জমে উঠেছে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। পৌষের শীত উপেক্ষা করে চলছে জমজমাট প্রচার প্রচারণা। চায়ের দোকান থেকে অফিস- আদালত সবখানেই আলোচনায় এখন ভোট। ভোটারদের মনে নানা প্রশ্ন। কে জিতবে? কে হারবে? ভোট দিতে পারবে তো? এমন নানা হিসাবনিকাশ নিয়েই চলছে তুমুল আলোচনা। সিটির ২৭টি ওয়ার্ডেই প্রায় একই অবস্থা। দম ফেলছেন না প্রার্থীরাও। চষে বেড়াচ্ছেন নগরীর অলিগলি।
দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন ভোটারদের। দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। বসে নেই কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরাও। মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের সমর্থনে নগরীর পাড়া-মহল্লার অলিগলি ও বিভিন্ন সড়কে চলছে মাইকিং। লিফলেট বিলিসহ করছেন গণসংযোগ, পথসভা ও উঠান বৈঠক। মেয়র প্রার্থীরা একে অপরের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি অভিযোগও তুলছেন। যার ফলে নির্বাচন নিয়ে শুরু হয়েছে টানটান উত্তেজনা। নির্বাচনের আর হাতেগোনা কয়েকদিন বাকি থাকলেও পরিবেশ অনেকটা শান্তিপূর্ণ। যদিও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রশাসনের পক্ষপাতের অভিযোগ তুলেছেন।
নাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৭ জন প্রার্থী। তবে মূল লড়াইটা হবে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের মধ্যে। আইভী আগে দুইবার সিটি মেয়র পদে জিতেছেন। ২০১১ সালে ভোটের আগের দিন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন তৈমূর আলম খন্দকার। যদিও তিনি অভিযোগ করেছেন, ওইদিন নির্বাচন থেকে স্বেচ্ছায় তিনি সরে দাঁড়াননি। তবে এবার দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। নির্বাচনে অংশ নেয়ার কারণে তাকে দলীয় পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এদিকে নৌকার প্রার্থী আইভীর পক্ষে মাঠে রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা। আর হাতি প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা তৈমূরের পক্ষেও মাঠে রয়েছেন স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতারা।
না থেকেও আলোচনায় শামীম ওসমান: নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের সঙ্গে সেলিনা হায়াৎ আইভীর ‘দ্বন্দ্ব’ দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায়। কিন্তু সিটি নির্বাচন এলেই বিষয়টি উঠে আসে শিরোনামে। নির্বাচনে অংশ না নিয়েও আলোচনায় থাকেন শামীম ওসমান। নির্বাচনের শুরুতে আইভী-শামীম ওসমানের বিষয়টি ‘ভাই’-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও শেষতক প্রার্থী আইভীর মুখে ‘গডফাদার শামীম ওসমান’ উচ্চারিত হওয়ার পর অনেকে মনে করেছে বিষয়টি নতুন করে মোড় নিয়েছে। আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে এখনো কোনো প্রকাশ্য মন্তব্য করেননি। কিন্তু সেলিনা হায়াৎ আইভী শিবিরের লোকজন মনে করেন নির্বাচনে আইভীর পক্ষে কাজ করছেন না শামীম ওসমানের কর্মী সমর্থকরা। সার্বিক বিষয়ে আজ শামীম ওসমান তার অবস্থান পরিষ্কার করবেন। ওদিকে দুই নেতার এমন দ্বন্দ্বের মধ্যেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা চষে বেড়াচ্ছেন পুরো নারায়ণগঞ্জ। কেন্দ্রীয় নেতাদের আনাগোনা থাকলেও স্থানীয় অনেক নেতাকর্মী দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নেই বলে আইভী শিবির থেকেই অভিযোগ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় জেলা ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করা হয়েছে। সর্বশেষ কমিটির নেতাদের বাসায় পুলিশি তল্লাশিরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত শনিবার নগরীর ২৪ নং ওয়ার্ডের দেউলী চৌরাপাড়া এলাকায় গণসংযোগকালে তৈমূর আলমকে শামীম ওসমানের প্রার্থী বলে মন্তব্য করেন আইভী। এ সময় আইভী শামীম ওসমানকে ‘গডফাদার’ বলেও সম্বোধন করেন। আইভী বলেন, তৈমূর আলম খন্দকার গডফাদার শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের প্রার্থী। উনি বিএনপি’র প্রার্থী না, স্বতন্ত্র প্রার্থী না, তিনি ওসমান পরিবারের প্রার্থী। এদিকে গত শুক্রবার তৈমূর আলমের পক্ষে গণসংযোগে অংশ নেন জাতীয় পার্টি (জাপা) সমর্থিত চার চেয়ারম্যান। এরা সবাই নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রার্থী সেলিম ওসমানের (শামীম ওসমানের বড় ভাই) ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
