প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ
১৯৭১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আমি সরকারি জগন্নাথ কলেজের রসায়ন বিভাগের লেকচারার হিসেবে যোগ দেই। থাকার জন্য নীলক্ষেত আবাসিক এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ষ্টাফ কোয়ার্টারে বাবার বন্ধু নুরুল ইসলাম চাচার বাসায় থাকতাম। চাচা প্রগতিশীল চিন্তা ভাবনায় বিশ্বাসী এবং মওলানা ভাসানীর অনুসারী ছিল। আমরা এই বাসায় থাকার সময় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির অনেক গোপন সভা অনুষ্ঠিত হতো। আমি বাসা থেকে কয়েক মিনিট হেটেই কলাভবনের ছাত্র সমাবেশণ্ডলোতে যোগ দিতে পারতাম।
আমার ছাত্র জীবন শেষ হওয়ার সময় আমি হাজী মুহসিন হল শাখা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলাম। ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত নুতন কমিটি গঠিত হয়নি, এর পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ইতিমধ্যে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন হায়দার আনোয়ার খান জুনো এবং সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান সালু। উনাদের দুই জনই আমাদের নীলক্ষেতের বাসায় সংগঠন সম্পর্কিত বিভিন্ন ণ্ডরুত্বপূর্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনার জন্য প্রায়ই আসতেন। এই জন্য ছাত্র জীবন শেষ হওয়ার পরও অনেকদিন কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।
১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর চারিদিকে যখন উৎসব আর উল্লাস তখন ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ১১ ও ১২ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছিলেন। প্রথম দিনের আলোচনা ছিল ইয়াহিয়া খান- মুজিব একান্ত বৈঠক। ২য় দিনের বৈঠকে শেখ মুজিবের সঙ্গে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজুদ্দিন আহমদ, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ মনসুর আলী এবং এ এইচ কামরুজ্জামান। প্রেসিডেন্টের সহযোগী ছিলেন লে. জেনারেল পীরজাদা এবং পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর ভাইস এডমিরাল আহসান। ঐ সময়ের আলোচনা সফল হয়েছিল বলে গন মাধ্যমকে অবহিত করা হয়েছিল।
এর আগে মওলানা ভাসানী পল্টনের এক বিশাল সমাবেশে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান এবং শেখ মুজিবকে আপোষের পথ পরিহারের আহবান জানান।
আর এই পরিস্থিতিতে আওয়ামী শিবির পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা লাভের আশায় উদগ্রীব এটিই খুবই স্বাভাবিক। তবে মওলানা ভাসানী এবং বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীদের কাছে এই আশা সুদূর পরাহত বলে মনে হয়েছিল। সেই সময় একাত্তুরের ২০ জানুয়ারি, শহীদ আসাদের শাহাদৎ দিবসে, শহীদ আসাদ দিবস উপলক্ষে জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের দাবিতে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন আধা বেলা হরতাল আহবান করে। এটি রাজনৈতিক মহলে বিস্ময় সৃষ্টি করলেও সবাইকে অবাক করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে হরতাল পালিত হয়। এতে জনমনে আপোষের পরিবর্তে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা যে দিন দিনই তীব্র হচ্ছে তার প্রকাশ ঘটে।
১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার আহ্বানে দিবসটি পালন করে। ওদের লিফলেট ছিলো, একাত্তরের একুশের ডাক, “সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের পতাকা উর্ধে তুলিয়া ধরুন, স্বাধীন গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েম করুন।” এই স্লোগান তখন দারুন সাড়া জাগিয়েছিল।
আওয়ামীলীগ জাতীয় সংসদে ভূমিধস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ডাকতে এবং ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। অনেক টাল বাহানার পর ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান করে পরে ৩ মার্চেই তা স্থগিত করা হয়। সারা পূর্ব পাকিস্তান গর্জে উঠে। হরতাল বিক্ষোভ প্রায় প্রতি দিনই চলতে থাকে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের প্রাঙ্গনে সবুজ জমিনে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন আ স ম আবদুর রব। এই অনুষ্ঠানে আমি ও আমার স্ত্রী যোগ দিয়েছিলাম। পর দিন ৩ মার্চ পল্টনের এক ছাত্র-জন সভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন শাহজাহান সিরাজ।
