দিনের বেলায় মাঠে ব্যাটিং অনুশীলন, রাতে মাঠের বাইরেই পানি পুরি বিক্রি- ১১ বছরের এক কিশোরের নেশা ও পেশা দুটোই একবিন্দুতে মিলে গিয়েছিল মুম্বাইয়ের বিখ্যাত আজাদ ময়দানে। অচেনা শহরে জীবিকা অর্জনের তাগিদ ছিল। তারচেয়েও বেশি করে ছিল ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা। ছিল ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন। ছয় বছর পর, সেদিনের সেই কিশোর যাশাসবি জয়সওয়াল বিজয় হাজারে ট্রফিতে মুম্বাইয়ের হয়ে খেললেন স্বপ্নময় এক ইনিংস। সর্বকনিষ্ঠ ক্রিকেটার হিসেবে গড়লেন ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরির রেকর্ড। তিন সপ্তাহের মধ্যেই উপহার দিলেন তিনটি লিস্ট ‘এ’ সেঞ্চুরি!
বুধবার ঝাড়খন্ডের বিপক্ষে ম্যাচে মুম্বাইয়ের ওপেনার যাশাসবি ১৫৪ বলে করেন ২০৩ রান। ১৭টি চার ও ১২ ছক্কায় কেবল বাউন্ডারি থেকেই নিয়েছেন ১৪০।
ভারতের একদিনের ম্যাচের এই ঐতিহ্যবাহী টুর্নামেন্টে নিজের অভিষেক মৌসুমের প্রথম পাঁচ ইনিংসে এখনও পর্যন্ত তার সেঞ্চুরি তিনটি।
বিজয় হাজারে ট্রফির দীর্ঘ ইতিহাসে ডাবল সেঞ্চুরি করা মাত্র তৃতীয় ক্রিকেটার যাশাসবি। এবারের আসরেই গত ১২ অক্টোবর গোয়ার বিপক্ষে ম্যাচে ২১২ রানের ইনিংস খেলেছেন কেরালার সাঞ্জু স্যামসন। টুর্নামেন্টের ইতিহাসে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েছিলেন উত্তরাখন্ডের ওপেনার কর্ণ বীর কৌশল। গত বছর সিকিমের বিপক্ষে ম্যাচে তার ব্যাট থেকে এসেছিল ২০২ রান। এই বয়সেই জীবনের কঠিন সব অধ্যায় পেরিয়ে আসা যাশাসবি ২২ গজের লড়াইয়ে নাম লেখালেন সাঞ্জু ও কর্ণের পাশে।
ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট মাতানোর আগে যাশাসবি রাঙিয়ে গেছেন বাংলাদেশও। গত বছর এখানেই অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে সর্বোচ্চ রান করে এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যান জিতেছিলেন টুর্নামেন্ট সেরার খেতাব।
ভাদোহি থেকে মুম্বাই – লড়াইয়ের শুরু
উত্তর প্রদেশের ছোট্ট এক শহর ভাদোহি। সেখানেই জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যাশাসবির। ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ ছেলেবেলা থেকেই। প্রিয় খেলাটিকেই জীবনের পাথেয় করে নেয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল তীব্র।
স্বপ্ন সত্যি করার তাড়না থেকেই হাঁটতে শুরু করেন অনিশ্চিত ও বন্ধুর পথে। ক্রিকেটে ক্যারিয়ার গড়তে মাত্র ১১ বছর বয়সেই বাবার হাত ধরে গ্রাম থেকে চলে আসেন মুম্বাইতে। অচেনা শহরে প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় যাশাসবির সংগ্রাম। ‘সবচেয়ে কঠিন ছিল থাকার জন্য একটা জায়গা পাওয়া’ – সম্প্রতি হিন্দুস্তান টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এখনও কৈশোর না পেরোনো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান।
‘শুরুতে কলবাদেবীর এক ডেয়ারি ফার্মে ঘুমাতাম। কিন্তু তাদের নৈমিত্তিক কাজে খুব একটা সহযোগিতা করতে না পারায় তারা আমাকে অন্যত্র চলে যেতে বলে। আমার বাবা-মা তখন এক আঙ্কেলকে বলেন আমাকে সাহায্য করতে। তার বাসায় আমি কিছুদিন ছিলাম। কিন্তু সে জায়গাটাও খুব বড় ছিল না। তাই তিনিও কিছুদিন পর আমাকে নতুন জায়গা খুঁজতে বলেন।’
একটা উপকার অবশ্য করেছিলেন আঙ্কেল। যাশাসবিকে বলেছিলেন আজাদ ময়দানের কথা। মাঠকর্মীদের থাকার জন্য সেখানে তাঁবুর ব্যবস্থা ছিল। সেই তাঁবুই এরপর হয়ে ওঠে যাশাসবির ঠিকানা। সেখানে কাটিয়েছেন তিন বছর!
