লিখেছেন মোয়াজ্জম হোসেন তোহা
আফ্রিকার উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর সময় প্রতি বছর মৃত্যু ঘটে হাজার হাজার মানুষের। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যুবরণকারী অভিবাসীর সংখ্যা ছিল অন্তত ২,৩০০। এ সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই আরো অনেক বেশি হতে পারত, যদি না জার্মানীর পিয়া ক্লেম্পের মতো কিছু স্বেচ্ছাসেবী ক্যাপ্টেন নিজেদের জাহাজে করে ডুবন্ত নৌকা থেকে অভিবাসীদেরকে উদ্ধার করার কাজে নিয়োজিত থাকতেন।
ইউভেন্তা নামে যে উদ্ধারকারী জাহাজটিতে পিয়া ক্লেম্প ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তার ক্রুরা এ পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরের ডুবন্ত নৌকাগুলো থেকে প্রায় ১৪,০০০ মানুষকে উদ্ধার করেছে। পিয়া ক্লেম্প নিজে সরাসরি জড়িত ছিলেন প্রায় ৬,০০০ মানুষকে উদ্ধার করার কাজে। কিন্তু ইতালির চরম ডানপন্থী সরকারের অভিবাসন বিরোধী কঠোর আইনের শিকার হয়ে সেই পিয়া ক্লেম্পই এখন মুখোমুখি হচ্ছেন ২০ বছরের কারাদন্ডের সম্ভাবনার।
৩৫ বছর বয়সী পিয়া ক্লেম্প একজন জার্মান জীববিজ্ঞানী। জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর প্রথমে তিনি ডুবুরিদের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। সে সময়ই তিনি লক্ষ্য করেন, অতিরিক্ত দূষণ এবং নিয়ন্ত্রণহীনভাবে মাছ ধরার ফলে সাগরের জলজ প্রাণীসমূহ অস্তিত্ব সংকটে পড়ছে। ফলে তিনি Sea Shepherd নামে একটি আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক প্রাণী সংরক্ষণ সংস্থায় যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি নিজেই Aquascope নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন, যারা অবৈধ মৎস স্বীকারের বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে।
কিন্তু এই দুই পরিচয়ের বাইরে পিয়া ক্লেম্পের মূল পরিচয় ভূমধ্যসাগরে নিয়োজিত উদ্ধারকারী জাহাজের একজন ক্যাপ্টেন হিসেবে। তিনি ছিলেন Sea Watch নামক এনজিওর সদস্য, যারা ভূমধ্যসাগরে ডুবন্ত নৌকাগুলো থেকে অভিবাসীদেরকে উদ্ধার করার জন্য কাজ করে। সি ওয়াচের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে পিয়া বিভিন্ন সময় ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করে কখনো তাদেরকে পৌঁছে দিয়েছেন ইতালির ল্যাম্পাদুসা দ্বীপে, কখনো তাদেরকে হস্তান্তর করেছেন ইতালিয়ান কোস্ট গার্ড বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিলিটারি শিপের কাছে।
আফ্রিকার উত্তর উপকূলের বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষ করে লিবিয়া থেকে কাঠের বা প্লাস্টিকের যেসব নৌকায় করে অভিবাসীরা ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে, সেগুলোর অনেকগুলোরই ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য থাকে না। ফলে মাঝপথেই নৌকাগুলো ডুবতে শুরু করে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত এ ধরনের নৌকাডুবিতে ভূমধ্যসাগরে নিহত হয়েছে অন্তত ১২,০০০ মানুষ। জাতিসংঘ লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার এ সমুদ্রপথকে বিশ্বে সবচেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্রপথ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
ডুবন্ত অভিবাসীদেরকে উদ্ধার করার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০১৫ সাল থেকে অপারেশন সোফিয়ার আওতায় অনুসন্ধান এবং উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছিল। প্রথম এক বছরেই অপারেশন সোফিয়া অন্তত ১৩,০০০ মানুষকে উদ্ধার করেছিল। উদ্ধার করার পর প্রথমদিকে এদের অধিকাংশেরই স্থান হতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইতালিতে। ফলে ইতালি শুরু থেকেই এ ধরনের উদ্ধার তৎপরতার কঠোর সমালোচনা করে আসছিল।
