অটিজম শব্দটি যেকোনো মানুষের জন্যই বড় ধরনের প্রতিবন্ধক। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী, প্রতি ৫৯ জন শিশুর মধ্যে একজন অটিজমে আক্রান্ত শিশুর জন্ম হয়। তবে অটিজম মানেই এই নয় যে, সমাজ থেকে তারা পুরোপুরি আলাদা। বরং অনেক বিখ্যাত মানুষ এই অটিজম কিংবা প্রতিবন্ধকতা নিয়েই জয় করেছেন বিশ্ব, হয়ে উঠেছেন বরেণ্য ব্যক্তি। আজ আমরা জানবো এমনই কয়েকজন সম্পর্কে, যারা কি না প্রতিবন্ধকতা নিয়েই চড়েছেন খ্যাতির শীর্ষে।
অ্যান্থনি হপকিন্স
সাইলেন্স অফ দ্য ল্যাম্বস মুভির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার অস্কার পাওয়া অ্যান্থনি হপকিন্সও আক্রান্ত অটিজমে। অ্যাসপারগার সিন্ড্রোম নামের এই অটিজমের কারণে একজন মানুষ সামাজিকভাবে অন্তর্মুখী হয়। সহজেই কারো সাথে সখ্যতা গড়ে তুলতে পারেন না তারা। এ ব্যাপারে অ্যান্থনি হপকিন্স বলেন, এই সিন্ড্রোমের কারণে সমস্যা হলেও এজন্য বিশ্রাম নেওয়ার সময় বেশি পান তিনি। ফলে প্রচুর কাজও করতে পারেন।
লেসলি লেমকে
জন্ম নেওয়ার সময়ই অনেক সমস্যা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন লেসলি লেমকে। অপারেশনের জন্য জন্মের কিছুদিনের মধ্যেই ডাক্তাররা তাঁর চোখ ফেলে দিতে বাধ্য হন। নিজের মা পর্যন্ত বর্জন করেন লেমকেকে। সেই সময় মে লেমকে নামক এক নার্স তাঁকে লালনপালন করতে শুরু করেন।
১২ বছর পর্যন্ত লেসলি লেমকে হাঁটতেও পারতেন না। অবশেষে ১৫ বছর বয়সে একটু আধটু হাঁটতে শেখেন তিনি। ১৬ বছর বয়সে লেমকের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এক মধ্যরাতে মে লেমকে ঘুম থেকে জেগে দেখতে পান, পিয়ানো বাজাচ্ছেন ১৬ বছর বয়সী লেমকে। সেই থেকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁর। ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভা দিয়ে জয় করেন বিশ্বমঞ্চ। মৃত্যুর আগপর্যন্ত অসংখ্য কনসার্ট করে আনন্দ দিয়ে গিয়েছেন পৃথিবীর বহু মানুষকে। রেখে গেছেন অটিজমে আক্রান্ত হয়েও সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত।
আলঞ্জো ক্লেমন্স
পশু পাখিদের ত্রিমাত্রিক ভাস্কর্য তৈরির জন্য বিখ্যাত আলঞ্জো ক্লেমন্সের আইকিউ স্কোর পিলে চমকে ওঠার মতো; ৪০-৫০ এর ঘরের মধ্যে। তবুও এই প্রতিবন্ধকতা জয় করেছেন তিনি। তার সহকারী ন্যান্সি মেসন বলেন, কারো কাছ থেকেই ভাস্কর্য তৈরি শেখেননি ক্লেমন্স। ঈশ্বর প্রদত্ত প্রতিভাটাকেই কাজে লাগিয়েছেন পুরোদমে। হাতের কাছে কাদামাটি না থাকলেও যেকোনো কিছু দিয়েই ভাস্কর্য বানানোর ক্ষমতা রাখেন তিনি।
কিম পিক
রেইনম্যান মুভির ডাস্টিন হফম্যানের চরিত্রের কথা মনে আছে? সেই চরিত্রটি ছিলো আদতে কিম পিক নামের এক মানুষের। অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার পরও মুখস্থ করার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন এই ব্যক্তি। যেকোনো বই এক ঘন্টা পড়ার পর তার ৯৮% অংশই মনে রাখতে পারেন কিম। তার প্রায় ১২,০০০ বই মুখস্থ রয়েছে। এর পাশাপাশি গণিতেও রয়েছে তাঁর দারুণ দক্ষতা।
অথচ জন্মের চার বছর পর্যন্ত হাঁটতেই পারেননি তিনি। নিজের শার্টের বোতামও লাগাতে শেখেননি এখনও। সাধারণ মানুষদের তুলনায় অনেক নিচে তাঁর আইকিউ লেভেল। এখনও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। জন্মের সময় কিমের মস্তিষ্কের সেরেবাল কলোসাম ছিলো না, যেটির কাজ মগজের দুই অংশকে সংযুক্ত করা। তাই অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো স্বাভাবিক কাজগুলোও করতে পারেন না কিম। তারপরও এসব প্রতিবন্ধকতা ঠেলে কিম পিক আজ নিজেকে দৃষ্টান্তরূপে স্থাপন করেছেন।
স্ট্যানলি কুব্রিক
বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক স্ট্যানলি কুব্রিককে কে না চেনে! দ্য শাইনিং, ২০০১: অ্যা স্পেস অডিসি মুভিগুলোর জন্য জনপ্রিয় কুব্রিকও কিন্তু হপকিন্সের মতো অ্যাসপারগার সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ছিলেন। তিনি এতে এতটাই আক্রান্ত ছিলেন যে, ক্যামেরার বাইরের জগতটাই তিনি সহ্য করতে পারতেন না। শুধুমাত্র ক্যামেরার পেছনে থাকতে পারলেই সুখী থাকতেন তিনি।
