স্ত্রী আর দুই সন্তান সঙ্গে এসে থাকবেন বলে ২৫ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে টরন্টোয় একটি বাড়ি কিনেছেন। সেই স্বপ্ন নিয়ে ছেলে-মেয়েদের সুশিক্ষার ব্যবস্থাও করেছেন। শেষ পর্যন্ত নিজেকেই ফিরে আসতে হচ্ছে দেশে।
পরিবার ছেড়ে ১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে কানাডায় পালিয়ে যান মোহাম্মদ মাহফুজ আলম। পরে ২০১৫ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে দক্ষ একজন অভিবাসী কর্মী হিসেবে বাবার কাছে যান ছেলে শাহেদ।
কিন্তু ছেলে যখন কানাডায় নিজের পরিবার নিয়ে স্থায়ী হয়ে উঠছে ঠিক তখন ৬১ বছর বয়সী মাহফুজ আলম এই শুক্রবার দীর্ঘদিন ধরে ঠেকিয়ে রাখা প্রত্যাবাসনের মুখোমুখি হচ্ছেন বলে জানিয়েছে টরন্টো স্টার।
পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, আত্মগোপন কিংবা নিখোঁজ না হওয়া নিশ্চিত করতে প্রতি মাসের তৃতীয় বুধবার ফোনে কিংবা সশরীরে হাজির হয়ে তিনি কানাডা বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সির কাছে রিপোর্ট করেছেন বছরের পর বছর।
কানাডা কাউকে তার নিজ দেশে দ্রুত প্রত্যাবর্তন করতে চাইলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারণে তা দীর্ঘ হয়। এই সময়ে ওই ব্যক্তি কাজ করতে পারেন, কর দিতে পারেন এবং অন্য নাগরিকদের মতোই থাকতে পারেন।
গত বছর নভেম্বরের একটি নির্ধারিত দিনে বর্ডার সার্ভিসেস এজেন্সিতে সশরীরে হাজির হতে পারেননি ষাটোর্ধ্ব মাহফুজ। পরে কর্মকর্তারা একটি পরোয়ানা জারি করে গত ৭ মে কর্মস্থল থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেন।
এর ফলে ছেলে আর ছেলের বউসহ চার নাতিকে ছেড়ে তাকে ফিরে আসতে হবে বাংলাদেশে। তার এমন পরিণতি পরিবারের সদস্যরা মেনে নিতে পারছেন না বলে জানান ছেলে শাহেদ।
“তারা আমার বাবাকে কানাডায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিল। এই দেশে তিনি তার সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। তার কাছ থেকে শ্রম আর কর নিয়ে এখন তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে তাড়াহুড়া করছে।”
একটি গুদামে সাধারণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন শাহেদ। তিনি জানান, ছয় বছরের ছেলে এবং চার বছর বয়সী তিন যমজ পুত্রের লালন-পালনে কানাডায় তিনি বাবার ওপর নির্ভরশীল।
টরন্টো স্টার জানায়, বর্ডার এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, শরণার্থী হিসেবে মাহফুজ আলমের আবেদন ১৯৯৭ সালে প্রত্যাখ্যান করা হয়। ২০০০ সালে সে আবেদন বাতিল হয়ে যায়।
তাদের তথ্য বলছে, দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য ২০০৯ সালে সাক্ষাৎ করার জন্য এবং পাসপোর্টের আবেদন করতে বলার আগ পর্যন্ত আগের নয় বছরে এ সংক্রান্ত কোনো কিছুই ঘটেনি।
২০১২ সালে তিনি ভেবেছিলেন নিরাপদেই বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবেন। কিন্তু এজন্য তার একটি জন্ম সনদ দরকার ছিল বলে বর্ডার এজেন্সির কর্মকর্তারা তার ফাইলে লিখেছেন।
পরবর্তীতে ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে আবারও তাকে ভ্রমণ সংক্রান্ত নথির আবেদনের বিষয়ে দুই দফা সাক্ষাৎ করার জন্য তারিখ দেওয়া হয় বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।
গত বছর অগাস্টে আরেকবার দেখা করার পর তাকে ভ্রমণ নথির জন্য আবেদন করতে বলা হয়। অবশ্য গত ২৮ নভেম্বর নির্ধারিত দিনে হাজির হতে না পারায় ৭ মে তাকে গ্রেপ্তার করে চারদিন আটকে রাখা হয়।
শাহেদ জানান, তার বাবা কিংবা ইমিগ্রেশন কনসালট্যান্ট তাদের কেউই গত ২৮ নভেম্বর দেখা করার কোনো সময় দেওয়া হয়েছিল কি না সে বিষয়ে জানেন না, কারণ তারা এ সংক্রান্ত কোনো চিঠি পাননি।
বর্ডার এজেন্সির গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় বলা হয়, চিঠিটি ভুল ঠিকানায় পৌঁছেছিল কিন্তু তার একটি কপি মাহফুজ আলমকে ইমেইলে পাঠানো হয়েছে।
শাহেদ বলেন, “আমার বাবাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তিনি কর্মকর্তাকে ফোনে তল্লাশি চালাতে বলেন। তিনি যদি জানেন যে, ইমেইলটি আছে তবে কেন ফোন তল্লাশি করতে দেবেন?
তিনি জানান, প্রযুক্তি বিষয়ে তার বাবার জানাশোনা খুব বেশি নয় এবং তিনি মাঝে-মধ্যে ইমেইল দেখেন।
দেশে একটি নির্মাণ কাজের উপকরণ সরবরাহের দোকানের মালিক মাহফুজ জানান, প্রথমে যখন টরন্টোতে যান তখন তিনি সেখানে থালা-বাসন পরিষ্কারের কাজ করতেন, পরে পাচকের কাজও করেন।
তবে গত ২০ বছর ধরে মেশিন অপারেটরের কাজ করছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশে আমার পরিবারের জন্য সপ্তাহের সব দিনই আমি রাত পর্যন্ত কাজ করেছি।
“তারা যাতে এখানে আসার পর একটা থাকার জায়গা পায় সেজন্য আমি ২০০৪ সালে শহরের এই বাড়িটা ৩ লাখ ডলারে কিনেছি।”
টরন্টোয় পরিবারের সঙ্গে থাকতে না পারার হতাশা জানিয়ে মাহফুজ বলেন, “আমি আশায় ছিলাম হয়তো আগামী বছর, পরে ভেবেছি তার পরের বছর। কিন্তু তা আর কখনো হয়নি।”