চ্যানেল টুয়েন্টি ফোর এর টিম সার্চলাইটের সিনিয়র রিপোর্টার আব্দুল্লাহ আল ইমরান টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ব্যুরোতে ইন্টার্নশীপ শেষে এ বছরের এপ্রিলে যোগ দিয়েছিলেন বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যম কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন-সিবিসি-তে। টেলিভিশনটির প্রাইম ইনভেস্টিগেটিভ শো ‘দ্যা ফিফথ স্টেট’ এ অ্যাসোসিয়েট প্রডিউসার হিসেবে। সাপ্তাহিক ভোরের আলো’তে ২৫ এপ্রিল এ নিয়ে একটি সংবাদ আমি প্রকাশ করি। আমি তখনই জানতে পেরেছিলাম একটা বিশাল কাজ করতে যাচ্ছেন আব্দুল্লাহ আল ইমরান।
২০১০ সালে ১০ই মার্চ দৈনিক কালের কণ্ঠ এর ‘রাজকুট’ এ আমাকে এবং আমার টিমকে নিয়ে “যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, চার লক্ষ গণসাক্ষর আছে প্রতীক্ষায়” শিরোনামে প্রতিবেদন করেন তিনি। সেই থেকে আমার সাথে পরিচয়। তারপর ২০১১ এবং ২০১২ বইমেলায় নিয়মিত আড্ডা হতো। এর মাঝে ২০১২ সালে তার সম্পাদিত “ভালোবাসার গল্প” বইটির প্রকাশক ছিলাম আমি। সে অনেক সুখস্মৃতি।
তারপর ২০১২ সালে কানাডায় চলে আসার পর কানাডার অটোয়ায় পার্লামেন্ট হিলে কুইবেক আওয়ামী লীগের সভাপতি মুন্সী বশিরের নেতৃত্বে নূর চৌধুরীকে দেশে পাঠানোর দাবিতে বিশাল মানববন্ধনে যোগ দিলাম তারই আমন্ত্রণে। আমরা জানতাম টরন্টোতে আত্মগোপনে আছে সেই ঘাতক নূর।
যে তথ্যটি আমাকে আনন্দিত করেছে, তা হলো- কানাডায় শান্তিতে বসবাসকারী নূর চৌধুরীর প্যান্ডোরা বক্সটি ওপেন কারার গুরুত্বপূর্ণ কাজটির ব্যাকগ্রাউন্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল ইমরান। তিনি তুলে এনেছেন প্রায় ৫০ বছরের অমিমাংসিত এক সত্যকে, যার সঙ্গে কেবল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই নয়, আমাদের গোটা জাতিরই বিশেষ এক গভীর অনুভূতি জড়িয়ে আছে।
১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এবং তার প্রায় গোটা পরিবারকে হত্যার দায়ে সাজাপ্রাপ্ত নুর চৌধুরী অবাধে বাস করছেন টরন্টোতে। এ ঘটনায় কানাডার নীরাবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ফিফথ স্টেটের অনুসন্ধান।শেখ মুজিবকে খুনের দায়ে দন্ডিত ঘাতক কী করে অবাধে ঘুরছেন কানাডায়- সেটিই অনুসন্ধান করেছেন টিমোথি সাওয়া, মার্ক কেলি, ইমান বারে এবং আবদুল্লাহ আল ইমরান। তাদের কারণে অবশেষে টরন্টোতে খুনী নূর চৌধুরীর বর্তমান চেহারা দেখা গেল।
এ নিয়ে আব্দুল্লাহ আল ইমরানের স্ত্রী আমাদের সবার প্রিয় তিন্নি আপু লিখেছেন,
“বাংলাদেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আবদুল্লাহ আল ইমরান তুমি যখন কানাডায় আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে সাংবাদিকতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে, সেটি ছিল আমাদের জন্য কঠিন এক সময়। একে তো পুরোপুরি নতুন পরিবেশ, তার উপর আমার প্রেগন্যান্সির শেষ ট্রাইমেস্টার। বরফ-কঠিন সেই সময়ে এক শহর থেকে আরেক শহরে তোমাকে ছুটতে হয়েছে দিনের পর দিন। