মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
সভ্যতার ইতিহাসে ম্যাগনা কার্টা ও ফরাসি বিপ্লব অত্যান্ত ণ্ডরুত্বপূর্ণ দুটি অধ্যায়। ১২১৫ সালের ১৫ই জুন টেমস নদীর তীরে ‘রানিমেড’ নামক স্থানে তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজা জন ল্যাকল্যান্ডের সাথে স্বাক্ষরিত রাজা ও প্রজার অধিকার ও দায়িত্ব সংক্রান্ত চুক্তিটিই ম্যাগনাকার্টা নামে অভিহিত ।
চুক্তিতে ঘোষণা করা হয় কেউ আইনের উর্ধ্বে নয়। না রাজা না প্রজা। এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। ইতিহাসে এই প্রথম রাজাকেও সুনির্দিষ্ট ভাবে লিখিত চুক্তির আওতায় আনা হয় এর মাধ্যমেই সুস্পষ্ট ভাবে আইনের শাসন ধারণার যাত্রা হয় শুরু।
এই ম্যাগনাকার্টাকে ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রের বাইবেলও বলা হয়।
রাজনৈতিক ইতিহাসে ম্যাগনা কার্টা প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত ণ্ডরুত্বপূর্ণ ঘটনা। যে শর্ত ণ্ডলি এই চুক্তিতে যুক্ত হয়েছিল, তা হল- রাজা জনগণের প্রতিনিধিত্ব কারি-প্রতিনিধি স্থানীয় লোকদের অনুমোদন ছাড়া কারো স্বাধীনতায় বা সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। এই চুক্তির প্রভাব শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, পরবর্তী কালে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষমতা লিপ্সু রাজা সহজেই এই চুক্তি তে স্বাক্ষর করতে চান নি। কিন্তু সকল জমিদার, সামন্ত, এলিট শ্রেণী ও শিক্ষিত জনগণ মিলে রাজা জনকে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। এই চুক্তিটি বিচার বিভাগকেও নিরপেক্ষ করছিলো। ইংল্যান্ডের সংবিধান বলতে নির্দিষ্ট কোনো দলিল নেই। এই দলিলটি সে দেশের অন্যতম সাংবিধানিক দলিল। প্রজাদের অধিকার ও রাজার ক্ষমতা হ্রাসের যৌক্তিক এ দলিলটি আজও বিশ্বের সকল স্বেচ্ছাচারী শাসকদের সামনে জ্বলন্ত এক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে রেখেছে। রাজা জনের স্বেচ্ছাচারমূলক কাজে জনতা ও ভূস্বামীগণ অতিষ্ঠ হয়েই রাজার ক্ষমতা সংকোচনের জন্য এই এই চুক্তি প্রণয়নে উদ্বুদ্ধ হন।
৮০০ শত’ বছর আগের এই ঘটনার সম সাময়িক সময় কালে ১২০৩ সালে বাংলায় তখন সবে শুরু হয়েছে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খিলজির শাসন আমল। বাংলার ইতিহাসের এক নতুন টার্নিং পয়েন্ট।
ফরাসি বিপ্লব: বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম আর একটি ণ্ডরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং ফ্রান্স প্রজাতান্ত্রিক আদর্শের পথে যাত্রা শুরু করে। একই সাথে চার্চকে গোঁড়ামী পরিত্যাগে বাধ্য করে। বিপ্লব পশ্চিমা সভ্যতা ও রাজনীতিকে অভিজাততন্ত্র থেকে নাগরিকত্বের যুগে উন্নত করে। ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি ছিল “Liberté, égalité, fraternité, ou la mort!” অর্থাৎ “স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রী “। এ শ্লোগানটি বিপ্লবের চালিকা শক্তিতে পরিণত হয়েছিলো এবং তা সামরিক সহিংস ও অহিংস উভয়বিধ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হয়। শ্লোগানটি তখন বিশ্বে একটি জনপ্রিয় স্লোগানে পরিণত হয়েছিল।
সম্রাট ষোড়শ লুই এর (রাজত্বকাল:১৭৭৪-১৭৯২) যখন তিনি রাজকীয় অর্থের সংকটে পড়েন তখনই বৈপ্লবিক সংকটকাল শুরু হয়।
