কানাডা থেকে জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) প্রক্রিয়ায় তিনটি নতুন উড়োজাহাজ কিনতে গত বছরের ১ আগস্ট চুক্তি করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। তবে বিনা দরপত্রে উড়োজাহাজ কেনায় বাদ সাধেন নেগোসিয়েশন কমিটির এক সদস্য। কাজ এগিয়ে নিতে পরিবর্তন আনা হয় সেই কমিটিতে। এখন সরাসরি উড়োজাহাজ কেনায় সবাই ঐকমত্যে পৌঁছায় আটঘাট বেঁধে নেমেছে বিমান কর্তৃপক্ষ। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের মে থেকে জুনের মধ্যেই ড্যাশ৮-কিউ ৪০০এনজি মডেলের এয়ারক্রাফটগুলো বিমান বহরে যোগ হওয়ার কথা। আর এগুলো কেনা হচ্ছে কানাডার প্রতিষ্ঠান বোমবারডিয়ার ইনকের মাধ্যমে। এখন তাদের সক্ষমতা যাচাই চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, ‘উড়োজাহাজ তিনটি কেনা হচ্ছে কানাডা থেকে। আগামী বছরের মে থেকে জুনের মধ্যে এগুলো ডেলিভারি দেবে। এগুলো বহরে যোগ হলে বিমানের যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আরও বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘উড়োজাহাজ কেনার অর্থ জোগাড়ে সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে বিমানের চুক্তি হবে। এটির খসড়া ভেটিংয়ের জন্য পাঠানো হয়েছে লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে। এর পর উড়োজাহাজের প্রি-শিপমেন্ট বাবদ টাকা পাঠানো হবে।’
জানা গেছে, এর আগে বোয়িং কেনার সময় ডেলিভারি পেমেন্ট বাবদ স্বল্পসুদে ঋণ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল কানাডীয় প্রতিষ্ঠান মারিয়ানা প্রাইভেট লিমিটেড। পরবর্তীতে তারা পিছু হটায় বিপাকে পড়ে বিমান। পরিস্থিতি সামাল দিতে তাৎক্ষণিক নিজস্ব উৎস এবং অন্যান্য ব্যাংকের সহায়তা নিতে বাধ্য হয়েছিল সংস্থাটি। তাই এবার কানাডার ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান কানাডিয়ান কমার্শিয়াল করপোরেশনের (সিসিসি) আর্থিক সক্ষমতা যাচাইয়ে বেশি জোর দিয়েছিল বিমান কর্তৃপক্ষ। ফলে ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল প্রস্তাব পাওয়ার পরও তা চূড়ান্ত করতে অনেক সময় পার হয়ে যায়।
আবার উড়োজাহাজের মূল্য নির্ধারিত না হওয়ায় চুক্তি করা যাচ্ছিল না। তা ছাড়া জিটুজি পদ্ধতি হওয়ায় আর্থিক সম্ভাব্যতা যাচাইসহ নানা বিবেচনায় কর্মকর্তাদের মধ্যে একমত হতেও সময় লাগে। কানাডার পাঠানো প্রস্তাব অনুযায়ী উড়োজাহাজের মূল্যের প্রায় ৮০ শতাংশ টাকা দেবে কানাডা সরকারের একটি ফিন্যান্সিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স এজেন্সি ‘এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট কানাডা (ইডিসি)’।
এদিকে উড়োজাহাজ তিনটির দাম নির্ধারণ নিয়েও জটিলতা ছিল। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি উড়োজাহাজের নিট মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে ২২ দশমিক ৪২২ মিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে উড়োজাহাজ তিনটির মোট মূল্য দাঁড়ায় ৬৭ দশমিক ২৬৬ মিলিয়ন ডলার। অবশ্য এ দর উড়োজাহাজ সরবরাহের সময়ে অ্যাসকালেশন ফ্যাক্টর (ধাপে ধাপে বৃদ্ধি) অনুযায়ী পুনর্নির্ধারিত হবে। চলে চিঠি চালাচালি। নেগোসিয়েশন কমিটির সভায় উড়োজাহাজের দাম নির্ধারিত না হওয়ায় চুক্তি করা সম্ভব হচ্ছিল না।
অর্থ বিভাগের একজন প্রতিনিধি এ প্রক্রিয়ায় উড়োজাহাজ কেনার ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ২ নভেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে নেগোসিয়েশন কমিটিতে পরিবর্তন এনে বিমান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে (বিমান) আহ্বায়ক করা হয়। আবারও দফায় দফায় চিঠি চালাচালির পর ২১ দশমিক ৫৯৭ ডলার হিসাবে প্রতিটি উড়োজাহাজের দাম নির্ধারণের কথা বলা হয় কানাডীয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে। নেগোসিয়েশন কমিটিকে কানাডীয় প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়- বাংলাদেশ বিমানকে উড়োজাহাজের যে মূল্য প্রস্তাব করা হয়েছে, এর চেয়ে কম মূল্যে ‘বাংলাদেশি’ এয়ারলাইন্সকে তিন বছরের মধ্যে প্রস্তাব করা হবে না। তা করলে উভয় মূল্যের পার্থক্য বিমানকে ফেরত দেওয়া হবে।
এর পর গত বছরের ১ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বিমান কর্তৃপক্ষ উড়োজাহাজ তিনটি কেনার চুক্তি করে। সে অনুযায়ী, উড়োজাহাজগুলোর ক্রয়মূল্য ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রতি বছর ২ শতাংশ বর্ধিত হারে ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সালে ডেলিভারির সময় ২৪ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। আর তিনটির দাম দাঁড়াবে ৭২ মিলিয়ন ডলার। তা ছাড়া ক্রয়মূল্যের সমপরিমাণ ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে এককালীন ঋণের ফিসহ প্রয়োজনীয় ঋণের পরিমাণ হবে প্রায় ৮০ মিলিয়ন ডলার।
চুক্তি অনুযায়ী, তিনটি উড়োজাহাজ এবং একটি স্পেয়ার ইঞ্জিন ও একটি স্পেয়ার এপিইউর (অক্সিলিয়ারি পাওয়ার ইউনিট) ডেলিভারি করা হবে ২০২০ সালের মধ্যে। গত ২৩ সেপ্টেম্বর বিমানের বোর্ডসভায় অনুমোদন পায় সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণের প্রস্তাবটি। ডেলিভারি ফাইন্যান্সিংয়ের জন্য ১০ বছর মেয়াদি ঋণ এবং সুদের হার তিন মাসের লাইবর পিরিয়ডের সঙ্গে ১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়। এ ঋণের রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টি দিতে গত ২৮ মে নীতিগত সম্মতি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ও। এ ক্ষেত্রে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হতে যাওয়া খসড়া চুক্তির ওপর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং দরকার। তাই খসড়া প্রস্তাবটি লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগে পাঠানোর জন্য বিমানের পক্ষ থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
এদিকে প্রথমে উড়োজাহাজ সরবরাহের কথা ছিল ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর এবং ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এখন তা এগিয়ে করা হয়েছে আগামী বছরের মার্চ, মে ও জুন।