ডা: আলী জাহান ১. এ প্রতিবেদন যখন পত্রিকার পাতায় আসবে তখন তিনি কানাডার পথে অথবা কানাডায় পৌঁছে গেছেন। পত্র-পত্রিকার ভাষ্যমতে, আমাদের এ ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর ০৯.১২.২১ তারিখ বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিমানবন্দরে কোনো বাধা ছাড়াই কানাডার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া বিমানে আরোহণ করেছেন।
২. ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর শব্দটি আমি দিইনি। বাংলাদেশের প্রাক্তন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী, পরবর্তীকালে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডাক্তার মুরাদ হাসান নিজেই একাধিক অনুষ্ঠানে দাবি করেছেন যে, তিনি নিজেই একটি ব্র্যান্ড। আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করুন মাননীয় ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। খুব নির্ঝঞ্ঝাটভাবে আপনার দ্বিতীয় বাড়ি কানাডাতে পৌঁছাবেন বলে আশা করি। বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুসারে কানাডায় ইতিমধ্যে আপনার বাড়ি কেনা হয়ে গেছে। ওখানে এখন আপনি শুধু পদধূলি দিয়ে কানাডার মাটিকে ধন্য করবেন।
কানাডায় অবস্থানকারী আপনার ভক্তরা আপনাকে বরণ করার জন্য কি প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন? প্রিয় ভক্তবৃন্দ, আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আমাদের এই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের বিপদে আপনারা তার পাশে দাঁড়িয়েছেন। জাতি আপনাদের এই ত্যাগের কথা মনে রাখবে।
৩. বাংলা স্টাইলের নির্বাচনে নির্বাচিত এ এমপিকে কি নামে সম্বোধন করলে তিনি প্রীত হবেন? ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করার কারণে ডাক্তার টাইটেল? কোমর দুলিয়ে নাচ-গান করার কারণে রকস্টার টাইটেল? মসজিদের মিম্বরে ইমাম সাহেবদের জন্য সংরক্ষিত স্থানে বসে মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বয়ান করার কারণে খতিব টাইটেল? ওয়াজ মাহফিলে প্রধান বক্তা হওয়ার কারণে আল্লামা টাইটেল (হালিমা আনোয়ারা হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার ১৮.১২.২১ তারিখের বার্ষিক ওয়াজ মাহফিলের প্রধান অতিথি জনাব মুরাদ হোসেন)? সিনেমার নায়ক নায়িকাদের কার চেহারা এবং অভিনয় কেমন সে নিয়ে নসিহত করার কারণে চলচ্চিত্র সমালোচক টাইটেল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরা রাতে হোটেলে রাত কাটায় এমন মন্তব্য করার জন্য উনাকে কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক উপাধি? একই অঙ্গে এতো রূপ?
৪. এই ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরকে সমালোচকরা আরো কিছু টাইটেল দেয়ার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু প্রকাশের অযোগ্য সে টাইটেলগুলো আমি এখানে উল্লেখ করতে পারছি না। নিজের রুচিতে বাধছে এবং পত্রিকার সম্পাদক হয়তো তা ছাপাতে চাইবেন না। অবশ্য টাইটেল উল্লেখ করা না গেলেও কেন তাকে সে টাইটেল দেয়া যেতে পারে তা নিয়ে কিছু ইশারা ইঙ্গিত করা যায়।
৫.বাংলাদেশের নষ্ট রাজনীতি এবং সমাজ এ ধরনের অনেক ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর তৈরি করেছে। তাদের কথা এবং কার্যক্রমে দেখে বা শুনে কখনোই মনে হবে না যে জনগণের ট্যাক্সে তাদের জীবন চলে। তাদের মুখে যা আসে তাই বলছেন। যা ইচ্ছে তাই করছেন। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় নিজের নামে হাসপাতাল থেকে শুরু করে ব্রিজ, স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি রাস্তার নামও রাখছেন। জনগণের টাকা নিয়ে জনগণকে কিছু ফেরত দিচ্ছেন কিন্তু নাম দিচ্ছেন ‘আমি দিয়েছি, আমি দিচ্ছি’। এ ‘আমি’ আসলো কোত্থেকে? কেউ কখনো এ প্রশ্ন করেছেন? বাংলাদেশে জমিদারতন্ত্র কখন ফিরে আসলো? প্রজাদের এই প্রশ্ন করার সাহস নেই?