ইতালির ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী লুইজি ডি মাইও উদ্ধারকারী জাহাজগুলোকে ট্যাক্সির সাথে তুলনা করে বলেন, অভিবাসীরা বিপদগ্রস্ত না হলেও জাহাজগুলো তাদেরকে তুলে ইতালিতে পৌঁছে দেয়। অন্যদিকে দেশটির অপর ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাটিও স্যালভিনি এ ধরনের উদ্ধারকারী সংস্থাগুলোকে মানব পাচারকারী মাফিয়া হিসেবে অভিযুক্ত করেন। তাদের উভয়ের অভিযোগ, উদ্ধারকারী জাহাজের উপস্থিতির কারণেই মানুষ বেশি করে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের এই অভিযোগ সত্য হলেও যে বিপুল সংখ্যক মানুষ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধ এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যে ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, তাদের তুলনায় সুযোগসন্ধানী অভিবাসীর সংখ্যা অনেক কম। ম্যাটিও ভিয়া নামে ইতালিয়ান এক গবেষক ইতালিয়ান কোস্টগার্ড থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রমাণ করেন, ভূমধ্যসাগরে অবস্থানকারী উদ্ধারকারী জাহাজের সংখ্যার সাথে ইউরোপে পৌঁছতে চাওয়া অভিবাসীর সংখ্যার কোনো পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক নেই।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ইতালির চাপেই মূলত ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের উদ্ধার কার্যক্রম সংকুচিত করে আনে। অন্যদিকে ইতালি লিবিয়ার প্রশিক্ষণবিহীন কোস্টগার্ডকে এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা মিলিশিয়াদেরকে অর্থায়ন করতে শুরু করে, যেন তারা অভিবাসীদের নৌকাগুলোকে লিবিয়ায় ফিরিয়ে নেয়। ইতালির এসকল পদক্ষেপে ইউরোপে পৌঁছানো অভিবাসীর সংখ্যা এবং সেই সাথে সাগরে ডুবে মৃত্যুর সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় হ্রাস পেলেও আনুপাতিক হারে মৃত্যুর পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের হিসেব অনুযায়ী, ২০১৭ সালে যেখানে প্রতি ৩৮ জন নিরাপদে পৌঁছানো অভিবাসীর বিপরীতে একজন করে অভিবাসীর মৃত্যু ঘটেছিল, সেখানে ২০১৮ সালে প্রতি ১৪ জনের নিরাপদ যাত্রার বিপরীতে মৃত্যুবরণ করে একজন। অর্থাৎ আনুপাতিক হারে মৃত্যু বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় তিনগুণ। এছাড়াও এই এক বছরে যে হাজার দশেক অভিবাসী লিবিয়ান কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ে লিবিয়াতে ফেরত গেছে, তাদের অনেকের ভাগ্যেও নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ।
এরকম পরিস্থিতিতে অভিবাসীদের জীবন বাঁচানোর লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছিলেন পিয়া ক্লেম্পের মতো স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকর্মীরা। একদিকে যখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের কার্যক্রম সীমিত করে এনেছিল, অন্যদিকে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোও উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় অভিবাসীদের নৌকা এড়িয়ে চলছিল, তখন এই উদ্ধারকর্মীরাই ছিল অভিবাসীদের শেষ ভরসা। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারের দক্ষিণ ইউরোপের আঞ্চলিক প্রতিনিধি রোল্যান্ড শিলিংয়ের মতে, এই এনজিও জাহাজগুলো না থাকলে নিশ্চিতভাবেই মৃত্যুর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পেত।
অন্য অনেক স্বেচ্ছাসেবী উদ্ধারকারীর মতোই পিয়া ক্লেম্পও ২০১৭ সালের গ্রীষ্মকালীন সময়ে অভিবাসীদেরকে উদ্ধার করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। সে সময় তিনি ইউভেন্তা নামে একটি উদ্ধারকারী জাহাজের ক্যাপ্টেন হিসেবে দুটি মিশন পরিচালনা করেছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে ইউভেন্তা একদিনেই ৩,৮০০ মানুষকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু উদ্ধার করা অভিবাসীদেরকে তিনি যখন ইতালিতে পৌঁছে দিতে যান, তখন ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষ ইউভেন্তাকে আটক করে এবং ইতালির উপকূলে জাহাজ চালানোর ব্যাপারে তার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে।