এদিকে নির্বাচনে আইভীর পক্ষে কাজ করতে প্রশাসনিকভাবে চাপ দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন মহানগর ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ। তার অভিযোগ, গত শনিবার দিবাগত রাতে তার বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। পরে তারা নৌকার পক্ষে কাজ করার জন্য চাপ দেন। এর আগে ওইদিন মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। কমিটির নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন না।
আইভী দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর আলম অবশ্য দল নিয়ে ভাবছেন না। দলের পদ থেকে তাকে সরিয়ে দেয়ায় বিএনপি বড় কোনো নেতা প্রকাশ্যে আর তার প্রচার প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন না। স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়েই তিনি চষে বেড়াচ্ছেন পুরো এলাকা।
এমন অবস্থায় ভোটাররাও কষছেন নানা হিসাবনিকাশ। নগরীর প্রায় শতাধিক ভোটারের সঙ্গে কথা বলেছে মানবজমিন-এর এই প্রতিবেদক। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার এইসব ভোটার বলছেন, এবারের নির্বাচনে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সময় এসেছে। পাশাপাশি অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটেরও আশা করছেন তারা।
নগরীর ১১ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মকবুল হোসেন। পেশায় চা দোকানি। ১৫ বছর ধরে নগরীর কিলারপুল এলাকায় ব্যবসা করছেন তিনি। মকবুল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আমার পূর্ব পুরুষরা এই শহরের বাসিন্দা। আমার বেড়ে ওঠাও এই শহরে। গত দুই নির্বাচন আমার চোখের সামনেই হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমি গত নির্বাচনে ভোট দিতে পারিনি। সকাল এগারোটার সময় শুনেছি সবার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। তবে এবারের নির্বাচনের চিত্রটা ভিন্ন মনে হচ্ছে। ভোট যদি সুষ্ঠু হয় তাহলে নৌকা ও হাতির মধ্যে জমজমাট লড়াই হবে।
শহরের মু?ক্তিনগর এলাকার সানোয়ার হো?সেন ও সা?লেনগর এলাকার কাইয়ুম মিয়া বলেন, সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকেই আমরা ভোট দেবো। যিনি সুখে-দুঃখে সব সময় সাধারণ মানুষের পাশে থাকবেন।
পোস্টারে ছেয়ে গেছে নগরী
আগামী ১৬ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নাসিক নির্বাচনে আইভী-তৈমূরসহ মোট ৭ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। অন্যরা হ?লেন- খেলাফত মজলিসের প্রার্থী এবিএম সিরাজুল মামুন (দেয়াল ঘড়ি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা মোহাম্মদ মাছুম বিল্লাহ (হাত পাখা), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন (বটগাছ), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির প্রার্থী মোহাম্মদ রাশেদ ফেরদৌস (হাতঘড়ি) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল ইসলাম বাবু (ঘোড়া)। এ ছাড়া সি?টি কর?পো?রেশ?নের ২৭টি সাধারণ ওয়া?র্ডে এবং ৯টি সংর?ক্ষিত নারী ওয়া?র্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে ৩৪ জন নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন। তবে নগরীতে বেশির ভাগ স্থানে ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর নৌকা ও এডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারের হাতি মার্কার পোস্টার চোখে পড়েছে। এ ছাড়া সাধারণ কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীদের পোস্টারে ছেয়ে গেছে পুরো নগরী। বিশেষ করে নগরীর রাস্তাঘাট, আনাচে-কানাচে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের পোস্টার ঝুলছে। এ ছাড়াও অনেক প্রার্থী তার পক্ষে ছোট ছোট আকারে ছাপানো লিফলেটও ঝুলিয়েছেন।
টানা দুই মেয়াদে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছেন সেলিনা হায়াৎ আইভী। ২০১১ সালে প্রথম সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪৮ ভোট পেয়েছিলেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের শামীম ওসমান পেয়েছিলেন ৭৮ হাজার ৭০৫ ভোট। এরপর ২০১৬ সালে নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিএনপি’র মেয়র প্রার্থী সাখাওয়াত হোসেনকে ৭৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন আইভী।