তাঁবুর ভেতর ছিল না বিদ্যুত। খুব বেশি গরম লাগলে ঘুমিয়েছেন খোলা আকাশের নিচে।
তবে রাতের কষ্ট ভুলে যেতেন দিনে, যখন পা রাখতেন খেলার মাঠে। আজাদ ময়দানের লাগোয়া এক স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন যাশাসবি। সেই স্কুলের বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর মতো তারও ক্লাসরুমের চেয়ে বেশি সময় কাটত খেলার মাঠে। নিজের মতো করে অনুশীলন করতেন।
তবে অন্যদের মতো শুধুই মনের আনন্দে খেলার ফুরসত ছিল না কিশোর যাশাসবির। পেট চালাতে হবে, দু মুঠো খাবারের ব্যবস্থা তো করতে হবে!
খাবার কিনতে খাবার বিক্রি
বাবা যে সামান্য টাকা দিতেন, সেটা দিয়ে শুরুতে কোনোমতে চলে যেত। তাঁবুতে থাকা স্টোভে রান্না করে খাওয়াটাও খুব একটা কষ্টকর ছিল না যাশাসবির জন্য। তবে মুম্বাই থেকে বাবা চলে যাওয়ার পর খাবারের টাকা জোগাড় করাটাই দায় হয়ে ওঠে তার জন্য। জীবিকার তাগিদে সেসময় কত কিছুই না করেছেন যাশাসবি!
‘নিজের মতো করে খেলে যাচ্ছিলাম। আর টাকা উপার্জনের জন্য সন্ধ্যায় পানি পুরি বিক্রি করতাম। বাবা ততদিনে ফিরে গেছেন। আজাদ ময়দানের পাশেই আঙ্কেলের সঙ্গে পানি পুরি বিক্রি করতাম। সামান্য কিছু আয় হতো, সেটি দিয়ে খাবার কিনতাম। ময়দানে খেলা হলে আমি স্কোরিং করেছি। কেউ করতে না বললেও কাজ করেছি ‘বল বয়’ হিসেবে। আসলে, অর্থ উপার্জন করার জন্য সম্ভব সব কাজই করেছি আমি।’
মাঠে যাদের সাথে খেলতেন, সেই সতীর্থদের কেউ কেউ তার দোকানে ক্রেতা হিসেবেও আসতো। যাশাসবি ভেতরে ভেতরে গুটিয়ে যেতেন। এখনও তার কাছে সেসব স্মৃতি ভীষণ বিব্রতকর। ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে তিনি বলেন, ‘এখনও তারা এটা নিয়ে আমার সঙ্গে মজা করে। তখনও করতো। তবে এখন যেহেতু আমি মুম্বাই দলে সুযোগ পেয়েছি, এখন আরও বেশি মজা করে।।’
‘গুরু’র সাক্ষাৎ ও বদলে যাওয়া মোড়
জ্বালা সিংয়ের গল্পটাও ছিল যাশাসবির মতোই। বড় ক্রিকেটার হবার স্বপ্ন নিয়ে উত্তর প্রদেশের গোরখপুর থেকে মুম্বাইতে এসেছিলেন সেই ১৯৯৫ সালে। কিন্তু বাস্তবতার ছোবলে ভেস্তে যায় স্বপ্ন। চোটজর্জর ক্যারিয়ারের এগোতে পারেননি বেশিদূর। ক্রিকেটার হতে না পেরে একটা সময় মনোযোগ দেন কোচিংয়ে।
২০১৩ এর ডিসেম্বর মাসের এক সকালে আজাদ ময়দানের ‘এ’ ডিভিশনের বোলারদের বিপক্ষে ব্যাটিং করছিলেন যাশাসবি। স্যাঁতসেঁতে উইকেটে এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের দারুণ সব স্ট্রোকের প্রদর্শনী চোখ এড়ায়নি মাঠে উপস্থিত জ্বালা সিংয়ের। বছর তেরোর কিশোরকে ডেকে নেন তিনি। শোনেন তার লড়াইয়ের কথা। যাশাসবির মধ্যে যেন নিজের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নকেই খুঁজে পান জ্বালা। সিদ্ধান্ত নেন, এই ছেলের স্বপ্ন সত্যি করতে সব কিছু করবেন।
