরও সক্রিয় সঙ্গী ছিলেন। ফিরোজখানের সাথে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। ইন্ডিয়ার ভাইসরয়ের মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করে ফিরোজ খান স্ত্রীকে নিয়ে লাহোর চলে আসেন। স্যার ফিরোজ খান নুন ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত এক বুদ্ধিদীপ্ত, প্রাণবন্ত মানুষ। ১৯৩৬ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত তিনি যুক্তরাজ্যে ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি লন্ডনে চার্চিলের যুদ্ধ মন্ত্রীসভায় ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আরকোট র্যামসেমির সঙ্গে অংশ নিয়েছেন। পরবর্তীতে তিনি সক্রিয় ভাবে পাকিস্তান আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ফিরোজ খান নুন ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ১৯৫৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি পাকিস্তানের ৭ম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ফিরোজ খান পাঁচটি বই লিখেছেন। এরমধ্যে তার আত্মজীবনী ফ্রম মেমরি অন্যতম। ফিরোজ খান নুন ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর তার পৈতৃক নিবাস নুরপুর গ্রামে মৃত্যুবরন করেন।
স্বামীর মৃত্যুর পরও ভিকারুননিসা নূন তার সমাজ সেবামূলক কাজ চালিয়ে যান। তিনি ঐ সময়কার অন্যান্য বিখ্যাত নারীদের সাথে তার এই উন্নয়নমূলক কাজ শেয়ার করেন। তাদের মধ্যে রয়েছে প্রয়াত বেগম মাহমুদা সালিম খান, ডঃ আতিয়া ইনায়েতউল্লাহ। তিনি ফ্যামিলি প্ল্যানিং অ্যাসোসিয়েশন অফ পাকিস্তান, পাকিস্তান রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সহ আরো অন্যান্য সমাজ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী সদস্য ছিলেন। তিনি অল্প সময়ের জন্য পাকিস্তান সরকারের পর্যটন ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেডারেল মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
It is not known by many, Gwadar was made a part of Pakistan by the active involvement of Begum Noon. In 1956, despite numerous impediments, she played a vital role for the accession of Gwadar from Oman to Pakistan.
তার জীবনের শেষ দিকের বেশিরভাগ সময় তিনি তার এবোটাবাদের আল-ফিরোজ বাড়িতেই কাটান। সেখানে তিনি নীরবে সৃষ্টিশীল লিখালিখি এবং পড়াশুনার মাঝেই সময় কাটিয়েছেন। দীর্ঘ অসুস্থতার পরে লেডি নুন ২০০০ সালের ১৬-ই জানুয়ারি ইসলামাবাদে মারা যান। পাকিস্তানের ফার্স্ট লেডি হিসাবে তার পূর্বসূরী রা’না লিয়াকত আলি খান। এবং উত্তরসূরী নুসরাত ভুট্টো বাংলাদেশে তার প্রতিষ্ঠিত “ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ” টি আজও একদিকে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিজের উচ্চ মান ও সুখ্যাতি বজায় রেখে চলতে পেরেছে। একই সাথে ভিকারুননিসা নামটি এখনও শিক্ষার্থীদের মাঝে আবেগ-গর্বের কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
লেখক পরিচিতি: ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক