মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ “আধুনিক বাংলা ইতিহাসের”- অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। বাংলার নবজাগরণের পুরোধা। প্রখ্যাত শিক্ষাব্রতী- বঙ্গভঙ্গ কালীন সময়কার বাংলার মুসলিম স্বার্থ পক্ষের একজন যোগ্য এবং দক্ষ নেতা। বিশিষ্ট চিন্তা নায়ক এবং বহু ণ্ডনের অধিকারী ক্ষণ জন্মা এক মহাপুরুষ। তিনি আমাদের গৌরব। ব্রিটিশ আমলে বাংলার মুসলিম স্বার্থ আদায়ে তার নেতৃত্বেই জেগে উঠেছিল আর জেগে উঠবার একটি পথ খুঁজে পেয়েছিলো এদেশের মানুষ।
১৮৭১ সালের ৭ জুন ঢাকার নবাব পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ব্রিটিশ ভারতে বাংলা বিহার উড়িষ্যা অঞ্চলে ঢাকার নবাবরা ছিলেন তৎকালীন মুসলিম নবাবদের মাঝে সব থেকে প্রভাবশালী এবং সন্মানীয়।
ইতিহাসে তার অবদান, সময়ের প্রেক্ষাপটে ণ্ডরুত্ব সহকারে আলোচনায় উঠে আসা উচিত। তাকে নিয়ে বা মুসলিম স্বার্থ নিয়ে যারাই কথা বলেছেন এবং কাজ করেছেন বা করেন সুক্ষ তথ্য প্রচার প্রোপাগান্ডার অন্তরালে বিরধীরা তাদের বিভিন্ন ভাবে অসত্য তথ্যে প্রশ্ন বিদ্ধ করেছেন।
আলোচনায় না এনেই এরা সমালোচিত করতে চান! বিষয় ণ্ডলি আমাদের জানা উচিত।
মানবিক দোষ ত্রুটি সহ মানব জীবন। রাজনীতিকরাও তার উর্ধে নন। বস্তু নিষ্ট আলোচনা এবিষয় ণ্ডলি সামনে রেখেই এগিয়ে চলে। নবাব পরিবারের প্রিভিলেজড গন্ডিতে থেকে কেন তিনি রাজনীতি ও সমাজ কর্মকে করেছিলেন সঙ্গী? কিসের তাগিদে? সুখ স্বাছন্দের চেনা পথ ছেড়ে কেনই বা হলেন পরিবারের প্রথম নবাব রাজনৈতিক? এ পথে এসে নিজ ধন সম্পদ, নিজ জীবন কে কেন করে তুলেছিলেন সংকট পূর্ন? কাদের জন্য? তা জানা ও বুঝা কি খুবই কঠিন। এদেশের বুকে যা কিছু তিনি করেছেন তার বেনিফিশিয়ারি আজ কারা? সুফল ণ্ডলি কারা ভোগ করছে? যে কোন আলোচনায় এ বিষয় ণ্ডলিও জেনে নেওয়া প্রয়োজন। তা হলেই বিদ্বিষ্ট সমালোচকদের জন্য তা হতে পারে সঠিক জবাব?
নবাব স্যার সলিমুল্লাহর জীবনী ও কর্ম আলোচনায়, তার শত কর্মের মাঝে যে বিষয় ণ্ডলি উজ্বল ভাবে উঠে আসে তা হল।
এক : বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি কে মুসলিম ও হিন্দু প্রধান অঞ্চলে বিভক্ত করে ইংরেজ যে বঙ্গভঙ্গ করেছিল তার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া কালীন সময়ে তার ভূমিকা।
দুই : ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স এর আহবান এবং এই সম্মেলনে তার প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন। এবং পরবর্তীতে ভারতের রাজনীতিতে মুসলিম লীগের অবদান।
তিন : ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় ও আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠায় তার অবদান।
চার : বাংলায় শিক্ষা প্রসার। এবং এক্ষেত্রে তার অবদান।
পাঁচ : ঢাকার আধুনিকায়নে তার ঐকান্তিক ইচ্ছা। ঢাকার সমাজ জীবন পঞ্চায়েত পদ্ধতিকে সুসংগঠিত করার ক্ষেত্রে নওয়াব সলিমুল্লাহর অবদান
ছয় : মুসলিম বাংলায় মুসলমানকে রাজ নৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের জন্য সংগঠিত ভাবে অধিকার অর্জনে উদ্বুদ্ধ করে তোলা। এবং রাজনীতিতে সচেতন করে তোলাই ছিল তার চিন্তা ধারার মূল অংশ। এ বিষয় ণ্ডলিই মূলত তিনি প্রমোট করেছেন। যার সুদূর প্রসারী প্রভাব আজও অনুভূত হয়।
যেহেতু বিষয় ণ্ডলি ছিল জনমুখী কল্যাণ কামি জন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট রাজনীতির এবং সুদূর প্রসারী চিন্তা যুক্ত। তাই আজও আমাদের চার পাশে তার প্রত্যাক্ষ ও পরক্ষ প্রভাব আছে। তার কর্ম ও চিন্তা ধারার বিপক্ষ বাদীরাও তখনও ছিল প্রবল। আছে এখনও সক্রিয়। তাই আজও তাকে তার শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও যুক্তির বাইরেও সমালোচিত হতে হয়।
নবাব পরিবারের ইতিহাস : ঢাকার নবাব পরিবার ছিলো তৎকালীন ব্রিটিশ বাংলার সবচেয়ে বড় মুসলিম জমিদার পরিবার। এই পরিবারের খাজা আব্দুল্লাহ মুগল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের আমলে ১৭৪৯ সালে কাশ্মীরি থেকে পূর্ব বাংলায় এসেছিলেন। এবং ঢাকা, সিলেট ও বাকেরগঞ্জ জেলায় ব্যবসা ও বসতি স্থাপন করেন।
খাজা হাফিজুল্লাহ : (১৭৩৫-১৮১৫) পারিবারিক প্রচলিত ব্যাবসায়ের সাথে জমিদারিও খরিদ করেন। নবাব খাজা আলীমুল্লাহ : (১৭৯০-১৮৫৪) নবাব পদবি গ্রহণ করা প্রথম নবাব। নবাবেরা ছিলেন ধর্মভীরু কিন্তু আধুনিক ও সংস্কারমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক এবং স্থানীয় হিন্দুদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। সে জন্য ঢাকার হিন্দু নেতা ও সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায় ও নবাবদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন।
১. নবাব খাজা আলীমুল্লাহ:
(১৭৯০-১৮৫৪) নবাব পদবি গ্রহণ করা প্রথম নবাব। (রানী ভিক্টরিয়া কতৃক পদক প্রাপ্ত।)
২. নবাব স্যার আবদুল গনি:
(১৮১৩-১৮৯৬) উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত দ্বিতীয় নবাব।
৩. নবাব স্যার আহসানুল্লাহ:
(১৮৪৬-১৯০১) পরিবারের তৃতীয় নবাব।
৪. নবাব স্যার সলিমুল্লাহ: (১৮৭১-১৯১৫) পরিবারের চতুর্থ নবাব।