৬. যেমনটা প্রশ্ন করার সাহস হয়নি ডাক্তার মুরাদ হাসানকে। প্রকাশ্য জনসভায় তিনি বেশ কয়েকবার বলেছেন যে, তিনি যখন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করতেন তখন বিরোধী দলের সমর্থক ছাত্র ছাত্রীদের পিটিয়ে শুধু কলেজ নয় বরং এলাকা ছাড়া করেছেন। প্রকাশ্যে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন যে, তিনি মানুষ পিটিয়েছেন। সে বক্তব্য শুনে উনার সামনে বসা শ্রোতারা কি করেছেন? হাততালি দিয়েছেন। উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। ফলশ্রুতিতে মন্ত্রীমহোদয় দ্বিগুণ উৎসাহে আরো ভয়াবহ মন্তব্য করেছেন।মানুষ পিটিয়ে কি আইন ভঙ্গ হয়েছে? বাংলাদেশে মানুষ পেটানো কি অপরাধ? যদি অপরাধ হয়েই থাকে তাহলে বাংলাদেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কি এ বহুরূপী মানুষকে তার এই অপরাধ স্বীকার করার পরেও কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন? মামলা করেছেন? তাকে সতর্ক করা হয়েছে? সতর্ক করা হয়নি বলেই তিনি তার বেফাঁস মন্তব্যের গতি বাড়িয়ে দিয়েছেন। কথার ধরন দেখে মনে হয়েছে উনি অজেয়। নায়িকা কান্ডের অডিও বের না হওয়া পর্যন্ত ভক্ত এবং সমর্থকরা তাকে সমর্থন করেছেন এবং এগিয়ে যেতে সাহস যুগিয়েছেন।
৭. এ ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর তার অনিয়ন্ত্রিত কথাবার্তা এবং ব্যবহারের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়াকে গরম রেখেছেন। অপরাধ স্বীকার করা ছাড়াও অধীনস্থ এবং সিনিয়র লোকজনকে তুই-তোকারি করা, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের চরিত্র হনন করা, তাদের সন্তানদের নিয়ে অশ্লীল কথাবার্তা বলা, প্রকাশ্যে প্রকাশ অযোগ্য গালাগালি করার কারণে তার মন্ত্রীত্ব চলে গেছে? উত্তর হচ্ছে, না। বাংলাদেশের সমাজ এবং সংস্কৃতি হঠাৎ করে এতো ভদ্র হয়ে যায়নি। নেতা-নেত্রীদের মুখ থেকে অশ্লীল কথাবার্তা শুনতে শুনতে মানুষজন অভ্যস্ত হয়ে গেছে।ক্ষমতার কেন্দ্রে এবং আশেপাশে যারা আছেন তারা কি এসব ভাষা ব্যবহারে পারদর্শী নন? তাহলে এ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তির মন্ত্রিত্ব কেন গেল?
৮. বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ০৮.১২.২১ তারিখের একটি রিপোর্টে মন্ত্রিত্ব চলে যাবার কারণ উল্লেখ করেছে। সে রিপোর্ট অনুসারে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সাথে অশ্লীল ফোনালাপ ফাঁস হবার কারণেই তার মন্ত্রিত্ব চলে যায়। আমরা ধারণা করতে পারি যে, চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সাথে তার অশ্লীল কথাবার্তার অডিও রেকর্ড মিডিয়ায় না আসলে তিনি তার পদে বহাল থাকতেন এবং তার সাগরেদ এবং ভক্তদের বিনোদন দিয়েই যেতেন।
৯. সরকারি সংস্থা বিটিআরসি আমাদের এই অলরাউন্ডার প্রাক্তন মন্ত্রীর ২৭২ টি অশ্লীল ভিডিও চিহ্নিত করেছে। আদালতের আদেশ পাবার পর বেশ কিছু ইতিমধ্যে মুছে দেয়া হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে যে, ২৭২ টি ভিডিও কি একদিনে বা এক সপ্তাহ হয়েছে? মন্ত্রিত্ব যাবার আগে পুলিশ বা গোয়েন্দা বিভাগ কি এসবের খবর জানতো না? মন্ত্রিত্ব যাবার আগ পর্যন্ত এই ২৭২ টি ভিডিও কি অশ্লীল ভিডিও ছিল না? তখন কেন এ ভিডিও গুলোর ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করা হয়নি? মোদ্দা কথা হলো যে, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আপনার সবকিছু হালাল!
