‘দ্য সিস্টেম হ্যাজ কলাপ্সড’: ইন্ডিয়া’স ডিসেন্ট ইন্টু কোভিড হেল। ভারতে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে লন্ডনের প্রভাবশালী অনলাইন দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত খবরের শিরোনাম এটা। এর অর্থ- ভারতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কোভিড-নরকে পৌঁছে যাচ্ছে ভারত। খবরের এই শিরোনামই বলে দিচ্ছে কি ভয়াবহ অবস্থা বিরাজ করছে সেখানে। এতে বলা হয়েছে ভারত অপ্রত্যাশিত হারে এক ট্রাজেডিতে পৌঁছে গেছে। মাত্র এক সপ্তাহে সেখানে কমপক্ষে ১৬ লাখ মানুষ নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মাত্র ১২ দিনের মধ্যে করোনা আক্রান্তের হার দ্বিগুন হয়ে শতকরা ১৭ ভাগে দাঁড়িয়েছে।এরই মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে রোববার তিনজন প্রার্থী মারা গেছেন করোনা আক্রান্ত হয়ে। ফ্রন্টলাইনে দায়িত্ব পালনরত চিকিৎসকরা ভেঙে পড়েছেন। তারা বলছেন, প্লাবনের মতো মারা যাচ্ছেন করোনায় আক্রান্তরা। হাসপাতালে বেড সঙ্কট, রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের অপর্যাপ্ত প্রস্তুতির কারণে প্রতিদিন বাড়ছে মৃত্যু এবং আক্রান্তের সংখ্যা। এমন অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে অনেক ডাক্তার কাঁদছেন। শ্মশান বা কবরস্তানে মৃতের মিছিল। বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ, গুজরাট ও নয়া দিল্লিতে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এসব স্থানে লাশের দাফন বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের আগেই দ্রুততার সঙ্গে গিয়ে উপস্থিত হচ্ছে আরো লাশ। অনেক শ্মশান বা কবরস্থানে স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে পড়েছে। নিহতের পরিবার, আত্মীয়-স্বজন তাদের প্রিয়জনের শেষকৃত্যের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করছেন। রোববার দিল্লির সবচেয়ে বড় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের স্থান নিগামবোধ ঘাটে স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। সেখানে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পাদনের ‘ফ্যুনারেল পাইরেস’ বা অন্ত্যেস্টিক্রিয়ার চুল্লি দ্বিগুন বাড়িয়ে ৬০-এর উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপরও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে সারাদেশে সক্ষমতার শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে হাসপাতালগুলো। এ সময়ে যারা বেডের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন তার মধ্যে বেশির ভাগই যুব শ্রেণির। শুধু দিল্লিতে শতকরা ৬৫ ভাগ রোগীর বয়স ৪০ বছরের নিচে। করোনা ভাইরাসের এই অনাকাঙ্খিত বিস্তারের জন্য অধিক সংক্রমণযুক্ত ভ্যারিয়েন্টকে দায়ী করা হলেও অনেকে এ পরিস্থিতির জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথা তুলে ধরছেন। পাবলিক হেলথ ফাউন্টেশন অব ইন্ডিয়ার প্রেসিডেন্ট কে. শ্রীনাথ রেড্ডি বলেছেন, এটা একটা মহামারি এবং এখনও তা শেষ হয়ে যায়নি। এই বার্তাটি জনগণের কাছে জোরালোভাবে ছড়িয়ে দিতে পারেননি নেতারা। পক্ষান্তরে করোনার বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করা হয়েছে অসময়ে। ফলে সারাদেশে এক উৎসবের আবহ ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে ছিলেন রাজনীতিকরা। তারা চেয়েছেন অর্থনীতি চলমান থাকুক। এমনকি তারা নির্বাচনী প্রচারণায় ফিরে গেছেন। এসব কারণেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার একটি সুযোগ পেয়েছে।
মুম্বইয়ের নিরাময় হাসপাতালে শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এই হাসপাতালের পরিচালক ড. অমিত থাধানি বলেছেন, করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ দেশে আঘাত করবে এ বিষয়ে তিনি ফেব্রুয়ারিতে সতর্কতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা অবহেলা করা হয়েছে। এখন তার হাসপাতাল রোগীতে পূর্ণ। যদি কোনো রোগী ছাড়পত্র নিয়ে চলে যান অথবা কেউ মারা যান তাহলে তার ৫ মিনিটের মধ্যে তা পূর্ণ হয়ে যায়। ১০ দিন আগে এই হাসপাতালটির অক্সিজেন শেষ হয়ে গেছে। তবে সময়মতো বিকল্প পথে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ড. অমিত বলেন, হাসপাতালের বাইরে প্রতিদিন মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রতি ৩০ সেকেন্ডে আমরা একটি করে কল পাচ্ছি বেডের জন্য। এর বেশির ভাগ কলই মারাত্মক অসুস্থ রোগীদের পক্ষ থেকে। কিন্তু আমরা জায়গা দিতে পারছি না। এসব কারণে মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। তিনি আরো বলেন, এবারকার ভাইরাস অধিক মাত্রায় আগ্রাসী এবং অধিক পরিমাণে সংক্রামক। তা প্রধানত এবার আক্রমণ করছে যুব শ্রেণিকে। এদের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। তারা অতি মারাত্মক লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন।
