শীর্ষ সন্ত্রাসী আব্বাস উদ্দিন ওরফে কিলার আব্বাস ১৬ বছর ধরে কারাবন্দি। এই সময়ে একদিনের জন্যও জামিন পাননি। এতে অবশ্য তার ‘সংসারী’ হতে সমস্যা হয়নি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, চার বছর আগে ছেলেসন্তানের বাবা হয়েছেন তিনি। মিরপুরে জবরদখল করা একাধিক ডিশ লাইনের ব্যবসা চলছে তার সেই ছেলের নামে রাখা ‘আইদান ক্যাবল নেটওয়ার্ক’র ব্যানারে।
ছেলেটি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। মা হামিদা বেগম তাকে মাসে অন্তত দুবার থাইল্যান্ড ও ভারতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। বেশ কিছু দিন ছেলেটি রাজধানীর একটি হাসপাতালেও চিকিৎসাধীন ছিল। তার জন্মদিনের জমকালো অনুষ্ঠানও হয়েছিল বনানীর একটি পার্টি সেন্টারে। সেই অনুষ্ঠানে এক প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য মিলেছে।
এর আগে রাজধানীর আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী কাইল্যা পলাশ কারাবন্দি থাকা সত্ত্বেও সন্তানের বাবা হওয়ার খবর বেরিয়েছিল গণমাধ্যমে।
ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে এবং কচুক্ষেত এলাকায় প্রকাশ্যে দুই ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ২০০৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার হন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আব্বাস। সেই থেকে তিনি কারান্তরীণ। বর্তমানে তিনি গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে (পার্ট-২) রয়েছেন।
আব্বাসের ঘনিষ্ঠজনের বরাতে জানা গেছে, জেলের বন্দিজীবনে থেকে শুধু পিতৃত্বের স্বাদই নয়, অপরাধ জগতও নিয়ন্ত্রণ করছেন তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম আব্বাস। রাজধানীর মিরপুর, কাফরুল, ভাসানটেক তেজগাঁও ও শিল্পাঞ্চল এলাকায় চাঁদাবাজি, দখলবাজি, মাদক কারবার, ডিশ লাইনের ব্যবসা, ঝুট ব্যবসা, গরুর হাটের ইজারাসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজি, মিরপুর বিআরটিএ অফিস ঘিরে গড়ে ওঠা অপরাধ সাম্রাজ্যও তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন। কারাগারে বসেই মোবাইল ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, আইএমও, মেসেঞ্জারে অডিও ও ভিডিও কলের মাধ্যমে সহযোগীদের নির্দেশনা দেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ঢাকা উত্তরের স্থানীয় রাজনীতিতেও তার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। তার বাহিনীর ক্যাডারদের নামের তালিকাও বেশ লম্বা।
জানা গেছে, বিভিন্নজনের নামে নেওয়া অর্ধশতাধিক মোবাইল সিমকার্ড রয়েছে আব্বাসের। গত ছয় মাসে অন্তত ১৫টি নম্বর ব্যবহার করে কথা বলেছেন প্রায় প্রতিদিন। এর মধ্যে ০১৯৯৮৬৩৯৮৪৮ ও ০১৯০৯৭৪৬৮৬৩ নম্বর দুটি সেভ করা যথাক্রমে ‘দোস্ত’ ও ‘এএএএএ’ নামে। এসব সিম দিয়ে আব্বাস নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন স্ত্রী, আত্মীয়স্বজন, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও নিজের ক্যাডার বাহিনীর সঙ্গে। কারাগার থেকে তিনি যে মোবাইল ফোনে খুনের নির্দেশনা দিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এর প্রমাণও রয়েছে। মিরপুর-১০ নম্বরের এক ঝুট ব্যবসায়ীর সঙ্গে আব্বাসের মোবাইল ফোনে ১৪০ সেকেন্ড কথা হয়েছে। সেই কথোপকথনের শেষ বাক্যটি ছিল- ‘পাঁচ লাখ টাকা দিবি, নইলে জান’।
সম্প্রতি কথা প্রসঙ্গে কিলার আব্বাসের ভায়রা মাসুম আমাদের সময়কে বলেন, আব্বাস ভাইয়ের একটিমাত্র ছেলে, নাম আইদান। আগের তুলনায় তার শারীরিক অবস্থা এখন একটু ভালো। আইদানের বয়স জানতে চাইলে তিনি প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। কারাবন্দি আব্বাস জেলে বসে মোবাইল ফোনে তার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন এমন অভিযোগের বিষয়ে মাসুম বলেন, করতে পারে, তবে আমার সঙ্গে তার (আব্বাস) কথা হয় না।