১০. প্রকাশ্য জনসভায় (অতীতে) বিরোধীমতের নেতা কর্মীকে পিটিয়েছেন এমন স্বীকারোক্তি কি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে? ২৭২ টি অশ্লীল ভিডিও যার নামের সঙ্গে জড়িত তিনি কি মন্ত্রীর আসনে বসে এসব ভিডিও করার মাধ্যমে অপরাধ করেছেন?একজন চিত্র নায়িকাকে ধর্ষণের ইচ্ছে প্রকাশ এবং সরকারি বাহিনী দিয়ে তুলে নিয়ে আসার হুমকি কি বাংলা আইনে অপরাধ? লন্ডন প্রবাসী ব্যারিস্টার জাইমা রহমান, বিরোধীদলের নেতা নেত্রীদের নামে ভাষায় প্রকাশের অযোগ্য অশ্লীল শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে উনি হয়তো কোনো অপরাধ সংগঠিত করেননি! যদি করে থাকেন তাহলে তো উনার মন্ত্রিত্ব অনেক আগেই চলে যাওয়ার কথা ছিল। পুলিশ কেইস হবার কথা ছিল। যেহেতু এসবের কিছুই আগে ঘটেনি তাই আমাদের এই অলরাউন্ডারের এসব কার্যক্রম অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না বলেই আমি ধারণা করে নিচ্ছি।
১১. এই ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বৃহস্পতিবার (০৯.১২.২) এক অনুষ্ঠানে জানালেন যে, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডাক্তার মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই দিনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন যে, মুরাদ বিদেশে যাবেন কিনা তা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এ ব্যাপারে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। সরকার তার কথা রেখেছে। ডাক্তার মুরাদ নির্বিঘ্নে কানাডার উদ্দেশ্যে উড়াল দিয়েছেন।
১২. প্রশ্ন হচ্ছে যে, ডাক্তার মুরাদ হাসানের কৃত অপরাধের কী হবে? উনি কি আসলেই অপরাধ সংঘটিত করেছেন? উনার কথা এবং কার্যক্রম যদি অপরাধের সংজ্ঞায় না পড়ে তাহলে একই অভিযোগ অন্যের ক্ষেত্রে কেন অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে?পরিকল্পনা মন্ত্রীর বক্তব্য যদি সত্য ধরে নেই তাহলে কি কানাডা থেকে ডাক্তার মুরাদ হাসানকে বাংলাদেশের এনে তদন্ত এবং বিচার কার্য সম্পাদন করা হবে? অপরাধের তদন্ত হচ্ছে এমন ব্যক্তিকে কি বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার বিধান আছে? যদি থেকে থাকে তাহলে একই আইন অন্যের ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর করা উচিত।
১৩. ডাক্তার মুরাদ হাসানের নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া দেখে যা মনে হচ্ছে তা হচ্ছে যে তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তাই তাকে বাংলাদেশের পুলিশ-আদালতের মুখোমুখি হতে হবে না। সেজন্য কানাডা মিশনে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করেনি।
১৪. রাজা যখন হাতি-ঘোড়া নিয়ে শিকারে বের হন তখন হাতি-ঘোড়ার পায়ের নিচে পড়ে পিঁপড়া, পোকামাকড় মারা গেলে তাকে যেমন কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না, তেমনি ডাক্তার মুরাদের ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবিশ্বাস্য নীরবতা দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে পোকামাকড়ের মতো জীবন নিয়ে যারা বেঁচে আছেন তাদের জীবন এবং মান-সম্মানের কোনো গুরুত্ব নেই। পোকামাকড়ের কোনো অনুভূতি থাকতে নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে তাদের সেই অনুভূতি বোঝার জন্য ক্ষমতার শীর্ষে এবং আশেপাশে যারা আছেন তারা প্রস্তুত নন।
ডা: আলী জাহান
কনসালটেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, যুক্তরাজ্য
এবং সাবেক পুলিশ সার্জন (যুক্তরাজ্য পুলিশ)