ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন, তার পরিবারের সদস্য এবং বন্ধু-বান্ধব, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের একাউন্টে রেখেছেন কোটি কোটি টাকা। তার বেনামী একাউন্টে শত শত কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অনুসন্ধানের বর্তমান পর্যায়ে আদালতের অনুমোদন সাপেক্ষে সাঈদ খোকন এবং তার পরিবার সদস্যের ৮টি একাউন্ট জব্দ করেছে সংস্থাটি।
গতকাল সোমবার ঢাকার সিনিয়র স্পেশাল জজ কে এম ইমরুল কায়েস একাউন্ট জব্দের আদেশ দেন। দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক জালালউদ্দিন আহমেদ এ আবেদন জানান। দুদক সূত্র জানায়, সাঈদ খোকন, তার স্ত্রী ফারহানা আলম, বোন শাহানা হানিফ ও মা ফাতেমা হানিফের ৮টি ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেন আদালত।
জব্দকৃত অ্যাকাউন্টের মধ্যে সাঈদ খোকনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৩টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এছাড়া তার মা ফাতেমা হানিফের একটি, বোন শাহানা হানিফের দু’টি ও স্ত্রী ফারহানা আলমের দু’টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা তার আবেদনে বলেন, ওই ব্যাংক হিসাবগুলোতে অস্বাভাবিক পরিমাণ অর্থ লেনদেন করা হয়েছে। অভিযোগটি সুষ্ঠু তদন্তের প্রয়োজনে ব্যাংক হিসাবগুলো থেকে যেন অর্থ উত্তোলন, স্থানান্তর বা হস্তান্তর করা না যায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে ব্যাংক হিসাবগুলো জরুরি ভিত্তিতে অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন। আবেদনে জালাল আহমেদ আরও বলেন, অভিযুক্তরা ওই ব্যাংক হিসাবের অর্থ স্থানান্তর করতে চেষ্টা করেছেন যা অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। অভিযোগ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উক্ত অস্থাবর সম্পত্তি স্থানান্তর বা হস্তান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হবে।
এর আগে সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে মেয়র থাকাকালে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিষয়টির অনুসন্ধানে নেমে তার দুই সহকারি একান্ত সচিবে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। তারা হলেন এপিএস আবুল কালাম আজাদ এবং আব্দুল কুদ্দুস। চলতি বছর ১০ ফেব্রুয়ারি আবুল কালাম আজাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় তার বিরুদ্ধে সাঈদ খোকনের দুর্নীতিতে সহযোগিতা করা ছাড়াও অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো কারবারের সঙ্গে সম্পৃক্তার স্বীকারোক্তি মিলেছে।
চলতি বছর ২১ জানুয়ারি জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এপিএস শেখ আব্দুল কুদ্দুসকে। তিনিও সাঈদ খোকনের দুর্নীতির বিষয়ে ব্যাপক তথ্য দেন। সাঈদ খোকন বিভিন্ন সময় বাল্যবন্ধু ভুট্টো, পরিমল ও অতুলের মাধ্যমে এক্সিম ব্যাংক পল্টন শাখা থেকে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা নগদ উত্তোলন করে নেন। পুরান ঢাকার আলু বাজারের শিট ব্যবসায়ী মো. নাসিমের নামে বেসরকারি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টেও রয়েছে সাঈদ খোকনের কোটি কোটি টাকা। এটিও সাবেক মেয়রেরই বেনামী একাউন্ট। এই একাউন্টে রয়েছে কোটি কোটি টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন।
এভাবে ২০১৫ সালের ২১ জুন থেকে ২০১৯ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে লোক মারফত চার দফা নগদ ও ৪২টি চেকের মাধ্যমে ৩৪ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার ৫৭৫ টাকা তুলে নেয়া হয়। এ অর্থ সাঈদ খোকনেরই বেনামি অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর হয়।