অভিযোগ উঠেছে, কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা কাশিমপুর কারাগারের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘ম্যানেজ’ করে ভেতরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন কিলার আব্বাস। তবে এসব বিষয়ে কিছুই জানা নেই বলে দাবি করেছেন ঢাকা বিভাগের ডিআইজি প্রিজন্স টিপু সুলতান। তিনি বলেন, এগুলো আমি অবগত নই। আর কারান্তরীণ কেউ বাবা হওয়ার অভিযোগ তো বিস্ময়কর; অসম্ভব। এগুলো খতিয়ে দেখা হবে। অভিযোগের সত্যতা পেলে জড়িতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট ২-এর সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালা আমাদের সময়কে বলেন, আব্বাস কারাগারে বসে মোবাইল ফোন, আইএমও ব্যবহার করছেন; বাইরের অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে- তা সত্য নয়। কারণ কারাবন্দিদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। তা ছাড়া কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রয়েছে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা, মোবাইল ফোন ফ্রিকোয়েন্সি জ্যামার মেশিন এবং সার্বক্ষণিক নিরাপত্তামূলক চেকআপের ব্যবস্থা। এত নিরাপত্তা ভেদ করে পার্ট-২ কারাগারের কারাবন্দি কারও পক্ষেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করা সম্ভব নয়। চার বছর আগে কিলার আব্বাস বাবা হয়েছেন এমন তথ্যে বিস্ময় প্রকাশ করে জেল সুপার বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি খোঁজখবর নিচ্ছি।
পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. মোস্তাক আহমেদ বলেন, বিদেশ ও কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে চাঁদা দাবির বিষয়ে মাঝেমধ্যে যে অভিযোগ পাওয়া যায়, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বসহকারেই তদন্ত করা হয়। ইতোমধ্যে একজন কর্মকর্তাকে শুধু এই বিষয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কারাগারে বসে কিলার আব্বাস সন্তানের বাবা হয়েছেন এমন অভিযোগের বিষয়ে অবগত নন জানিয়ে মোস্তাক আহমেদ বলেন, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।
আব্বাসের বাবার নাম সাহাবুদ্দীন ওরফে তমিজ উদ্দীন। আশির দশকে ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডে গড়ে ওঠা ফাইভ স্টার গ্রুপে যোগ দেন আব্বাস। ২০০২ সালে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক এক সভাপতির হাত ধরে রাজনীতিতেও নাম লেখান। সে বছরই হন কাফরুল থানা ১৬নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।
সূত্র জানায়, জেলে বসেই শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন আব্বাস। জবরদখলের মাধ্যমে তার পরিবারের লোকজন হয়েছেন বিস্তর জমির মালিক। মিরপুর-কাফরুলেই তার রয়েছে সাতটি ফ্ল্যাট ও ১৫টি বাড়ি। যার মধ্যে চারটি বহুতল ভবন। কিলার আব্বাসের অপরাধ সাম্রাজ্য থেকে আসা টাকা যায় তার স্ত্রী হামিদা বেগমের কাছে। এই টাকা হামিদার হাতে তুলে দেন আব্বাসের কালেক্টর ও স্ত্রীর ব্যক্তিগত গাড়িচালক রহমান। ২০১৭ সালে ইব্রাহিমপুরে ২০ বছরের পুরনো ডিশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জালালকে গুলি করে এটি দখল করে আব্বাসের লোকজন। এর পর এটির নাম রাখা হয় ‘আইদান ক্যাবল নেটওয়ার্ক’। এবার কোরবানির ঈদে আব্বাসের স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান ‘হামিদা এন্টারপ্রাইজের’ নামে কচুক্ষেত ও ভাসানটেকের গরুর হাট পরিচালিত হয়।
সরকারি হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও ডেন্টাল কলেজে টেন্ডারবাজিও করে আব্বাসের অনুসারীরা। তার মনোনীত প্রতিষ্ঠান (হামিদা এন্টারপ্রাইজ) ছাড়া অন্য কেউ কাজ পান না বলে অভিযোগ রয়েছে। এই সিন্ডিকেটের হোতা আব্বাসের ভায়রা মাসুম। তবে এসবের সঙ্গে নিজের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলে দাবি করেন মাসুম।
জানা গেছে, আব্বাস মিরপুরের বিআরটিএর চাঁদার টাকা পান জাহিদ, বিপুল ও শাহীনের মাধ্যমে। মিরপুরের ঝুট ও মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন হাবিবুর রহমান রাব্বি ও আব্বাসের শ্যালক ডেভিড।