মানবতার কবি ফররুখ আহমদ

মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো

১০জুন- আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র কবি ফররুখ আহমদের জন্ম দিন। মানবতার কবি, রেনেসাঁর কবি, ইসলামী আদর্শবাদী, ঐতিহ্যসন্ধানী স্বপ্ন জাগান- এক কালজয়ী কবি ফররুখ আহমদ। ১৯১৮ সালের ১০ জুন মাণ্ডরা জেলার শ্রীপুরের মাঝাইল গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ছিলেন খান বাহাদুর সৈয়দ হাতেম আলী এবং মাতা সৈয়েদা বেগম রৌশন আখতার।
বাল্য কালে মাণ্ডরাতেই কবির পড়াশুনার হাতে খড়ি শুরু হয়। বাড়িতে গৃহ শিক্ষক এর নিকট তিনি আরবি-ফারসিও শেখেন।
ছোট বেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিভাবান। পিতা সৈয়দ হাতেম আলি কর্ম জীবনে ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর। সেই সুবাদে কবি পিতার কর্মস্থলের বিভিন্ন স্থানে পড়াশুনা করেছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কবি ফররুখ আহমদ কলকাতার মডেল এম.ই. স্কুলে ভর্তি হন। তারপর ভর্তি হন বালিগঞ্জ হাইস্কুলে। তখন ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন খ্যাতনামা কবি, বিশ্বনবী গ্রন্থের রচয়িতা কবি গোলাম মুস্তফা (১৮৯৭-১৯৬৪). এরপর তিনি খুলনা জেলা স্কুলে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। খুলনা জেলা স্কুলে পড়ার সময় কবি আবুল হাশেম (১৮৯৮-১৯৮৫) তার শিক্ষক ছিলেন। এই জেলা স্কুলের ম্যাগাজিনেই কবি ফররুখ আহমদের প্রথম কবিতা ছাপা হয়।
স্কুল জীবন সমাপ্তির পর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩৯ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করেন। এরপর প্রথমে দর্শনে এবং পরে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশুনা করেন। পরে তিনি সিটি কলেজে পড়াশুনা করেন। কিন্তু তৎকালীন রাজনৈতিক ডামাডোল সহ নানাবিধ কারণে তিনি আর শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা চালাতে পারেননি। অর্থাৎ অনার্স পড়াটা শেষ করতে পারেননি।
ফররুখ আহমদের কলেজ জীবনে প্রখ্যাত কবি বুদ্ধদেব বসু তার শিক্ষক ছিলেন। সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী ও তার শিক্ষক ছিলেন। মেধাবী প্রতিভাবান ছাত্র এবং একজন তরুণ কবি হিসেবে তিনি তাদের প্রিয় পাত্রে পরিণত হন। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী হিসেবে ফররুখ আহমদকে সে সময় তার সহ পাঠি বন্ধুদের অনেকেই বাংলার তরুণ শেক্সপিয়র নামে ডাকতেন। সত্যজিৎ রায় (১৯২১-৯২), ফতেহ লোহানী (১৯২৬-৭৫), শিল্পী কামরুল হাসান, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন তার সহ পাঠি। কবি বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত “কবিতা পত্রিকায়” তখন ফররুখ আহমদের কবিতা ছাপা হত। একজন তরুণ কলেজ ছাত্রের, “কবিতা পত্রিকায়”- কবিতা ছাপা হওয়াটা ছিল এক দুর্লভ সৌভাগ্যের ব্যাপার। কলেজে পড়াকালেই ফররুখ এ বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী হন। এভাবে অতি অল্প বয়সেই বাংলা সাহিত্যের এক কালজয়ী প্রতিভার আবির্ভাব ঘটেছিলো। এভাবেই ধীরে ধীরে কাল ক্রমে বাংলা সাহিত্যের আকাশে কাল জয়ী নুতন এ কবি ধ্রুব তারার মত উজ্জ্বল হয়ে কোটি হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। চলার পথে সাহিত্য চর্চার একটি পরিবেশ তিনি নিজ পরিবারেই পেয়েছিলেন।