৫. নবাব বাহাদুর খাজা হাবিবুল্লাহ: (১৮৯৫-১৯৫৮) পরিবারের পঞ্চম নবাব।
৬. নবাব বাহাদুর খাজা হাসান আসকারি: (১৯২০-১৯৮৪) জমিদারি লুপ্ত হওয়ার পর প্রথম প্রধান উত্তরসূরি এবং শেষ নবাব।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ: (১৮৭১-১৯১৫) ছিলেন পরিবারের চতুর্থ নবাব।
প্রাথমিক শিক্ষা জীবন : নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত এবং একই সঙ্গে একজন সুশিক্ষিত মানুষ । ব্রিটিশ, জার্মান, আরবি ও ফারসি ভাষার অভিজ্ঞ শিক্ষক দ্বারা পারিবারিকভাবে নিজ গৃহে তিনি শিক্ষালাভ করেন। আভিজাত্যের প্রাচীর ডিঙিয়ে তিনি সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের সাথে মেলামেশা করবার মন মানষিকতা নিজ ণ্ডনে নিজেই তৈরী করে নিতে পেরে ছিলেন। তার এই চিন্তা চেতনা দৃষ্টিভঙ্গি তাকে অন্য সব নবাব , রইস , আশরাফ , উচ্চ বিত্তবানদের থেকে পৃ থক করে তুলেছে। তিনি নিজে নিজেকে বাংলার সাধারণ মুসলিম জনসাধারণের নিকট দায়বদ্ধ মনে করতেন।
এই চিন্তা ধারা থেকেই তিনি সাধারণ মানুষ বিশেষ করে সাধারণ মুসলমানদের জন্য কিছু করতে চাইতেন এই পথেই তার মুসলিম লীগ গঠনের মূল ভূমিকায় এবং রাজনীতির মঞ্চে আসা। সে আলোচনায় যাবার আগে ইন্ডিয়ান কংগ্রেস গঠন এবং তার উদ্যোক্তাদের সম্পর্কে কিছু জেনে নেওয়াটা ভাল। এ কথা সত্য ১৮৮৫ এর ডিসেম্বর এ কংগ্রেস গঠনের সাথেই মুসলিম লীগ গঠনের চিন্তা , ভিত্তি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো।
The Indian National Congress: গঠনের ইতিহাস।
The Indian National Congress: Was founded On 28 December 1885. :- History of Congress: Allan Octavian Hume A Retired British Indian Civil Service (ICS) officer founded the Indian National Congress. in order to form a platform for civil and political dialogue among educated Indians. After the Great Rebellion of 1857, Control of India was transferred from the East India Company to the British Empire. As the British Raj, or just the Raj, worked to try to support and justify its governance of India with the aid of English-educated Indians, who tended to be more familiar with and friendly to British culture and political thinking.
On 28 December 1885, at Gokuldas Tejpal Sanskrit College in Bombay, with 72 delegates in attendance., The Indian National Congress was founded . Hume assumed office as the General Secretary, and Womesh Chunder Bonnerjee of Calcutta was elected president. As Prominent delegates included Dadabhai Naoroji, Surendranath Banerjee, Badruddin Tyabji, Pherozeshah Mehta , S. Subramania Iyer, and Romesh Chunder Dutt. And The Englishman Allan Octavian Hume,was their .
Many Muslim community leaders, like the prominent educationalist Sir Syed Ahmed Khan, viewed the Congress negatively, owing to its membership being dominated by Hindus.Many Hindu community and religious leaders were also averse, seeing the Congress as supportive of Western cultural invasion.