অর্থনৈতিক দুরবস্থা, নারী নির্যাতন, শ্রেণী বৈষম্য, যাজক শ্রেণির ভোগবিলাস, বল্গাহীন জাতীয় ঋণ। দুর্নীতি, অসম করারোপণ, বেকারত্বের উচ্চহার এবং খাদ্যদ্রব্যের উচ্চমূল্য, অষ্টাদশ শতাব্দীর বিভিন্ন যুদ্ধসমূহ এবং সম্রাট লুই ১৬-এর অত্যধিক খরচ এবং সমস্যা সমাধানে তার চরম ব্যর্থতাই ফরাসি বিপ্লবকে অনিবার্য করে তোলে।
ফার্স্ট স্টেট রাজা বা সম্রাট ও পরিষদ, সেকেন্ড স্টেট বড় ব্যবসায়ী, উকিল আমলা ইত্যাদি এলিট শ্রেণী এবং “থার্ড স্টেট” দেশের খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ। এই তিন শ্রেণীর মাঝ কার বৈষম্য, দূরত্ব এবং দ্বন্দ্বও বিপ্লবে ভূমিকা রাখে।
১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসের কুখ্যাত বাস্তিল দূর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। এই বিপ্লব ছিল তদানীন্তন ফ্রান্সের শত শত বছর ধরে নির্যাতিত ও বঞ্চিত “থার্ড স্টেট” বা সাধারন মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এই বিপ্লবের আগে সমগ্র ফ্রান্সের ৯৫ শতাংশ সম্পত্তির মালিক ছিল মাত্র ৫ ভাগ মানুষ। অথচ সেই ৫ ভাগ মানুষই কোন আয়কর দিত না। যারা আয়কর দিত তারা তেমন কোন সুবিধা ভোগ করতে পারত না। এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করত তাদেরকে বাস্তিল দুর্গে বন্দী করে নির্যাতন করা হত। বাস্তিল দুর্গ ছিল স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও জুলুমের প্রতীক। একবার কোন বন্দী সেখানে প্রবেশ করলে জীবন নিয়ে আর ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকত না। বন্দীরা কারাগারের ভিতরেই পচে মরত বা নির্যাতন করে মেরে ফেলা হত। ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই নির্বাচিত প্রতিনিধি, রক্ষী বাহিনির সদস্য এবং বাস্তিল দুর্গের আশেপাশের বিক্ষুব্ধ মানুষ বাস্তিল দুর্গ অভিমুখে রওনা হয়। রক্তক্ষয় এড়াতে প্রতিনিধিরা দুর্গের প্রধান দ্য লোনের কাছে আলোচনার প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব ছিল বাস্তিলে ৭ জন রাজবন্দীকে মুক্তি দেয়া। দ্য লোন সেই প্রস্তাবে রাজি না হওয়াতে বিক্ষুব্ধ জনতার ঢেউ বাস্তিল দুর্গে ঝাঁপিয়ে পরে। দুর্গের সৈন্যরাও ভিতর থেকে কামান দাগাতে থাকে। প্রায় দুইশো বিপ্লবী মানুষ হতাহত হয়। এরপর চারিদিক থেকে উত্তেজিত বিক্ষুব্ধ জনতা বাস্তিল দুর্গ ধ্বংস করে। জয় হয় সাম্য, মৈত্রী এবং স্বাধীনতার। আধুনিক ফ্রান্সের জনগণ এ দিনটিকে প্রতি বছর জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করে।
এই বিপ্লবের মাত্র কিছুদিন আগে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব পলাশীর বিশ্বাস ঘাতকতা পূর্ন যুদ্বে পরাজিত হয়েছেন এবং পরবর্তীতে হত্যার স্বীকার হয়েছেন। ষড়যন্ত্রকারি বিজয়ী পক্ষ ছিল ইংরেজ। ব্রিটিশ দেশে গণতন্ত্রের চর্চা করলেও বিদেশে তারা তৈরী করেছে কলোনি।
এ দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা পশ্চিমা বিশ্বকে বদলে ফেলেছে। নিবিড় ভাবে পর্যালোচনা করলে তা দেখা যাবে। উন্নত বিশ্বে উন্নত সিস্টেম-গণতন্ত্র, আইন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সে দেশের জনগণ ও শাসকের শিক্ষা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতার লেভেল একটি ফ্যাক্টর। বিষয় ণ্ডলো আমরাও ভেবে দেখতে পারি।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)