করেছেন বটে তিনি! নিজের বাসায় আশ্রয় দেন যাশাসবিকে। হাতে ধরে দেন ক্রিকেটের পাঠ। তার ছোঁয়ায় যাশাসবিও যেন নতুন করে খুঁজে পান নিজেকে। জ্বালা সিংয়ের তত্ত্বাবধানে অনুশীলন শুরু করার সপ্তাহ দুয়েক পরই জাইলস শিল্ডের এক ম্যাচে ব্যাট হাতে ৩১৯ এবং বোলিংয়ে ১২ উইকেট নেন যাশাসবি। টুর্নামেন্টে এরপর আরও একটি ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি আসে তার ব্যাট থেকে।
সেই শুরু। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি যাশাসবিকে। স্কুল ক্রিকেট এবং মুম্বাইয়ের জুনিয়র ক্রিকেটে দারুণ সব পারফরম্যান্স উপহার দিয়ে দ্রুতই নজর কাড়েন। জায়গা পান শ্রীলংকা সফরের ভারত অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। জাতীয় পর্যায়ের কোনো দলে প্রথম সফরেই উপহার দেন সেঞ্চুরি।
পরে জায়গা করে নেন ২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপের দলেও। বাংলাদেশে সেই টুর্নামেন্টে তার দুর্দান্ত সাফল্যের কথা তো বলা হয়েছে আগেই। মুম্বাইয়ের ক্রিকেট কর্তারাও ততদিনে নজর রাখছেন তার পারফরম্যান্সে। গত জানুয়ারিতে মুম্বাইয়ের হয়ে অভিষেক হয়ে যায় রঞ্জি ট্রফিতে। ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকা অনূর্ধ্ব-১৯ দলের বিপক্ষে যুব টেস্টে খেলেন ১৭৩ রানের ইনিংস। যুব ওয়ানডেতে তার গড় এখন ৫৩.১৬।
তবে আলোড়ন তুলেছেন মূলত বিজয় হাজারে ট্রফির পারফরম্যান্সে। এই টুর্নামেন্ট দিয়েই গত ২৮ সেপ্টেম্বর লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে অভিষেক। প্রথম ম্যাচে করলেন ৪৪। পরের ম্যাচেই ১১৩ রান, পাশাপাশি ১টি উইকেট। তৃতীয় ম্যাচে ২২ করার পর টানা দুই ম্যাচে ১২২ ও ২০৩। জানিয়ে দিলেন, ভারতের প্রতিভার খনিতে পাওয়া গেছে নতুন আরেক রত্ন।
নিজের এই অবিশ্বাস্য এগিয়ে চলার বড় কৃতিত্ব যাশাসবি দিলেন জ্বালা সিংকে, তার কাছে গুরুই সবার ওপরে।
‘তিনি আমার সবকিছুর দেখভাল করতেন। আমার কাছে তিনি ঈশ্বরের মতো এবং আমি তাকে সবসময় তাই ভেবে যাব। আমার এই পর্যন্ত আসার পেছনে একমাত্র কারণ তিনি। তবে আমার জন্য এটা শুধুই শুরুর মঞ্চ। উপরে উঠতে গেলে আমার সামনে আরও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে।”