মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
রাজিয়া সুলতানা পুরো নাম সুলতান রাজিয়া-উদ-দুনিয়া ওয়া উদ্দিন। মামলুক রাজ্ বংশের সুলতান ইলতুৎমিসের জ্যেষ্ঠা কন্যা সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, প্রচন্ড সাহসী এবং যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক। রাজিয়া সুলতানা ১২০৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং ১২৪০ সালে মৃত্যু বরন করেন। তার ৩৫ বছর জীবনী কালে ১২৩৬ সাল থেকে ১২৪০ সাল এই চার বছর তিনি অত্যান্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে দিল্লির মসনদে বসে দেশ পরিচালনা করেছেন। এই সময় কালে একাধারে একজন ভালো প্রশাসক, সাহসী সেনাপতি এবং যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াকু বীর হিসেবে ইতিহাসের বুকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
ইলতুৎমিস নিজ জীবদ্দশায় তার কন্যা রাজিয়াকে উপযুক্ত ভাবে গড়ে তুলতে এবং রাজকর্মের ট্রেনিং দিতে এবং একই সঙ্গে রাজ দরবারের আমত্য, পরিষদ ও সেনা নেতৃত্বের উপর রাজিয়ার কতৃত্ব অর্জন ও তা সুপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অনেকবার যুদ্ধ কালীন অথবা শান্তিকালীন অবকাশ যাপনে দিল্লির বাইরে যাবার সময় শাসনভার সুলতানা রাজিয়ার কাছে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবেই ইলতুৎমিস তাকে গড়ে তুলেছিলেন।
সুলতান ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর তার ছোট পুত্র রোকনুদ্দিন ফিরোজ কিছু ষড়যন্ত্র কারীর সাথে হাত মিলিয়ে এবং তাদের কূ পরামর্শে বড় বোনকে দূরে সরিয়ে নিজেই দিল্লির শাসন ভার দখল করেন। কিন্তু অযোগ্যতার কারনে কিছু দিনের মাঝেই তিনি ব্যর্থ প্রমাণিত হন। এবং সাত মাস পর ১২৩৬ সালে দিল্লির সেনা এবং জনগনের বিদ্রোহের মাঝে সুলতানা রাজিয়া দিল্লির ক্ষমতায় আরোহণ করেন। এবং পরবর্তী চার বছর রাজিয়া দেশকে সু শাসন উপহার দেন। একটি স্বার্থান্বেষী চক্র এবং রক্ষণশীল মহলে থেকে সুলতানা রাজিয়ার বিপক্ষে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক তোলা হয়। তারা একজন মহিলার শাসন মানবেন না এই ধুঁয়া তুলেছিলেন। তার শাসন আমলে সুলতানা রাজিয়া রাজ কর্মে যোগ্যতা, দক্ষতা ও বিশ্বস্ততার নিরিখে জালাল উদ্দিন ইয়াকুত নামে একজন ইথিওপিয়ান হাবশীকে উচ্চ পদে নিয়োগ দেন। ইয়াকুতকে তিনি বিশ্বাস করতেন। তার যোগ্যতা ও দক্ষতায় আস্থা রাখতেন। এই নিয়োগে তার প্রশাসনের ওই পদ প্রত্যাশী তুর্কিদের একটি অংশের মাঝে তার বিরুদ্ধে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। মূলত তখন থেকেই তৎকালীন ক্ষমতার কেন্দ্র ও তার আসে পাশে থাকা জেলাস, স্বার্থান্নেষী ক্ষুদ্র একটি অংশ রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে জোরে শোরে অপ প্রচার শুরু করে। এর সঙ্গে ছোট কিন্তু প্রভাবশালী একটি কোটারি অংশও ষড়যন্ত্রে যোগদেয়।
এরই ফলশ্রুতিতে ১২৩৯ সালে লাহোরের তুর্কি গভর্নর বিদ্রোহ করেন। রাজিয়া দ্রুত তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তাকে পরাজিত করেন। সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরে সে ক্ষমা প্রার্থনা করে। রাজিয়া তাকে ক্ষমা করে দেন। এর কিছুদিন পর বাথিন্দার গভর্নর বিদ্রোহ করেন। বাথিন্দার গভর্নর ছিলেন মালিক ইখতিয়ারুদ্দীন আলতুনিয়া। তিনি রাজিয়ার ছোটবেলার খেলার সাথী ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি রাজিয়াকে পছন্দ করতেন। কিন্তু রাজিয়াকে নিয়ে এবং তার সম্পর্কে হাবশীকে যুক্ত করে ণ্ডজব শুনে তিনিও রাজিয়ার উপর ক্ষিপ্ত হন। এবং রাজিয়ার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। রাজিয়া যখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন তখন দিল্লির তুর্কি কর্মকর্তারা এক সামরিক ক্যু করে তাকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে এবং তার ছোট ভাই বাহারামকে সুলতান ঘোষণা করেন। রাজিয়া তখন ভাতিন্ডার বিদ্রোহী গভর্নর এবং তার ছোটবেলার বন্ধু মালিক ইখতিয়ারুদ্দীন আলতুনিয়াকে বিয়ে করেন। এর পর প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনী গঠন করে ১২৪০ সালে আলতুনিয়া আর রাজিয়ার সম্মিলিত শক্তি দিল্লি সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সময় রাজিয়ার অনুগত দিল্লীর কিছু আমির দিল্লী ত্যাগ করে রাজিয়ার সাথে যোগদান করে কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তারাই আবার পালিয়ে যায়। এমনকি আলতুনিয়ার কিছু ঘনিষ্ঠ আমিরও তাদের অনুসরণ করে পালিয়ে যায়। ফলে যুদ্ধে রাজিয়া আর আলতুনিয়া উভয়েই পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে রাজিয়া ভারতের উত্তর দিকে পালিয়ে যান। সেখানে আবারো সংগঠিত হয়ে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কাইঠালে দিল্লীর সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এবারও পরাজিত হন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় এক ষড়যন্ত্র কারি ণ্ডপ্তচরের দেওয়া বিষ মিশ্রিত খাদ্য খেয়ে রাজিয়া সুলতানার মৃত্যু হয়। আর একইসাথে চূড়ান্তভাবে পতন ঘটে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী শাসক সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)