ওয়েছ খছরু, ১৯৮৯ সালে বৈধভাবেই আমেরিকা গিয়েছিলেন সিলেটের লোকমান উদ্দিন। মিশিগান রাজ্যে একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন তিনি। ওই সময় রেস্টুরেন্টের মালিকের স্ত্রী খুন হন। ‘নির্দোষ’ হওয়ার পরও ওই রেস্টুরেন্টে কর্মরত লোকমান উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বিচারে দেয়া হয় ২৫ বছরের সাজা। এতে করে লোকমান উদ্দিনের জীবন এলোমেলো হয়ে যায়। তখন ইংরেজি ভাষা ভালো বুঝতেন না। কারাবন্দি জীবন সঙ্গী হয় লোকমানের।২৫ বছরের সাজা ভোগার পর যখন তিনি মুক্ত হলেন তখন এক অন্য লোকমান তিনি। বাংলা বুঝেন না, বাংলায় কথাও বলতেন না। ইংরেজিতেই কথা বলেন। তবে- মুক্ত হওয়ার পরই লোকমান আমেরিকাতেই আবেদন জানান দেশে ফেরার। এ কারণে তাকে একটি ‘আউটপাস’ হাতে দিয়ে এক সপ্তাহ আগেই পাঠিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশে। দেশে এলেও তার কাছে সবকিছুই অপরিচিত। ২৫ বছরের কারাভোগে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। গোয়াইনঘাটের ফতেহপুরে নিজের বাড়ি, সিলেটের কাজলশাহ এলাকার বোন দিলারা বেগমের বাসা সব কিছুই ভুলে যান। কেবল সিলেটের জিন্দাবাজারের বনফুল নামটি তার স্মৃতিতে ছিল। ৩২ বছর আগে ওই বনফুলে চাকরি করতো তার বোনের জামাই। ঢাকায় নেমে বিদেশযাত্রীর গাড়িতে করে তিনি শুক্রবার দুপুরে সিলেটে ফিরেন। সিলেটে ফিরে ইংরেজিতেই কথা বলতে থাকেন। বনফুল-২ তে যাবেন বলে জানান। কিন্তু ঠিকানা বলতে পারেননি। পরে একজন তাকে নগরীর সুবহানীঘাট এলাকার বনফুলে নিয়ে যান। সেখানে যাওয়ার পর তারা জানায়, ৩২ বছর আগে বনফুল-২ ছিল নগরীর জিন্দাবাজারে। বর্তমানে এটি রিফাত অ্যান্ড কোং। বিকাল ৩টার দিকে তিনি জিন্দাবাজারের সহির প্লাজাস্থল রিফাত অ্যান্ড কোং-তে আসেন। সেখানে আসার পর লোকমান উদ্দিনের ভাষা কেউ বুঝেন না। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হন ওই কোম্পানির সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা মাহফুজুল হাসান তান্না। তিনি এসে ইংরেজিতেই কথা বলেন লোকমান উদ্দিনের সঙ্গে। সব তথ্য জানার পর তিনি খোঁজ নেন ওখানে ৩২ বছর আগে বনফুল-২ ছিল কিনা। মালিক পক্ষের কাছ থেকে খবর নিয়ে জানতে পারেন সত্যতা। এরপর থেকে তান্না নিজ উদ্যোগই শুরু করেন খোঁজখবর। খুঁজতে খুঁজতে তিনি পেয়ে যান লোকমানের ছোট বোন দিলারা বেগমকে। অসুস্থ সন্তানকে নিয়ে একটি হাসপাতালে ছিলেন দিলারা বেগম। ভাইয়ের খবর শুনেই তিনি স্বজনদের নিয়ে ছুটে আসেন জিন্দাবাজারের রিফাতে। সেখানে আসার পর ভাই লোকমান উদ্দিনের আউটপাসের তথ্য ও বোনের এনআইডি কার্ড যাচাইয়ের পর নিশ্চিত হওয়া যায় লোকমান ও দিলারা ভাইবোন। এ ছাড়া ৩২ বছর পর প্রথম সাক্ষাতে ভাইকে চিনতে পারেন দিলারাও। আর আমেরিকাফেরত লোকমানও বোন সহ স্বজনদের চিনতে পারেন। ভাইকে দেখে কেঁদে ফেলেন দিলারা বেগম। কেঁদে কেঁদে জড়িয়ে ধরেন। স্বজনদের পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন লোকমান উদ্দিনও। বলেন- ‘এটাই তার জীবনের সেরা প্রাপ্তি।’ পরে স্বজনরা তাকে নিয়ে নগরীর কাজলশাহ এলাকার বাসায় চলে যান। স্বজনদের খোঁজার সময় লোকমান উদ্দিন জানিয়েছেন- ‘তার স্মৃতিতে সবকিছু হারিয়ে গেছে। তিনি কেবল সিলেট বনফুল-২ নামটি মনে রেখেছেন। এ ছাড়া স্মৃতিতে গ্যাসফিল্ড, ফতেহপুর গ্রাম মনে আছে। কিন্তু তিনি ঠাহর করতে পারছেন না। এ ছাড়া দীর্ঘ ২৫ বছর কারাগারে থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। যোগাযোগের কোনো মাধ্যম ছিল না।’ তিনি জানান, ‘মিশিগানে কর্মরত অবস্থায় তিনি ইংরেজি ভালো বুঝতে না পারায় খুনের দোষ তার ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এরপর কারাগারেই কেটেছে দীর্ঘ জীবন। তিনি এখনো মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বলে জানান।’ এদিকে লোকমানের স্বজনদের খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে নিজের ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন মাহফুজ হাসান তান্না। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন- ‘দীর্ঘ ৩২ বছর আমেরিকা ছিলেন লোকমান আহমাদ। উনি যে রেস্টুরেন্টে কাজে ছিলেন সে রেস্টুরেন্টের মালিক তার স্ত্রীর খুনের দায় লোকমান সাহেবের উপর চাপিয়ে দেয় আর ইংরেজি না জানার কারণে তিনি এর প্রতিবাদও করতে পারেননি। প্রায় ২৫ বছরের জেল হয়। দীর্ঘ ৩২ বছর পর দেশে এসে ঠিকানা, বাড়িঘর- এমন কি ঠিক মতো বাংলায় কথা করতে পারেন না। শুধু ইংলিশে কথা বলেন। রিফাত অ্যান্ড কোং জিন্দাবাজার শাখায় এসে ৩০ বছর আগে বনফুল ছিল বলে লোকটি ম্যানেজার সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে থাকে। সেই সময় আমি হাজির হই। হাজির হওয়ার পর ম্যানেজার সাহেব সহ আমরা সবাই অনেক খোঁজাখুঁজি করে লোকমান সাহেবের ছোট বোনকে ফোন করি। ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসেন। আহ্ আসার পর সেই দৃশ্য মোবাইলে ধারণ করি। আসলে আল্লাহ যদি চান সবকিছুই সম্ভব। পরিবারের মিলন দেখে নিজের চোখে পানি চলে আসলো।’ তান্না গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন- ‘লোকমান উদ্দিনের মূল বাড়ি গোয়াইনঘাটের ফতেহপুর ইউনিয়নে। তার বোনের বাসা কাজল শাহ এলাকায়। ওই সময় বোনের জামাই বনফুল-২ তে ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ কারণে লোকমান উদ্দিনের স্মৃতিতে বনফুল-২ ছিল। আমি বিষয়টি জানার পর প্রায় দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে বোন দিলারার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করি। এরপর বোন এসে ভাইকে চিনে ফেলেন।’ তিনি জানান, ‘লোকমান উদ্দিন নির্দোষ ছিলেন। তাকে কারান্তরীণ করার পর থেকে বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি। কিংবা তার খবরও কেউ নেয়নি। এ কারণে ২৫ বছরের কারা জীবনে তার স্মৃতিই পাল্টে গেছে। এমনকি বাংলায় কথা বলাও ভুলে গেছেন। এখন লোকমান উদ্দিন তার স্বজনদের পেয়ে খুশি হয়েছেন। দেখে মনে হচ্ছে তিনি যেন দ্বিতীয় জীবন লাভ করেছেন।’