ইয়াহিয়া খানের জাতীয় সংসদ স্থগিতের পরিপ্রেক্ষিতে ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলন আহবান করেন। তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জন সভা আহবান করেন এবং সভা থেকে ণ্ডরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেবেন বলে ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার পর সারা দেশের জনমনে প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিল খুব সম্ভবত বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষনা দিবেন। প্রায় প্রতি দিনই স্বাধীনতার স্লোগানে রাজপথ ও অলিগলি প্রকম্পিত হতে থাকে।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত হলো স্মরনাতীত কালের সবচেয়ে বড় সমাবেশ। সারা দেশ থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমাবেশে যোগ দেয়। শিখা ও আমিও টি এস সি’র সামনে বসে সমাবেশের প্রথম থেকে উপস্থিত থেকে বক্তব্য শুনি। ওই সমাবেশে ডাকসুর ভি পি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। সমাবেশে ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিব সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানকে অবিলম্বে জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহ্বান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের আলটিমেটাম দেন ও অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন। তিনি তাঁর ভাষণ শেষ করেন এই বলে- “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” মহাসমাবেশে শেষে দর্শক শ্রোতারা এই স্লোগানে দিকবিদিক প্রকম্পিত করে সারা দেশ ছড়িয়ে পরে। সমাবেশে উপস্থিত জনতার আশা ছিল বঙ্গবন্ধু ওই দিন স্বাধীনতার সুস্পষ্ট ঘোষণা দেবেন, কিন্ত তা না আসায় অনেকেই হতাশ হন।
এর ২ দিন পর ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে ভাসানী ন্যাপের উদ্যোগে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জন সভায় মওলানা ভাসানী “পূর্ব পাকিস্তানের আজাদী রক্ষা ও মুক্তি-সংগ্রামে ঝাঁপাইয়া পড়ুন” শিরোনামে ১৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। প্রথম দফাটি ছিলো “বিগত ৯ই জানুয়ারি সন্তোষ সম্মেলনে এবং ১০ই জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় ঘোষিত মুক্ত পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার দাবীর প্রতি দ্ব্যর্থহীন সমর্থন।” এতে স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট আহবান ছিলো।
৪র্থ দফা ছিল- “পূর্ব বাংলার সর্বস্তরে সংগ্রাম পরিষদ” গঠন। ১১ নং দফায় “বাঙ্গালী-অবাঙালী, হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাঁধিয়ে গণ সংগ্রামকে বিপথে পরিচালিত করার ষড়যন্ত্রকে প্রতিরোধ করা।”
১৩ নং দফা- “বিদেশী সৈন্য যাতে পূর্ব বাংলার অবতরণ করতে না পারে, তজ্জন্য চট্রগ্রাম ও খুলনার সামুদ্রিক বন্দরণ্ডলোর প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখা”। এই দফায় মওলানা ভাসানী পাকিস্তানী অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদেরকে বিদেশি সৈন্য বলে ঘোষণা করেছেন।
(সূত্র: “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র”, দ্বিতীয় খন্ড, ৭২৩-২৪, মুক্তিযুদ্ধে বামধারা)
৯ মার্চের জনসভা ও ঘোষণাপত্র থেকে ভাসানী অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে সবাইকে অংশগ্রহনের প্রস্তুতি গ্রহণের আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু এর দুইদিন আগের ৭ মার্চের ঐতিহা-সিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেও পাকিস্তানি জান্তার সঙ্গে আলাপ আলোচনার দুয়ার খোলা রেখেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ১৩ মার্চ সাংবাদিকদের বলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসলে তিনি তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। ১৫ মার্চ বেলা আড়াইটায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রধান সেনাপতি জেনারেল আব্দুল হামিদ, পীরজাদা ও ণ্ডলহাসানসহ আরও কয়েকজন জেনারেল। এদের সাথে ছিলেন প্রেসিডেন্টের আইনমন্ত্রী জাস্টিস এ আর কর্ণেলিয়াস, সুপ্রিমকোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি।
১৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী নেতৃবৃন্দের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়। ১৭ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আওয়ামী নেতৃবৃন্দের বিরামহীন বৈঠক চলে ২০ মার্চ পর্যন্ত। কোন আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দেয়া হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে।
এরই মাঝে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ন্যাপ নেতা আব্দুল ওয়ালি খা, মুসলিম লীগের মমতাজ দৌলতানা, জমিয়তে -ওলামার মুফতি মাহমুদ প্রমুখ নেতা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এসে বৈঠক করেন। কিন্ত এ সব আলোচনার বিষয় বস্তু গন-মাধ্যমকে জানানো হয়নি।
আলোচনা চলা কালেই ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ২১ মার্চ এক বিবৃতিতে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে প্রতিরোধ দিবস এবং সর্বত্র স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের আহবান জানায়। এতে অনেকের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়,আলোচনায় কি কাঙ্খিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছেনা! আর অন্য দিকে অনেকেই মনে করেন এটি চাপ প্রয়োগের কৌশল।
২১ মার্চ পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা আসেন। ওই দিনই তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, বঙ্গবন্ধুও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তবে দুই জনই আলাদা আলাদা ভাবে।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া, বঙ্গবন্ধু এবং ভুট্টোর মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর পর ২৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে এক ঘোষণায় বলা হয় যে, ২৫ মার্চ জাতীয় সংসদের যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো তা আবার অনিদির্ষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে, তবে এই স্থগিত বঙ্গবন্ধুর সম্মতিক্রমেই করা হয়েছিল বলে প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে উল্লেখ করা হয়। আবার আওয়ামী লীগ বা শেখ মুজিবের পক্ষ থেকে এই স্থগিতের ঘোষণার কোন প্রতিবাদ করা হয়নি।
২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবনে আওয়ামী লীগের তিনজন নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজুদ্দিন আহমদ ও ড. কামাল হুসেন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তাজুদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে মূলনীতি সংক্রান্ত যে মতৈক্য হয়েছে তারই ভিত্তিতে উপদেষ্টাদের কাছে বিশদ পরিকল্পনা পূর্ণাঙ্গভাবে পেশ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ত্ব এখন এই বিষয়ে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার অপেক্ষা করিতেছেন।
এই অবস্থায় ২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারটায় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী আকস্মিক হামলা শুরু করে। হামলাটি ছিল খুবই পূর্ব পরিকল্পিত। ঢাকার পিলখানা ই পি আর হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল এবং অন্যান্য স্থানে ট্যাংক, কামান, বন্দুক নিয়ে নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাপিয়ে পড়ে হিংস্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ওই দিন বিকেলের পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঢাকা শহর ছাড়তে থাকে। তবে বঙ্গবন্ধুকে পরদিন পাকিস্তানী সেনারা ওনার ৩২ ধানমন্ডি বাসা থেকে গ্রেফতার করে।
আমি ১৭ মার্চ শিখাকে সহ শিবপুর যাই। শিবপুরে তখন মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্য ছাত্র, যুবা ও কৃষকদের সমন্বয়ে এক বিশাল বাহিনী গড়ে উঠেছে। তখনও কোন অস্ত্র সংগ্রহ না হলেও শিবপুরে প্রতিরোধের দৃঢ়তা আমাদেরকে অভিভূত করে। মান্নান আমাকে বলেন, মুজিব- ইয়াহিয়া আলোচনায় কোন ফয়সালা হবেনা, আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি আমাদেরকে শিবপুর চলে আসার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ায় জন্য বলেন। দুই দিন শিবপুর থেকে নেতা কর্মী ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে ঢাকা ফিরে আসি।
এই সময় পূর্ববাংলা কমিউনিস্টদের সমন্বয় কমিটি সব কিছু পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে মুজিব-ইয়াহিয়া আলোচনা মিমাংসাহীন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়ার বিকল্প নেই। সিদ্ধান্ত হয় ২৫ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে এক জন সভা হবে এবং জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার আহ্বান জানান হবে!
