কাদম্বরী দেবী। জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সন্তান প্রতিভাবান নাট্যকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী। তবে তিনি বেশি পরিচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুন বৌঠান নামেই।
রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্ক এক বহুলচর্চিত বিষয়। প্রায় সমবয়সি হওয়ায় দেবর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাদম্বরীর ছিল হৃদ্যতার সম্পর্ক। কাজেই কাদম্বরী যখন আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন, তখন দুজনের সম্পর্ক নিয়ে নানা গুজব চাউর হতে সময় লাগেনি।
তার ওপরে কাদম্বরীর আত্মহত্যা নিয়ে ঠাকুর পরিবারের অস্বাভাবিক নীরবতা সে গুজবের পালে আরও হাওয়া দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ আর কাদম্বরীর বন্ধুত্ব সে যুগেও যেমন আলোচনার কেন্দ্রে ছিল, এ যুগেও তেমনি মুখরোচক গল্প।
রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠানের প্রকৃত নাম ছিল মাতঙ্গিনী। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, নাট্যকার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী হয়ে শ্বশুরবাড়িতে পা রাখার পর তার নাম পাল্টে রাখা হয় কাদম্বরী।
শ্যামলা গড়নের কাদম্বরী ছিলেন অন্তর্মুখী স্বভাবের। প্রায় সমবয়সি হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল অল্পদিনেই। ঠাকুরবাড়িতে মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ ছিল। সেখানকার অন্দরমহলে রামায়ণ, মহাভারতসহ আধুনিক বইপত্র, পত্রপত্রিকা আসত নিয়মিত। কাদম্বরীকে বই পড়ে শোনাতেন রবীন্দ্রনাথ। সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন দুজনে। কাদম্বরীর সংস্পর্শে এসে আরও ঔজ্জ্বল্য পায় রবীন্দ্রনাথের প্রতিভা।
কিন্তু এত কিছুর মাঝেও বস্তুত ভেতরে ভেতরে কাদম্বরী ছিলেন নিঃসঙ্গ। একে তো ছিলেন নিঃসন্তান, তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অতিরিক্ত কর্মব্যস্ততা আর কাদম্বরীর প্রতি উদাসীনতা। আর রবীন্দ্রনাথও ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন নিজের জগতে।
ঠাকুরবাড়ির অন্য নারীদের সঙ্গেও তেমন অন্তরঙ্গতা ছিল না কাদম্বরীর। সম্ভবত নিঃসন্তান হওয়ার কারণেই সবাই একটু দূরে দূরে রাখত তাকে। কাদম্বরীর বাবা ছিলেন জোড়াসাঁকোর কর্মচারী। বেতনভুক কর্মচারীর মেয়েকে দেবেন্দ্রনাথের প্রতিভাবান ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া সম্ভবত অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। এ কারণেও বোধহয় কাদম্বরী ঠাকুরবাড়ির একাংশের কাছে ছিলেন ব্রাত্য।
স্বামী ও বন্ধুপ্রতিম দেবর যখন নিজেদের জগতে ব্যস্ত, তখন নিঃসঙ্গ কাদম্বরী সময় কাটাতেন বাড়ির তেতলার ছাদে বাগান করে, পশুপাখি পুষে।
স্বর্ণকুমারী দেবীর ছোট মেয়ে উর্মিলাকে খুব স্নেহ করতেন কাদম্বরী। নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছেন তাকে। সেই ঊর্মিলার আকস্মিক মৃত্যুতে আরও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন কাদম্বরী, প্রবল বিষাদ গ্রাস করে তাকে।
চরম একাকিত্ব, জ্যোতিরিন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দূরত্ব কাদম্বরীর আত্মহত্যাপ্রবণ মনকে জাগিয়ে তোলে।
শেষতক আর সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নেন কাদম্বরী। ১৮৮৪ সালের ১৯ এপ্রিল। সেদিন ছিল জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সরোজিনী জাহাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠান। কথা ছিল, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজে এসে নিয়ে যাবেন স্ত্রীকে।
সারা সন্ধে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করলেন কাদম্বরী। কিন্তু কেউ এল না তাকে নিতে। সেদিনের অভিমান আর অতীতের সমস্ত ক্ষোভ, একাকিত্ব, বিষাদের বিস্ফোরণ ঘটল এরপর। ওই দিনই আত্মহত্যার জন্য মাত্রাতিরিক্ত আফিম খান কাদম্বরী। তবে তিনি মারা যান সম্ভবত ২০ বা ২১ এপ্রিল সকালে।
কোনো এক কারণে দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশে সরিয়ে ফেলা হয় কাদম্বরীর আত্মহত্যার সমস্ত চিহ্ন।
