ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান ওরফে রাফি হত্যা মামলার রায়ে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলাসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মামুনুর রশিদ এ রায় ঘোষণা করেন।
এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) পুরো বিষয়টির একটি চিত্র আঁকে। সেখানে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় অভিযোগপত্রভুক্ত ১৬ আসামির কার কী ভূমিকা ছিল, তা তুলে ধরা হয়।
অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা: সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ না নিলেও নির্দেশ দিয়েছেন বলে অভিযোগ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, নুসরাতের যৌন হয়রানির মামলা তুলে নিতে চাপ প্রয়োগ, তাতে কাজ না হওয়ায় ভয়-ভীতি দেখানো এবং পরে নুসরাতকে হত্যার জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেন তিনি।
নূর উদ্দিন: নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল অধ্যক্ষের ঘনিষ্ঠ সহযোগী নূর উদ্দিনের। অভিযোগপত্রে বলা হয়, নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার আগে রেকি করা ছিল তার দায়িত্ব। আর ভবনের ছাদে আগুন দেওয়ার সময় নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকি করা ছিল তার দায়িত্ব।
শাহাদাত হোসেন শামীম: নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন শামীম। সেজন্য ছিল তার ক্ষোভ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে কার কী ভূমিকা হবে সেই পরিকল্পনা সাজান শামীম। কাউন্সিলর মাকসুদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তিনি তার বোরখা ও কেরোসিন কেনার ব্যবস্থা করেন। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার সময় তিনি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেন। তার জবানবন্দির ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বোরখা ও কেরোসিন ঢালতে ব্যবহৃত গ্লাসটি উদ্ধার করে পিবিআই।
কাউন্সিলর মাকসুদ আলম: অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা গ্রেপ্তার হলে ২৮ মার্চ তার মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনে অংশ নেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, বোরখা ও কেরোসিন কেনার জন্য তিনিই ১০ হাজার টাকা দেন। পিবিআই বলছে, পুরো ঘটনার আগাগোড়াই তিনি জানতেন।
সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের: বোরখা ও হাতমোজা পরে সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অভিযোগ জোবায়েরের বিরুদ্ধে। নুসরাতের ওড়না ছিঁড়ে দুই ভাগ করে পা বাঁধা এবং কেরোসিন ঢালার পর ম্যাচ দিয়ে আগুন ধরানোর কাজটি তিনিই করেন বলে তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্য।
জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ: বোরখা পরে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়ার অভিযোগ জাবেদের বিরুদ্ধে। পা বাঁধা হলে পলিথিন থেকে কেরোসিন গ্লাসে ঢেলে তিনি নুসরাতের গায়ে ছিটিয়ে দেন এবং সব কাজ শেষে বোরখা খুলে পরীক্ষার হলে ঢুকে যান বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ আছে।
হাফেজ আব্দুল কাদের: নুসরাতের ভাই নোমানের বন্ধু কাদের সেদিন মাদ্রাসার মূল ফটকে পাহারায় ছিলেন বলে অভিযোগ। নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হলে দুই মিনিট পরে তিনিই ফোন করে নোমানকে বলেছিলেন, তার বোন গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
আবছার উদ্দিন: ঘটনার সময় তিনি গেইটে ছিলেন পাহারায়। মামলা তুলে নিতে চাপ দেওয়াও তার দায়িত্ব ছিল বলে অভিযোগ।
কামরুন নাহার মনি: আসামি শামীমের দূর সম্পর্কে ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনি ২ হাজার টাকা নিয়ে দুটি বোরখা ও হাতমোজা কেনেন। হত্যাকাণ্ডে তিনি সরাসরি অংশ নেন বলে অভিযোগ। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ছাদের ওপর নুসরাতের হাত বাঁধা হলে তাকে শুইয়ে ফেলে বুকের ওপর চেপে ধরেন মনি। আগুন দেওয়া হলে নিচে নেমে এসে আলিম পরীক্ষায় বসেন।
উম্মে সুলতানা ওরফে পপি: অধ্যক্ষ সিরাজের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা পপি সেদিন নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যান। পরে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। তাতে রাজি না হওয়ার নুসরাতের ওড়না দিয়ে তার হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে পা চেপে ধরেন বলে অভিযোগ।
আব্দুর রহিম শরীফ: ঘটনার সময় তিনি মাদ্রাসার ফটকে পাহারায় ছিলেন। পরে তিনি ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালান।
ইফতেখার উদ্দিন রানা: মাদ্রাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন।
ইমরান হোসেন ওরফে মামুন: মাদ্রাসার মূল গেইটের পাশে পাহারায় ছিলেন।
মোহাম্মদ শামীম: সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন। কেউ যেন ওই সময় ছাদে যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করা তার দায়িত্ব ছিল বলে অভিযোগ।
রুহুল আমীন: মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহসভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন শুরু থেকেই এ হত্যা পরিকল্পনায় ছিলেন বলে অভিযোগ। ঘটনার পর পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। ঘটনার পর শামীমের সঙ্গে তার ফোনে কথা হয়। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টাতেও তার ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়।
মহিউদ্দিন শাকিল: ঘটনার সময় সাইক্লোন সেন্টারের সিঁড়ির সামনে পাহারায় ছিলেন।