জনসভায় শিবপুর, নরসিংদী, সাভার, জয়দেবপুর, কেরানীগঞ্জ থেকে প্রচুর নেতা কর্মী জমায়েত হয়। এই সভাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য টংগী থেকে হাজার হাজার শ্রমিক শোভা যাত্রা নিয়ে আসে। পল্টন এবং আশেপাশের রাস্তা ঘাট লোকে লোকারণ্য। তখনকি কেউ ভাবতে পেরেছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এটিই শেষ প্রকাশ্য জনসভা! সভা চলাকালে প্রচুর বিদেশি সাংবাদিক সভাস্থলে এসে উপস্থিত। এই সময় সভা তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য ন্যাপ নেতা মশিউর রহমান এক বার্তা পাঠান। অন্যদের বক্তৃতা থামিয়ে সভার সভাপতি কাজী জাফর আহমদকে সভাপতির ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তিনি খুব আবেগাপ্লুত বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি এখনই স্বাধীনতার ঘোঘনা প্রদানের আহবান জানান। সন্ধ্যার বেশ আগেই সভা শেষ হয়। সবাইকে দ্রুত যার যার স্থানে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। পরে জানা যায় ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনীর যে ক্র্যাক ডাউনের কথা শোনা যাচ্ছিল, তা এই সভায় আক্রমন করার মাধ্যমে শুরু করার পরিকল্পনা ছিলো। তারা ভেবেছিল এর মাধ্যমে প্রচার করা সহজ হবে যে বিচ্ছিনতাবাদী এবং নকশালপন্থীদের দমনের জন্যই এই অভিযান। ঢাকার বাইরে থাকায় আমি ঐ সভায় উপস্থিত থাকতে পারিনি।
অসহযোগ আন্দোলন চলছে। কলেজসহ সব কিছু বন্ধ। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় পার্টির গোপন মীটিং হয়। এই বাসায় অনেক সময়ই মোস্তফা জামাল হায়দার, জুনো ভাই, সালু ভাই আসতেন। সমন্বয় কমিটির এক শীর্ষ নেতা সুনীল ণ্ডহ তখন এই বাসায় আন্ডারগ্রাউন্ড (গোপনে লুকিয়ে) থাকে। আগেই উল্লেখ করেছি মার্চের মাঝা মাঝি শিবপুর গেলাম ২/৩ দিনের জন্য। ওখানে আমাদের দলের নেতা কর্মীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাত ও আলাপ আলোচনা হলো। সবার বিশ্বাস ইয়াহিয়া খান কিছুতেই ক্ষমতা ছাড়বেনা, সবাইকে জনগনতান্ত্রিক স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।
ঢাকা ফিরে আসার পর শিখা বললো চলো ৩/৪ দিন বরিশাল ঘুরে আসি, অনেক দিন বরিশাল যাইনা। ২৫ মার্চ সভার আগে ফিরে আসবো। ইতিমধ্যে শিখার বড় বোন, মিনু আপা তার শিশু সন্তান তানভীরকে নিয়ে বরিশাল বেড়াতে গেছে। আমরা ২১ মার্চ রাতের লঞ্চে বরিশাল যাই। আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ আর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে করতে তিন দিন দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। ২৪ মার্চ রাতে ঢাকা ফেরার জন্য লঞ্চে কেবিন রিজার্ভ করি, পরে মিনু আপার অনুরোধে এক সাথে আসার জন্য ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ফেরার জন্য আমরা কেবিন রিজার্ভ করি। সন্ধ্যা ৭ টায় লঞ্চ ছাড়ার কথা। ওদের বাসা থেকে লঞ্চ ঘাট যেতে ৫/৭ মিনিট লাগে। রিঙ্া ডাকা হলো, ওই সময় শিশু তানভীর হঠাৎ করে জোরে জোরে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পরে, ওকে কিছুতেই থামানো যাচ্ছিলনা। সবাই বললো এই অবস্থায় কিছুতেই যাওয়া ঠিক হবেনা, একজনকে লঞ্চ ঘাটে পাঠিয়ে রিজার্বেশন বাতিল করা হলো। রাত সাড়ে সাতটার দিকে অর্থাৎ লঞ্চ ছেড়ে যাওয়ার আধঘন্টা পর শিশুটি কান্না থামিয়ে শান্ত হয়ে গেল। সবাই অবাক, ওর হঠাৎ করে এই অস্বাভাবিক ভাবে অসুস্থ হওয়ার কোন হেতু খুঁজে পাচ্ছিলনা।
রাতের খাবারের পর কিছুক্ষন গল্পণ্ডজব করে ঘুমাতে যাই। ভোর চারটার দিকে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলে দেখি ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে মুন্সী দুলাভাই দরজায় দাঁড়িয়ে। তিনি আমাদেরকে বরিশালে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। একটু শান্ত হওয়ার পর বললেন, ইতিমধ্যেই ঢাকার অবস্থা খুব সম্ভবত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিকেলের দিকেই শেখ মুজিব বুঝতে পারেন ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে চলমান সংলাপ ব্যর্থ হচ্ছে, তাই তিনি আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ঢাকা ছেড়ে নিরাপদ আশ্রযে যাওয়ার এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। মুন্সী দুলাভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা আব্দুর রাজ্জাক। তিনি তাকে বার্তাটি পৌঁছে দিয়ে অবিলম্বে ঢাকা ছাড়ার কথা বলেন। মুন্সি দুলাভাই কোন ক্রমে বরিশালগামী রাতের শেষ লঞ্চে করে ঢাকা ছেড়ে আসতে সক্ষম হন।
রেডিও অন করি। বি বি সি, আকাশবাণী ও অন্যান্য মিডিয়ায় ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর আসতে লাগলো। পরদিনই খবর পাই আমাদের যে লঞ্চে বরিশাল থেকে ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল সেটি মুন্সীগঞ্জ পার হওয়ার পরই হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর গানবোটের গোলাণ্ডলির শিকার হয়, যাত্রীদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানা যাচ্ছিলনা! তানভীর যদি ঐ সময় ও ভাবে কান্নাকাটি না করতো, তা হলে আমাদের কি অবস্থা হতো, তা ভাবতেও শরীর শিউরে ওঠে। আমরা সত্যি অলৌকিক ভাবে এক মহা দুর্যোগ থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম। সবই মহান আল্লাহর রহমত।
বরিশালে শিখাদের বাসা সদর রোডে টেলিগ্রাম অফিসের লাগোয়া বাড়ি। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় আমার শ্বশুর টেলিগ্রাম অফিস থেকে একটি টেলিগ্রাম নিয়ে আসেন। এই বার্তায় চট্রগ্রাম থেকে আওয়ামীলীগ নেতা আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন উল্লেখ করে সবাইকে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার আহবান জানান। অবশ্য এর আগেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়া প্রথমে নিজে এবং পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। জিয়াউর রহমানের ঘোষণা একটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতিকে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। সারা দেশেই শুরু হলো প্রতিরোধ সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ।
বরিশালে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হলো! ছাত্র-যুবারা হানাদার বাহিনী মোকাবেলার জন্য ট্রেনিং ও প্রস্তুতি নিচ্ছে। কেউ কেউ বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আমার শ্যালক শহিদুল হক শামীম বুয়েটের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই বরিশাল চলে আসে। দিনের বেলাতো বটেই বেশ রাত পর্যন্ত ঘরের বাইরে থাকে। মাঝে মাঝে আমার সাথে বোমা তৈরির রসায়ন নিয়ে আলাপ আলোচনা করে।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর যুদ্ধ বিমান সময় সময় বরিশালের আকাশে চক্কর দিয়ে যায়। সবাই আশংকা করছে যে কোন দিন শহর আক্রান্ত হতে পারে। আপাতত নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য শিখাদের নানা বাড়ী কলশকাঠি যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সবাই যেতে আগ্রহী, আমার আব্বা শ্বশুর বাসায় থেকে যেতে চাইলেন আর শামীমও আরো কিছুদিন পর আসবে বলে জানায়। শিখাদের এবং ওর খালা খালুর পরিবার সহ আমরা সবাই একটি বিরাট পানশী নৌকায় করে ওদের নানা বাড়ি কলশকাঠির ক্ষুদ্রকাঠি গ্রামে পৌঁছি। তখনও নদী পথে ওই অঞ্চলে যাতায়ত মোটামুটি নিরাপদ ছিলো।
কয়েকদিনের মধ্যেই খবর আসে বোমা প্রস্তুতির সময় আমার শ্যালক শামীম মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে, সাথে থাকা তার বন্ধু আনোয়ার নিহত হয়েছে। আনোয়ারই মুক্তিযুদ্ধের সময় বরিশালে প্রথম শহীদ ছাত্র নেতা।
এই আলোচনা থেকে স্পষ্টভাবে বুঝা যায় পাকিস্তানী জান্তার অভিপ্রায় নিয়ে আওয়ামী নেতৃত্ব দোদুল্যতায় ভুগলেও আপোষহীন জননেতা মওলানা ভাসানী, পূর্ববাংলা কমিউনিস্টদের সমন্বয় কমিটি, কাজী জাফরের নেতৃত্বের পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন এবং পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন সব সময়ই বিশ্বাস করতেন এই অঞ্চলের জনগণের মুক্তি আপোষ আলোচনায় সমাধান হবেনা, এ জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের কোন বিকল্প নেই। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তাদের এই মূল্যায়নই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়।
প্রফেসর জসীম উদ্দিন আহমদ, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, সাভার, ঢাকা, বাংলাদেশ