দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে দলটির ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগও সংগঠন থেকে ‘পরগাছা’ দূর করতে প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সংগঠন থেকে সুবিধাবাদী অনুপ্রবেশকারীদের হটাতে অ্যাকশন শুরু করেছেন শীর্ষ নেতারা।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে লেখক ভট্টাচার্য দায়িত্ব পাওয়ার পর এক মাসের মধ্যে এই অভিযান শুরু করলো সংগঠনটি। এরই মধ্যে এই অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
ছাত্রলীগ নেতারা বলছেন, টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে অন্য সংগঠনের নেতা-কর্মীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই অনুপ্রবেশ হয়েছে কখনো নীরবে-অজান্তে, আবার কখনো আর্থিক সুবিধা নিয়ে পদ দিয়ে। এ নিয়ে তৃণমূলে ক্ষোভের প্রকাশ চলছিল। বারবার দাবি উঠেছিল, সংগঠনের অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বাদ দেয়ার। কিন্তু নেতৃত্ব বদল হলেও এই প্রক্রিয়া শুরু করেনি কেউ।
সম্প্রতি বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যকাণ্ডের পর এই দাবি আবারো জোরাল হয়। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেরই ব্যাকগ্রাউন্ড বা পারিবারিক রাজনীতি প্রতিপক্ষ দল বা সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার তথ্য মিলেছে। যে কারণে সংগঠন থেকে অনুপ্রবেশকারীদের সরাতে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
তবে অনুপ্রবেশকারীদের সরাতে গিয়ে যেন সংগঠনের মধ্যে ‘ব্লেম গেইম’ শুরু না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি রাখবে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা। প্রত্যেকটি ইউনিটের সাংগঠনিক নেতা, সাংবাদিক, আইনশৃঙ্খলা ও গোয়েন্দাবাহিনীর কাছ থেকে তথ্য নিয়ে সংগঠনে অনুপ্রবেশকারীদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে ছাত্রলীগ।
জানা গেছে, মঙ্গলবার পিরোজপুরের দুটি ইউনিটের দুই ছাত্রলীগ নেতাকে অনুপ্রবেশের দায়ে বহিস্কার করা হয়েছে। এদের একজন পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাতুল হাসান বাবু। আরেকজন একই জেলা ভান্ডারিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের ধাওয়া ইউনিয়নের যুগ্ম আহ্বায়ক জাহিদ হাসান শোভন শিকদার। পিরোজপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম টিটু এবং সাধারণ সম্পাদক অনিরুজ্জামান অনিক স্বাক্ষরিত এই চিঠি স্থায়ী বহিস্কার চেয়ে কেন্দ্র পাঠানো হয়েছে। অনুপ্রবেশের দায়ে দুজনকে স্থায়ী বহিস্কার চেয়ে কেন্দ্রে যে চিঠি পাঠিয়েছে পিরোজপুর ছাত্রলীগ, এর কপি হাতে এসেছে রাইজিংবিডি ডটকমের কাছে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, জাহিদ হাসান শোভন শিকদারের নামে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ায় তাকে ছাত্রলীগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো এবং তাকে স্থায়ী বহিস্কারের জন্য সুপারিশ করা হলো। অন্যদিকে রাতুল হাসান বাবুকে অব্যাহিত দেয়ার কারণ হিসেবে ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা বলা হয়েছে।
পিরোজপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম টিটু রাইজিংবিডিকে বলেন, অনুপ্রবেশকারীদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্র থেকে এই বিষয়ে আমাদের সতর্ক করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আমরা সংগঠনে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছি।
‘যে দুজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেজন্য তাদের অব্যাহতি দিয়ে স্থায়ী ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কেন্দ্র চিঠি পাঠানো হয়েছে।’
পিরোজপুর জেলা ছাত্রলীগের চিঠি পেয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে কেন্দ্রীয় সংসদ। ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক আহসান হাবিব রাইজিংবিডিকে বলেন, দু-একজনের বিষয়ে তাদের স্থায়ী বহিস্কারের চিঠি দেয়া হবে।
এদিকে বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এনামুল হোসাইনকে অনুপ্রবেশ ও নীতি আদর্শ পরিপন্থি কর্মকান্ডের অভিযোগে তাকে পদ থেকে অব্যাহিত দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য স্বাক্ষরিত চিঠিটি ইস্যু হয়েছে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোতে অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। ক্যাসিনো কাণ্ডে যুবলীগের বেশ কয়েকজন নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর দেখা যায় এর আগে তারা অন্য দল থেকে যুবলীগে প্রবেশ করেছে। এর মধ্যে যুবলীগ পরিচয় দেয়া জিকে শামীম বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাসের ঘনিষ্ঠ এবং যুবদলের সহ সম্পাদক ছিলেন। যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ফ্রিডম পার্টির কর্মী ছিলেন। যুবলীগ দক্ষিণের সহ-সভাপতি এনামুল হক আরমান হাওয়া ভবনের ঘনিষ্ট ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে যুবলীগে পদ নেয় সে। দক্ষিণের আরেক সহ-সভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার ছিলেন। বিএনপির আমলে যুবদল করতেন। আরেক সহ-সভাপতি সরোয়ার হোসেন মনা এক সময় জাতীয় পার্টি করতেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতি হন বিএনপি নেতা ক্যাসিনো ব্যবসায়ী আটক লোকমান হোসেন। লোকমান হোসেনের হাত ধরে বিএনপির রাজনীতিতে আগমন ঘটে মোমিনুল হক সাঈদের। কিন্তু বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মতিঝিল এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর তিনি।
বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিচ্ছিন্ন অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সংশ্লিষ্টরা আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দিয়ে অন্যায় করেছে, প্রভাব খাটিয়েছে, দুর্নীতি করেছে, হত্যকাণ্ড ঘটিয়েছে। ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানকে হত্যার ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা আগে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলটির স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করেছিলেন। সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী খাদিজা বেগমকে চাপাতি দিয়ে কোপানো সেই বদরুল আলমও ছাত্রলীগের কেউ ছিলেন না। নিজেকে ছাত্রলীগ পরিচয় দিতেন। সম্প্রতি বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যকাণ্ডে যাদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আছেন যারা অন্য রাজনৈতিক দলের অনুসারী ছিলেন।
অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের সহ সভাপতি শাহরিয়ার কবির বিদ্যুৎ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ে জামায়াত-বিএনপি পরিবারের যেসব সন্তানেরা ঘাপটি মেরে আছে তাদের হটাতে ছাত্রলীগ কাজ করছে। ছাত্রলীগকে ঢেলে সাজানো হচ্ছে, সংগঠনে কোনো স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির দোসররা থাকতে পারবে না।’
অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগের শীর্ষ পদ হারানো সাবেক সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ইউনিটের কমিটি গঠন করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগের মধ্যে এটি অন্যতম একটি। অভিযোগ রয়েছে তাদের দায়িত্ব পালনকালে এবং এর আগের কমিটির সময়ে অনুপ্রবেশের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় রাইজিংবিডিকে বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগে কোনো অনুপ্রবেশকারীদের ঠাঁই হবে না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে সংগঠনের এদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক ঘটনা ঘটেছে যেসব ঘটনায় ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে। পরে দেখা গেছে এসব ঘটনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ততা তারা কোনো না কোনো সময়ে অন্য সংগঠন থেকে ছাত্রলীগে এসেছে। এসব সুসময়ের নেতাদের বিতাড়িত করতে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে এদের কারণে সংগঠনের ত্যাগী নেতারা কোণঠাসা হয়ে থাকছেন। এদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু হচ্ছে।