রাজধানী নয়া দিল্লির রাজপথে আর্তচিৎকার করতে করতে ছুটে চলছে এম্বুলেন্স। তার থামা নেই। দিল্লিতে সবচেয়ে বড় করোনা বিষয়ক হাসপাতাল লোক নায়ক সরকারি হাসপাতাল। সেখানে রোগীতে উপচে পড়ছে। দুটি বেডের দু’জন রোগীর জন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার দেয়া হচ্ছে। বাইরে রোগীরা বেডের জন্য অপেক্ষায় আছেন। তারা স্ট্রেচার বা এম্বুলেন্সে একটু নিশ্বাস নিতে যেন জীবনের সঙ্গে লড়াই করছেন। অনর্গল তার পাশে বসে কেঁদে যাচ্ছেন স্বজন। অনেকে বসে আছেন অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ। এসব অক্সিজেন সিলিন্ডার তারা সংগ্রহ করেছেন বাইরে থেকে। অন্যরা হাসপাতালের কার পার্কে অপেক্ষায় থেকে থেকে মারা যাচ্ছেন।
মুম্বইয়ে লীলাবতী হাসপাতালের ড. জলিল পারকার বলেছেন, পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। চিকিৎসকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। বেড, অক্সিজেন, ওষুধ, টিকা এবং পরীক্ষায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। করোনার চিকিৎসা দেয়ার জন্য আমরা আলাদা শাখা খুলেছি। তা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত বেড নেই আমাদের হাতে। ফলে বহু রোগীকে আমরা হাসপাতালের করিডোরে স্থান দিয়েছি। এমনকি হাসপাতালের বেজমেন্টকে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত করোনা রোগীদের জন্য ব্যবস্থা করেছি। এম্বুলেন্সে রোগীরা অপেক্ষা করেন। হাসপাতালের বাইরে হুইলচেয়ারে অপেক্ষায় থাকেন। কোনো কোনো সময় হাসপাতালের বাইরেও তাদেরকে আমরা অক্সিজেন দিচ্ছি। আমরা আর কি করতে পারি?
এই অবস্থায় প্রিয়জনের জন্য একটি বেড পেতে স্বজনরা যেন যুদ্ধ করছেন। পরিবহনমন্ত্রী ও উত্তর প্রদেশের বিজেপির এমপি বিজয় সিং কুমার টুইটারে আর্তি জানিয়েছেন। বলেছেন- দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। করোনা চিকিৎসার জন্য আমার এক ভাইয়ের জরুরি ভিত্তিতে বেড প্রয়োজন। কিন্তু এখন গাজিয়াবাদে কোনো বেড পাওয়া যাচ্ছে না।
সোমবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল বলেছেন, দিল্লির করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ। এদিন রাজধানীর মোট আইসিইউ বেডের শতকরা ৯৯ ভাগের বেশি রোগীতে ভর্তি হয়ে যায়। মঙ্গলবার রাজধানীর বেশ কয়েকটি শীর্ষ স্থানীয় হাসপাতাল ঘোষণা দেয় তাদের অক্সিজেন সরবরাহ ফুরিয়ে যাচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে অক্সিজেন প্রয়োজন। কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাদের মজুদ শেষ হয়ে যেতে পারে। ওদিকে গুজরাট ও উত্তর প্রদেশে করোনায় মৃতের প্রকৃত সংখ্যা ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সেখানে হাসপাতালের মর্গে এখন আর লাশ রাখার জায়গা নেই। উত্তর প্রদেশে সবচেয়ে বাজেভাবে আক্রান্ত হয়েছে লখনউ। সেখানে ১৪ই এপ্রিল করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন দীপ্তি মিস্ত্রি (২২) নামের এক সন্তানের এক জননী। তার আঙ্কেল এম্বুলেন্স চালক সরোজ কুমার পান্ডে তাকে শৈশব থেকেই লালনপালন করেছেন। তিনি বলেছেন, তার অক্সিজেন লেভেল শতকরা ৫০ ভাগের নিচে নেমে আসার ফলে দু’দিন আগে হাসপাতালে একটি বেড খুঁজে পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। কিন্তু কোথাও তা ম্যানেজ করতে পারেননি। তিনি আরো বলেছেন, দীপ্তির তাৎক্ষণিকভাবে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাই আমি নিজেই একটি অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা করি। এরপর অক্সিজেন সহ তাকে এক আত্মীয়ের গাড়িতে নিয়ে ডজনখানেক বেসরকারি এবং সরকারি হাসপাতাল ঘুরেছি একটি বেড এবং ভেন্টিলেটরের জন্য। কোথাও এর ব্যবস্থা করতে পারিনি।
এ অবস্থায় ১৬ই এপ্রিল তিনি লখনউতে একটি ৬ বেডের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে একটি বেড পান। কিন্তু এটি কোনো কোভিড হাসপাতাল ছিল না। তারা এক রাত তাকে রাখতে রাজি হয়েছিল এবং অক্সিজেন দিতে রাজি হয়েছিল। সরোজ কুমার বলেন, তাকে ওই ক্লিনিকে রেখে সারারাত আমরা বেডে বা ভেন্টিলেটরের জন্য ঘুরেছি। কিন্তু পাইনি। এ অবস্থায় পরের দিন ভোর ৫টার সময় ওই ক্লিনিক তাকে ছাড় দিয়ে দেয়। ফলে বাসায় চলে আসা ছাড়া আমাদের কাছে কোনো বিকল্প ছিল না। হাসপাতালের সেবা এবং অক্সিজেনের অভাবে কয়েক ঘন্টার মধ্যে মারা যায় দীপ্তি। কিন্তু এই কথা যখন বলা হচ্ছে তখন তার বেঁচে থাকার কথা ছিল।
টুইটার এবং ফেসবুকে হাজার হাজার মানুষ হাসপাতালে বেড, অক্সিজেন, প্লাজমা এবং রেমডিসিভির চেয়ে কাতর মিনতি জানাচ্ছেন।