ম্যাট স্যাভেজ
এই প্রতিভাবান আমেরিকান সঙ্গীতশিল্পী জন্ম থেকেই অটিজমে আক্রান্ত ছিলেন। পারভেসিভ ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার নামে একধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতা ছিলো ম্যাটের মধ্যে। ফলে শিশুদের মানসিক বিকাশ কিংবা অন্যান্য যেকোনো কিছুই ধীর লয়ে শুরু হয়।
তবে এই সমস্যা থাকলেও সঙ্গীতে খুব অল্প বয়সেই প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছিলেন তিনি। মাত্র ছয় বছর বয়সে পিয়ানো বাজানো শুরু করেন। ১১ বছর বয়সেই সঙ্গীত ক্যারিয়ার এমন পর্যায়ে নিয়ে যান যে, একটি পিয়ানো কোম্পানির সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হন তিনি। ম্যাট স্যাভেজকে সময়ের অন্যতম সেরা পিয়ানোবাদক হিসেবেও ধরা হয়।
স্টিফেন উইল্টশায়ার
অসাধারণ ছবি আঁকার ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো উইল্টশায়ারও অসুস্থতা নিয়ে জন্ম নেন। পাঁচ বছর বয়সে এসে আধো আধো কথা বললেও সাংকেতিক ভাষাতেই মানুষের সাথে যোগাযোগ করতেন তিনি। কথা বলতে পারতেন না বিধায় তাঁকে ভর্তি করানো হয় অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসা করানোর একটি প্রতিষ্ঠানে। সেখানেই চিত্রাঙ্কনের উপর আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর।
ছোটবেলা থেকেই চিত্রশিল্পী হিসেবে হাত পাকা ছিলো উইল্টশায়ারের। যেকোনো ধরনের ল্যান্ডস্কেপ একবার দেখলেই তা হুবহু কাগজে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন তিনি, যার জন্য উইল্টশায়ার মানব ক্যামেরা উপাধিও পেয়েছেন।
জেদিদাহ বাক্সটন
১৭০৭ সালে ইংল্যান্ডের বার্কশায়ারে জন্মানো জেদিদাহ বাক্সটন নিজের জীবদ্দশায় কখনো লিখতে পারেননি। কিন্তু এত বড় প্রতিবন্ধকতা থাকলেও নিজেকে একজন গণিত প্রতিভা হিসেবে প্রমাণ করেছেন তিনি।
বড় বড় অঙ্ক শুধুমাত্র মনে মনে করেই উত্তর বলতে পারতেন বাক্সটন। সবকিছুতেই সংখ্যা খুঁজতেন তিনি। হেঁটে হেঁটে কষতে পারতেন কোনো জমির আয়তন। পরবর্তীতে ব্রিটিশ রয়্যাল একাডেমি বাক্সটনকে ডেকে নিয়ে একটি পরীক্ষাও নেয়। সেখানে রীতিমত সবাইকে চমকে দেন তিনি। ৩৯ ঘর পর্যন্ত অঙ্কের উত্তরও বলে দিয়েছিলেন তিনি।
ড্যানিয়েল ট্যামেট
প্রথম দেখায় ড্যানিয়েল ট্যামেটকে একজন সাধারণ মানুষই মনে হবে আপনার। কিন্তু অন্যান্যদের তুলনায় ড্যানিয়েল আলাদা তাঁর অস্বাভাবিক গণিত ও ভাষা সংক্রান্ত দক্ষতার জন্য।
সর্বপ্রথম ড্যানিয়েল পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন পাইয়ের মান ২২,৫১৪ সংখ্যা পর্যন্ত বলে। তবে তাকে ‘হাই ফাংশনিং অটিজম’ রোগী বলে ঘোষনা দেন ডাক্তাররা। অন্যান্য অটিজম শিশুদের মতো নন তিনি। ড্যানিয়েল যেকোনো গাণিতিক সমস্যার উত্তর ১,০০০ ঘর পর্যন্ত দেখতে পান। এমনকি অনুভূতি দিয়েই বলে দিতে পারেন, কোনো সংখ্যা মৌলিক কি না।
ড্যানিয়েল ১১টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। ২০০৭ সালে একটি টিভি চ্যানেল তাকে একটি ভাষা শেখার চ্যালেঞ্জ জানায়। সময় ছিলো মাত্র সাতদিন। সাতদিনের মাথায় আইসল্যান্ডিক ভাষা শিখে সেই টিভিতে ইন্টারভিউ দেন ট্যামেট। এমনকি বিজ্ঞানীরা এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছেন ড্যানিয়েলের এরকম অটিজমের পেছনের প্রধান কারণটি বের করার।
ডেরিল হান্নাহ
কিল বিল খ্যাত এই অভিনেত্রীও সর্বসাধারণের কাছেই স্বীকার করেছেন নিজের অটিজমের কথা। ছোটবেলা থেকেই অ্যাসপারগার সিন্ড্রোমে ভুগছিলেন ডেরিল। সেজন্য তিনি কিছুটা লাজুক ও বড় অনুষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলতেন। আর এজন্যই হয়তো হলিউডে তেমনভাবে আর দেখা যায়নি এই অভিনেত্রীকে।