শোনা যায়, প্রথা অনুযায়ী কাদম্বরীর মরোদেহ মর্গে পাঠানো হয়নি, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই বসানো হয়েছিল ‘করোনারস কোর্ট’।
কোনো গবেষক মনে করেন, স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথের উদ্যোগেই ডেথ রিপোর্ট লোপ করা হয়। শোনা যায়, একটা সুইসাইড নোটও উদ্ধার হয়েছিল কাদম্বরীর মরদেহের পাশ থেকে। লোপাট করা হয় সেই সুইসাইড নোটও। বাড়িতে আলোচনা করে, ৫২ টাকা ঘুষ দিয়ে সংবাদমাধ্যমের মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়া হয়। তাই কাদম্বরীর মৃত্যুসংবাদ সে সময় কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি। এভাবেই চাপা দেওয়া হয় অভিমানী নতুন বৌঠানের মৃত্যুর প্রকৃত কারণকে।
এর পরই রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরীর সম্পর্ক নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতো। অনেকে বলাবলি করতে থাকে, রবীন্দ্রনাথের দূরে সরে যাওয়াও কাদম্বরীর আত্মহননের অন্যতম কারণ।
শুরুতে রবীন্দ্রনাথের বিয়ের জন্য কনে দেখার ব্যপারে দারুণ উৎসাহ ছিল কাদম্বরীর। কিন্তু পরে হুট করেই যেন তার সব আগ্রহ মিইয়ে যায়। তার এই চুপ করে যাওয়ার কারণ জানা যায়নি। কেউ কেউ বলেন, বিয়ে হলে রবীন্দ্রনাথ তার থেকে দূরে সরে যাবেন, এই চিন্তা কাদম্বরীকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
আর কাদম্বরী মারা যান রবীন্দ্রনাথের বিয়ের কয়েক মাসের মধ্যেই। কারও কারও মতে, তার মৃত্যু আকস্মিক হলেও অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ গবেষকদের মতে, ‘কাদম্বরী ছিলেন প্রচণ্ড ইন্ট্রোভার্ট, সেন্টিমেন্টাল ও স্কিজোফ্রেনিক।’ কাদম্বরী একবার ছাদ থেকে প্রায় পড়তে পড়তে বেঁচে যান। আর তাকে বাঁচিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথই। এসব কারণেও কাদম্বরী আর রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে গুজব আরও ডালপালা ছড়ায়।
রবীন্দ্রনাথ কিন্তু কাদম্বরীকে ভোলেননি। বহু লেখায় নতুন বৌঠানকে স্মরণ করেছেন তিনি। ‘জীবনস্মৃতি’-তেও তাকে নিয়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের।
বইটির ‘মৃত্যুশোক’ অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘ইতিপূর্বে মৃত্যুকে আমি কোনও দিন প্রত্যক্ষ করি নাই। কিন্তু আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়…। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া চলিয়াছে।’
কাদম্বরীর মৃত্যু নিয়ে নানা সময়ে নানা চর্চা হয়েছে। সাহিত্যে, ছবিতে উঠে এই মৃত্যু আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সম্পর্কের প্রসঙ্গ। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘প্রথম আলো’ উপন্যাসে এসেছে প্রসঙ্গটি। এ উপন্যাসে সুনীল লিখেছেন, ‘নতুন বউঠানের অভিমান অতি সাঙ্ঘাতিক। এই অভিমানে তিনি চেঁচামেচি করেন না, কাঁদেন না, তাঁর বিষাদে মগ্ন হয়ে যান। সেই সময় তিনি কথা বলতে চান না কিছুতেই। কিছু দিন আগে এই রকম এক অভিমানের সময় নতুন বউঠান আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন।’
বলা হয়, সত্যজিৎ যখন ‘নষ্টনীড়’ থেকে ‘চারুলতা’ সিনেমা করেন, তখন সেই ছবিতে রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্কের টানাপোড়েন ছাপ ফেলেছিল।
ঋতুপর্ণ ঘোষের তথ্যচিত্র ‘জীবনস্মৃতি’-তেও উঠে এসেছে রবীন্দ্রনাথ-কাদম্বরীর সম্পর্ক। সেখানে কাদম্বরীর চরিত্রে অভিনয় করেন রাইমা সেন। আর সমদর্শী দত্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ভূমিকায়।
কাদম্বরীর মৃত্যুর পর ভীষণ চুপচাপ হয়ে যান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। শেষ জীবন কাটান রাঁচির মোরাবাদ পাহাড়ে। টিবিএস ডেস্ক
তথ্যসূত্র:
- রবিজীবনী (১খণ্ড- ৯ম খণ্ড)—প্রশান্ত কুমার পাল
- ঠাকুরবাড়ির কথা—হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়
- ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল—চিত্রা দেব
- আমার জীবনস্মৃতি—জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর
- রবীন্দ্রজীবনকথা—প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়