ইতালি তার এবং তার নয় সহকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, তারা অভিবাসীদেরকে ইতালিতে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে অবৈধ অভিবাসনকে উৎসাহিত করছেন। ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষ দাবি করে, তাদের কাছে প্রমাণ আছে যে, পিয়া ক্লেম্প এবং তার সহকর্মীরা স্মাগলারদের সাথে একত্রে কাজ করছেন। অবশ্য দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চার্জ গঠন করেনি।
তবে ২০১৮ সালে ইতালিতে চরম ডানপন্থী সরকার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে পিয়া ক্লেম্পের বিরুদ্ধে ইতালির অবস্থানে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। গত বছর ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাটিও স্যালভিনি ইতালির আইন ভঙ্গ করার দায়ে পিয়া ক্লেম্পকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানান। সম্প্রতি পিয়ার আইনজীবিদেরকে জানানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে ইতালি যে চার্জ গঠন করতে যাচ্ছে, তাতে দোষী সাব্যস্ত হলে তার সর্বোচ্চ ২০ বছরের কারাদন্ড হতে পারে এবং সেই সাথে প্রতি অভিবাসীকে ইতালিতে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাকে ১৫,০০০ ইউরো করে জরিমানা করা হতে পারে।
এ বছরের জুন মাসে ইতালি আরেকটি নতুন আইন পাস করেছে, যাতে যেকোনো উদ্ধারকারী জাহাজ ইতালির জলসীমায় প্রবেশ করলে কিংবা ইতালির কোনো সমুদ্র বন্দরে ভেড়ার চেষ্টা করলে তাকে ৫০,০০০ ইউরো জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইতালির এ ধরনের পদক্ষেপের তীব্র সমালোচনা করেছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সমুদ্রে জীবন রক্ষা করার মানবিক বাধ্যবাধকতা আছে। কোনো জাহাজকে বা ক্যাপ্টেনকে এর জন্য শাস্তি দেয়া উচিত না।
পিয়া ক্লেম্পের ব্যাপারেও সোচ্চার হয়েছে অনেকে। আন্তার্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার বিরুদ্ধে অভিযোগকে বিপজ্জনক নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইতালিয়ান ডক্টর্স উইদাউট বর্ডার্সের সভাপতি ক্লডিয়া লোডেসানি উদ্ধারকারী জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জরিমানা করাকে তুলনা করেছেন রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে জরিমানা করার সাথে। অন্যদিকে পিয়া ক্লেম্পকে মানবতাবাদী কর্মী হিসেবে উল্লেখ করে তার মুক্তির জন্য চেঞ্জ ডট অর্গে একটি পিটিশন চালু করেছেন তার ভক্তরা। গত তিন সপ্তাহে এতে স্বাক্ষর করেছে প্রায় পৌনে তিন লাখ মানুষ।
পিয়া ক্লেম্প জানিয়েছেন, তিনি কোনোভাবেই মানুষকে উদ্ধার করার প্রতিদান হিসেবে ২০ বছরের কারাদন্ড মেনে নেবেন না। প্রয়োজনে তিনি ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত পর্যন্ত যাবেন। তিনি অভিযোগ করেন, ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম্যাটিও স্যালভানি, সাবেক অস্ট্রিয়ান চ্যান্সেলর সেবাস্টিয়ান কার্জ এবং জার্মান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হর্স্ট সীহফারের মতো লোকরঞ্জনবাদী নেতাদের কঠোর অবস্থানের কারণেই প্রতি বছর ভূমধ্যসাগরে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।
তিনি জানান, তার একটাই আফসোস, নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য মামলার প্রস্তুতি হিসেবে যে কয়েক লাখ ডলার এখন তাকে খরচ করতে হবে, তিনি যদি মুক্ত থাকতেন, তাহলে সেই টাকাটা ব্যয় করতে পারতেন আরো কিছু মৃত্যুপথযাত্রী অভিবাসীকে উদ্ধার করার কাজে।