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম ব্যুরোতে সাড়ে ৩ মাসের ইন্টার্ণশীপ শেষে মেধা, কঠোর পরিশ্রম আর ঈর্ষনীয় অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তুমি যখন কানাডার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সিবিসিতে প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে যায়গা করে নিলে, সেটি ছিল স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মতোই অসাধারণ একটা ব্যাপার। বিশ্বের সেরা সব সাংবাদিকদের প্লাটফর্মে বাংলাদেশ থেকে এসেও যে যায়গা করে নেওয়া যায়, তুমি তার উজ্জ্বল উদাহরন।
এরপর সিবিসি’র জনপ্রিয় অনুসন্ধানী টিম ফিফথ স্টেটে যোগ দিয়ে এমন একটি বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করলে, যা অমিমাংসিত রয়ে গেছে বছরের পর বছর। মন থেকে চাইলে এবং ইচ্ছা থাকলে এভাবেও যে দেশের জন্য ভূমিকা রাখা যায়, তুমি তা আবারও প্রমাণ করলে।
বাংলাদেশের জাতির পিতা, প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হ-ত্যা-কা-ন্ডে-র প্রধান কুশিলবদের একজন কানাডায় পলাতক বহুবছর। তাকে খুঁজে বের করার যে মিশন, সেটি শেষ হলো সিবিসির অনন্য সাধারণ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘দ্যা অ্যাসাসিন নেক্সট ডোর’ প্রতিবেদনটির মধ্য দিয়ে।
তোমার টিমের কাছে এটি হয়তো আর দশটি ভালো রিপোর্টের একটি, কিন্তু আমি জানি, তোমার জন্য এটি ইতিহাসের অংশ হওয়া। কেননা গত ৭ মাসে খুব কাছ থেকে এই কাজটি নিয়ে তোমার গবেষণা, টিম মিটিংয়ে বিষয়ের গুরুত্ব নিয়ে দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখা, তের হাজার কিলোমিটার উড়ে গিয়ে শুটিং, শত শত কোর্ট ডকুমেন্টস যোগাড় করা, ফ্যাক্ট চেক করা, নূর চৌধুরীকে খুঁজে বের করার মিশন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতি সপ্তাহে ১১ ঘন্টার জার্নি করে আটোয়ায় ফিরে আসা দেখেছি। ফলে এই প্রতিবেদনের মধ্য দিয়ে তোমার আন্তর্জাতিক যে স্টেপিং, তাতে কেবল সাফল্যের উজ্জ্বল পালকই যুক্ত হয়নি, সম্মিলন ঘটেছে দেশপ্রেম আর বাংলাদেশের ইতিহাসর দায় মেটানোর কমিটমেন্টেরও।
রিপোর্টটি প্রচার হওয়ার পর তোমার টিমমেট বিখ্যাত সাংবাদিক মার্ক কেলী আর টিমোথি সাওয়া যখন তোমাকে সুপারম্যান অ্যাখ্যা দিয়ে বারবার বলছিল, তোমাকে নিয়ে প্রাউড ফীল করা উচিত, তখন সত্যিই খুব ইমোশনাল লাগছিল। নিশ্চয়ই তোমার এমন কর্মদক্ষতায় দেশের সুহৃদরাও আনন্দিত হবে।
কানাডার মত উন্নত দেশে তৃতীয় বিশ্বের সংকট ও সম্ভাবনার গল্প বলা এবং সেই গল্পকে তাদের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা কতটা কঠিন, তা যারা এখানে এই চেষ্টাটা করেনি তারা কোনোদিনও বুঝবে না। মহান সৃষ্টিকর্তা যেন তোমাকে এই চেষ্টাটা চালিয়ে যাওয়ার তৌফিক দেন।
আমার আর তিয়ানের পক্ষ থেকে তোমার এই অসাধারণ কাজের জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা। তিয়ান নিশ্চয়ই বড় হয়ে তারা বাবাকে নিয়ে গর্ব করবে। এমন গর্ব করার উপলক্ষ্য ওর জীবনে আরও তৈরি হোক।”