ফররুখ আহমদ তার ৫৬ বছর জীবনকালের মাঝে প্রায় চার দশক সাহিত্য চর্চা করেছেন। অর্থাৎ কবি কৈশোর কাল থেকেই কবিতা লেখায় মগ্ন হন। বর্ণাঢ্য সাহিত্য সৃষ্টির এই সময়কালে কবি বাংলা কবিতায় উপহার দিয়েছেন অমর কবিতার ভান্ডার। কবি তার চার দশকের সাহিত্যজীবনের এক দশক কলকাতায় এবং তিন দশক ঢাকায় অতিবাহিত করেন। তিনি কলকাতার সাহিত্যজীবনেই কবি হিসাবে সাফল্য অর্জনে সক্ষম হন। এ সময়েই তাঁর কবিতার উজ্জ্বল কিরণ দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। তাঁর প্রথম এবং বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’- [প্রকাশকাল : ডিসেম্বর ১৯৪৪] কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হয়।
১৯৪৩ সালে বাংলায় মহা দুর্ভিক্ষের সময়- দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে লিখা তার ‘লাশ’ কবিতা প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি ছিলেন একদিকে মানবতা বাদী অপর দিকে মুসলিম পুনর্জাগরনের কবি। তাঁর কাব্যের মৌলিক প্রবণতা মুসলিম গৌরব ও জাতীয় চেতনা। বাংলায় আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগে দেখিয়েছেন নৈপুণ্য। এবং বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের অভিনবত্বে তাঁর কবিতা বাংলা সাহিত্যে অনন্য।
সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪), সিরাজাম মুনিরা (১৯৫২), নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১), মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৩), হাতেমতায়ী (১৯৬৬), হাবেদা মরুর কাহিনী (১৯৮১) পাখির বাসা (১৯৬৫), হরফের ছড়া (১৯৭০), ছড়ার আসর (১৯৭০) ইত্যাদি তাঁর শিশুতোষ রচনা। সাহিত্যে বিশেষ অবদানে জন্য তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬০), প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রাইড অব পারফরমেন্স (১৯৬১), আদমজী পুরস্কার (১৯৬৬), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৬), মরণোত্তর একুশে পদক (১৯৭৭) এবং স্বাধীনতা পুরস্কার ১৯৮০ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন।
মুসলিম আদর্শ, ইতিহাস-ঐতিহ্য, কৃষ্টি, কালচারে দেশ ও জাতি পুনঃ উজ্জীবিত হয়ে উঠুক মানবতার কান্ডারি কবি ফররুখ আহমদ কবিতার মাঝে সে আশাবাদই বারবার তুলে ধরেছেন। আশাবাদী কবি- তাই লিখেছিলেন।
“পাল তুলে দাও, ঝাণ্ডা উড়াও, সিন্দাবাদ।
এল দুস্তর তরঙ্গ বাধা তিমিরময়ী।
কী হবে ব্যর্থ ক্লান্ত রাতের প্রহর ণ্ডণে?
নতুন সফরে হবে এ কিস্তি দিণ্বিজয়ী।
তরঙ্গমুখে জাগে কত ভয়কে জানে আজ?
দ্বিধা সংশয় কত জমা হয়_কে মানে আজ?
এ ঝড়-তুফানে জাগো দুর্বার দুঃসাহসী
নতুন সফরে হবে এ কিস্তি দিণ্বিজয়ী।”
(‘নতুন সফর’)
কবি আজীবন জাতীয় পুনর্জাগরনের গান লিখেছেন, লিখেছেন সমাজের অবহেলিত মানুষের কথা। তবে দুঃখের বিষয় তার নিজের শেষ জীবন তাকে দুঃখ কষ্ঠের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করতে হয়েছে। ঢাকা বেতার থেকে তার চাকুরী চলে যায়। টাকার অভাবে তার ছেলেকে ডাক্তারি পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হয়। চিকিৎসার অভাবে এক মেয়ে মারা যায়। মৃত্যুর পর সব শেষে কবি বেনজীর আহমদের শাহজাহান পুরের পারিবারিক গোরস্থানে কবিকে দাফন করা হয়।
আজ সময় এসেছে মাণ্ডরায় অথবা ঢাকাতে মানবতার কবি ফররুখ আহমদ গবেষণা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে আমরা কবির প্রতি আমাদের সত্যিকার শ্রদ্ধার নিদর্শন রাখতে পারি।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
লেখক পরিচিতি: ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