গোপেন দেব, মন্ট্রিয়ল কানাডা
দেয়ালে কি সত্যি পিঠ ঠেকে গেছে ? – স্বত:স্ফুর্ত প্রতিবাদী জনস্রোত দেখে তা’ মনে না হওয়ার কোনো কারণ ছিল না মন্ট্রিয়ল প্রবাসী হিন্দু কমিউনিটির। মন্ট্রিয়ল ডাউন টাউনের একটি ব্যস্ত সড়ক ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’র সংক্ষুব্দ গণ-উচ্চারণে মুখরিত হয়ে ওঠেছিল এক রবিবারের সারাটাদিন।পাঁচ বছরের শিশু থেকে পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ নেমেছিলেন সেই গণমিছিলে।কানাডায় জন্ম নেয়া ও বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের এতো বেশি উপস্থিতি আগে কখনও দেখা যায়নি।বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বারবার অবর্ণনীয় নির্যাতনের খবরে প্রবাসের নতুন প্রজন্মও এবার হতবাক, বিক্ষুব্দ। তারা পুরো সমাবেশটি প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যায়।
’মৌমিতা দশ বছরের মেয়ে। হাতে ফেস্টুন।সারিবদ্ধ হয়ে হাঁটছে বাবামা,ভাইয়ের সাথে। সাথে পরিচিত অপরিচিত বহু মানুষ। অনেক বন্ধুবান্ধবও। বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা, নির্যাতনের প্রতিবাদ করে লিখা ফেস্টুন, প্লে কার্ডের দিকে বারবার সে তাঁকায়, তাঁকায় সড়ক দিয়ে হেঁটে যাওয়া কানাডার মূল ধারার মানুষ। সেখানে লেখা ‘স্টপ অ্যাটাক হিন্দুজ ইন বাংলাদেশ’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’….।সে অবাক হয় বাবামার জন্মভূমির প্রিয় দেশটির এই অবস্থা দেখে! মৌমিতার জন্ম কানাডায়।কদিন থেকেই দেখছে ওর বাবামার চোখেমুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ।দেশে বাবামার বাড়ির পাশেই মৌলবাদী মুসলমানরা হামলা করে হিন্দু মন্দির, বাড়িঘর তছনছ করে দিয়েছে, মারধর করে সর্বস্ব লুটে নিয়েছে।বাবামা এখন বাংলাদেশে রেখে আসা স্বজনদের নিয়ে অনেক চিন্তিত।এখানের মূলধারার মিডিয়াগুলোতে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর খবর দেখে মৌমিতার মতো নতুন প্রজন্মের অনেকেই এসেছে এই প্রতিবাদ পদযাত্রায়।তারাও তাদের বাবামার মতো বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিয়ে চিন্তিত, চিন্তিত বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও। পদযাত্রায় আসা শিশুকিশোর, যুব বৃদ্ধ প্রতিটি মানুষের মাঝেই একই চিন্তারেখা সুস্পষ্ট।
বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বারবার নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। একটি ঘটনারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির খবর নেই। সম্প্রতি হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন, হ্ত্যা, ধর্ষন এবং মন্দির, পূজা মন্ডপ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ব্যাপকতায় বিশ্বের সকল প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক লোক শুধু হতাশই নয়, বিক্ষুব্দও। ২৪ অক্টোবর রবিবার দুপুরে মন্ট্রিয়লে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সমাবেশটি এই ক্ষোভেরই বহি:প্রকাশ ছিল।
মন্ট্রিয়লের এটওয়াটার মেট্রো সংলগ্ন পার্কে প্রথমে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।সেখানে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা বাংলাদেশে সংঘটিত এসব ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রাখে।
এরপর ডাউন টাউনের সড়ক ধরে গগনবিদারী শ্লোগানে প্রকম্পিত বিশাল গণমিছিলটি গি কনকর্ডিয়া মেট্রো স্টেশনের কাছে আবারও সমাবেশে মিলিত হয়। মিছিলকারীরা নানারকম শ্লোগান সম্বলিত প্লে কার্ড, ফেস্টুন, ব্যানার নিয়ে সড়ক প্রদক্ষিণ করে। আগের রাতে বাসায় শিশুকিশোরদের অনেকেই সমাবেশে আনার জন্যে নিজ হাতে ছবি আঁকে, প্লে কার্ড তৈরি করে। মিছিলটি মূল ধারার মানুষদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারাও বাংলাদেশের ঘটনায় নিন্দা ও মিছিলকারীদের দাবীর প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন। এই বিক্ষোভ কর্মসূচিতে প্রবাসী বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান কমিউনিটি ছাড়াও বিভিন্ন দল ও সংগঠনের কয়েকজন নেতা এবং মুসলিম কমিউনিটির প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। সমাবেশের খবর মূল ধারার মিডিয়ায়ও স্থান পায়। বাংলাদেশ হিন্দু কমিউনিটি অব মন্ট্রিয়ল, কুইবেকের ব্যানারে অনুষ্ঠিত সমাবেশ ও বিক্ষোভ পদযাত্রাটি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ এডভোকেট ফনিন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য্যের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের দাবার গুটি বানিয়ে খেলা হচ্ছে। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার ও মর্যাদা দিতে হবে। মিথ্যা অজুহাতে বারবার সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন, মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নিরীহ মানুষদের হত্যা, ধর্ষণের ঘটনা কোনো ভাবেই আর মেনে নেয়া যায় না। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এবং অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে পরিচিত আওয়ামীলীগের শাসনামলে সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তার দাবীতে বারবার রাস্তায় নামতে হবে তা’ ভাবতেও কষ্ট হয়। তিনি আর দেরী না করে দেশকে বাঁচাতে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনাকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসার আহবান জানান। সমাবেশে উপস্থিত সবাই অবিলম্বে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রত্যেকটি ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার এবং ধর্ম বর্ণ জাতি নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিতের জোর দাবী জানান। তাঁরা কানাডা সরকারের কাছেও বিষয়টি উত্থাপনেরও সিদ্ধান্ত নেন। প্রায় তিন ঘন্টা ব্যাপী এই কর্মসূচিটি সর্বাত্মক সফল করে তোলার লক্ষ্যে সহযোগিতাপ্রদানকারী সকলের প্রতি উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। সমাবেশে একই দাবীতে অচিরেই নতুন কর্মসূচি দেয়ারও ঘোষণা দেয়া হয়।