১৯০৬ সালের ২৭ থেকে ৩০ ডিসেম্বর নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহবান করেন। এই সম্মেলন উপলক্ষে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে এবং যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন নবাব ভিকারুল মুলক এবং শেরে এ বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স এর ঐ সম্মেলন উপলক্ষে যে শক্তিশালী কার্যকর কমিটি গঠিত হয় সেই কমিটিতে তৎ কালীন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাগ্মী মুন্সি মোহাম্মদ মেহেরুল্লাহও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিন দিন ব্যাপী এই সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকার আহসান মঞ্জিল ও শাহবাগে সর্ব ভারতীয়, সব প্রদেশ ও অঞ্চলের মুসলিম প্রতিভাবান , তেজস্বী প্রায় ৫ হাজার ডেলিগেট অংশ গ্রহণ করেন। এই কনফারেন্সেই নবাব সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে একটি নুতন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অবশেষে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগে গঠিত হয় ।
মুসলিম লীগের প্রথম কমিটি : – মুসলিম লীগের প্রথম প্রেসিডেন্ট :প্রিন্স সুলতান মোহাম্মদ আগা খান। মুসলিম লীগের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট : নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। মুসলিম লীগের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল : সৈয়দ হোসেন বিলগ্রাম।
(Sultan Muhammad Shah (Aga Khan III) was appointed the first honorary president of the Muslim League, though he did not attend the Dhaka inaugural session. There were also six vice-presidents, a secretary, and two joint secretaries initially appointed for a three-year term, proportionately from different provinces. The League’s constitution was framed in 1907, espoused in the “Green Book,” written by Maulana Mohammad Ali )
মুসলিম লীগের সৃষ্টি কালীন সময় প্রেসিডেন্ট পদটিকে সম্মানের প্রতীক স্বরূপ রাখা হয় । প্রকৃত পক্ষে পরবর্তী অধিবেশনের কনভেনরকেই – অফিফিসিয়ালি করণীয় কাজ ণ্ডলি চালিয়ে নিতে হত। প্রথম এক্টিং ভাইস প্রেসিডেন্ট হন – * নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। এবং প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল হন : সাইয়েদ হোসেন বিলগ্রামী।
(The first secretary-general of the All Muslim League was Syed Hussain Bilgrami (1842/44–1926). At the time, Bilgrami was an experienced politician, diplomat, and statesman of British India.)
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ তার জীবনে বাংলার মুসলিমদের কল্যানে নিজ ক্ষমতা শক্তি সাধ্যের মাঝে সব কিছুই করেছেন। কিছু সমালোচক তিনি উর্দূ ফার্সি ভাষী , অবাঙালি ইত্যাদি বলতে চান। ভুলে যান এক সময় হাজার বছর ফার্সি ছিল ভারতে ইংরেজির মতই রাজ্ ভাষা। এদেশের হিন্দু শিক্ষিতরাও ফার্সি জেনে গর্বিত হতেন। এটি ইতিহাস। বাহির থেকে আসা বললে নবাব সিরাজ উদ দৌল্লার পূর্ব পুরুষ ইয়েমেন থেকে আগত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পূর্ব পুরুষও ইরাক থেকে আসা। নবাব স্যার সলিমুল্লাহর পূর্ব পুরুষ ইরান থেকে কাশ্মীর হয়ে বাংলায় এসেছিলেন।
সুবাস বোসের পূর্ব পুরুষ উত্তর প্রদেশের। সেনরা কর্ণাটক থেকে আসা। মাদার তেরেসা , সোনিয়া গান্ধী ইউরোপ থেকে আসা ভারত ও পশ্চিম বাংলায় এতে কোন অসুবিধা নেই। অসুবিধা হয় শুধু কিছু সমালোচকের।
১৯১৫ সালের ১৬ জানুয়ারি নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ইন্তেকাল করেন । ১৬ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় কলকাতায় আলিয়া মাদরাসা সংলগ্ন ওয়েলসলি স্কোয়ার পার্কে নামাজে জানাজা শেষে ১৭ জানুয়ারি নবাব সলিমুল্লাহর মরদেহ ঢাকায় আনা হয়। ঢাকায় দু’টি জানাজা শেষে নবাবকে দাফন করা হয় বেগমবাজার পারিবারিক গোরস্তানে।
তার অকাল মৃত্যু নিয়ে রয়েছে নানা কৌতূহল, নানা প্রশ্ন, অনুসন্ধিৎসু মন আজও খুঁজে বেড়ায় তার রহস্যময় মৃত্যুর কারণ। কেন অকালে ঝরে গেলেন বাংলার এই মহৎ প্রাণ। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা স্যার সলিমুল্লাহ? ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠন এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা না হলে আজকের বাংলাদেশের ইতিহাস হতে পারত অন্য রকম।
মাহবুবুর রব চৌধুরী -টরন্টো, কানাডা
সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব টরন্টো।
(আহবায়ক-২০০০- উত্তর আমেরিকা বাংলাদেশ সম্মেলন- ফোবানা টরন্টো- কানাডা।)