দুদক সূত্র জানায়, ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র থাকাকালে সাঈদ খোকন ব্যাপক ভিত্তিক দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন তিনটি মার্কেটে দোকান নির্মাণের ঠিকাদারি প্রদান, দোকান বরাদ্দ, বিদেশ ভ্রমণসহ নানা সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে তিনি দুর্নীতি করেন। চলতি বছর মার্চ মাসে একজন ব্যবসায়ীর দায়েরকৃত মামলার পরিপ্রেক্ষিতে উদঘাটিত হয় সাঈদ খোকনের ‘ঘুষ কেলেঙ্কারি’। ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন দিলু আদালতে এ মামলা করেন। মামলায় সাঈদ খোকন কমপক্ষে ১০০ কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন-মর্মে উল্লেখ করা হয়।
শত কোটি টাকার মধ্যে অন্তত ৩৫ কোটি টাকা লেনদেন হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে। কোটি কোটি টাকার চেক, পে-অর্ডারে রূপান্তরের মাধ্যমে বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাব নম্বরে এ অর্থ স্থানান্তর হয়। সাঈদ খোকন তার অনুগত বিশ্বস্ত প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারের মাধ্যমে এই লেনদেন করতেন। বিনিময়ে ইউসুফ আলী সরদারও কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
চাকরিচ্যুত এই রাজস্ব কর্মকর্তার ‘সেকেন্ড হোম’ রয়েছে কানাডায়। ইউসুফ আলী সরদারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুদক। তার স্ত্রী রাশিদা আক্তার (পাসপোর্ট নং-বিকে-০৪৬৪৩৩৩), মেয়ে ইশরাত ইয়াসমিন ইরা (পাসপোর্ট নম্বর বিকে-০৪৬৪৯৬০) বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। তাদের বিষয়েও পৃথক অনুসন্ধান চালাচ্ছে দুদক।
দেলোয়ার হোসেন দেলু নিজেও সাঈদ খোকনকে ঘুষ দিয়েছেন বলে স্বীকারোক্তি রয়েছে এজাহারে। ঘুষ দিয়েও কাজ না পাওয়ায় তিনি মামলা করতে বাধ্য হন। এজাহারে উল্লেখ করা হয়, অর্থের বিনিময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তিনটি মার্কেটে অবৈধভাবে ৯১১টি দোকান তৈরি করেন দেলোয়ার হোসেন দিলু ও তার সহযোগিরা।
এসব দোকান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মাঝে বরাদ্দ দিয়ে অন্তত ১৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন দিলু নিজেও। এর অন্তত ১০০ কোটি টাকা সাঈদ খোকনের পকেটস্থ হয়। ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস মার্কেটে অবৈধভাবে নির্মিত দোকান ভাঙার নির্দেশ দিলে বরাদ্দ পাওয়া দোকান মালিকদের চাপের মুখে পড়েন দেলোয়ার। সে থেকে বাঁচতে তিনি সাঈদ খোকনের বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে হাতিয়ে নেয়ার মামলা করেন।
দিলু দাবি করেন, তিনি ১০০ কোটি টাকার বেশি সাঈদ খোকনকে দিয়েছেন। খোকন ২০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে এককালীন ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষ নিয়েছেন। দিলুর মালিকানাধীন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের (হৃদি কনস্ট্রাকশন) বিল ছাড় করাতেও সাঈদ খোকনকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন-মর্মে দাবি করেন। ১৩ কোটি টাকার একটি বিল ছাড় করাতে ৪ কোটি টাকা ঘুষ দেয়ারও দৃষ্টান্ত রয়েছে তার।
দুদক সূত্র জানায়, রাজধানীর ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত নগর প্লাজা, সিটি সুপার মার্কেট ও জাকির সুপার মার্কেটের মালিক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। পর্যায়ক্রমে নির্মাণ শেষে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কাছে দোকানগুলোর পজেশন বিক্রি করা হয়। এর বাইরেও বিভিন্ন প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তথ্য রয়েছে দুদকের হাতে।
অনুসন্ধানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে, দুদকের উপ-পরিচালক জালালউদ্দিন আহমেদ বিষয়টি ‘অনুসন্ধানাধীন’ বলে কোনো তথ্য প্রদানে অস্বীকৃতি জানান।