আজ আপনাদের শোনাতে চাই এক মহান বিজ্ঞানীর কথা, যার একক প্রচেষ্টায় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে। বাংলাদশের ইলিয়াস কাঞ্চন যেমন বছরের পর বছর নিরলসভাবে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলন চালিয়ে গেছেন, এই বিজ্ঞানী তেমন বছরের পর বছর লেড পয়জনিং এর বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। নাম তার Clair Cameron Patterson। ছিলেন আমেরিকার জিওকেমিস্ট (জন্ম ১৯২২-মৃত্য ১৯৯৫)। তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন পৃথিবীর বয়স নির্নয় করার কারনে। পৃথিবী নামক গ্রহটার বিভিন্ন এলাকায় সীসা ( লেড- Pb)এর পারসেন্টেজ ক্যালকুলেট করে তিনি বের করেছিলেন, পৃথিবীর বর্তমান বয়স ৪৫০ কোটি বছর। শীসা নিয়ে কাজ করতে দিয়েই ১৯৬০ এর দিকে তিনি আবিষ্কার করলেন, শহুরে এলাকার মানুষ সীসার দূষণে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। কারন খুজতে গিয়ে বুঝলেন, গাড়ির পেট্রলে টেট্রা ইথাইল লেড নামে একটা জিনিস মেশানো থাকে, যেন গাড়ির ইঞ্জিনের ভট ভট শব্দ কম হয়। গাড়ির কালো ধোয়া থেকে এই লেড বাতাসে মেশে, এলাকার জনগন নিঃশ্বাসের সাথে এই বিষাক্ত লেড গ্রহন করে,এবং অসূস্থ হয়ে যায়। পেট্রলের এন্টিনক হিসেবে টেট্রা ইথাইল লেড না মিশিয়ে অন্য জিনিস (যেমন ইথানল) মিশালেও একই রকম কাজ করে। গাড়ির ভট ভট শব্দ (নকিং) বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তেল কোম্পানিদের সিন্ডিকেট এই কাজ করতে রাজিনা। ইথানল এর দাম বেশি। TEL (Tetra Ethyl Lead) এর দাম কম। পেট্রলে TEL মিশিয়ে বিক্রি করলে তেল কোম্পানিদের লাভ বেশি হবে,ইথানল মিশিয়ে বিক্রি করলে লাভ কম হবে । বিজ্ঞানী প্যাটারসন তখন তেল এবং গাড়ি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন শুরু করলেন। তার দাবি ছিল, তেল কোম্পানিগুলা এন্টি নক হিসেবে টেট্রা ইথাইল লেড না মিশিয়ে ইথানল মিশিয়ে বিক্রি করুক। তেল কোম্পানিগুলো দেখল, এ তো মহা মুসিবত। এই বিজ্ঞানীকে থামাতে হবে। ব্যবসায় লস করা যাবে না। কোম্পানিগুলো এসে প্যাটার্সনকে প্রস্তাব দিল, তুমি পৃথিবীর বয়স নির্নয় বা অন্য সব গবেষনাতেই লেগে থাকো, আমরা তোমাকে অনেক ফান্ডিং দিয়ে সাহায্য করব । কিন্তু “গাড়ির তেলের কারনে জনস্বাস্থ্যে ক্ষতি হচ্ছে” — এই গবেষণা কইরো না। এমন কথা সাংবাদিকদের বইলো না। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানী প্যাটারসন এই কথা শুনলেন না। তার কার্যক্রম চালিয়ে যেতে লাগলেন । তেল কম্পানিগুলো তখন তার ক্যাম্পেইনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের চেষ্টা করতে লাগল। টাকা পয়সা খরচ করে তারা ভুয়া গবেষণা রিপোর্ট বের করল, যেখানে দেখা যায় , TEL এর কারনে স্বাস্থ্যে কোনো ক্ষতি হয় না। কিংবা গাড়ির কালো ধোয়া থেকে TEL মাটিতে বা আশেপাশের কোথাও পড়েনা, সবই বাতাসে উড়ে চলে যায়। মোট কথা , তাদের গবেষণা দেখাতে লাগল, প্যাটার্সনের গবেষণার রেজাল্ট ভুল। TEL ক্ষতিকর নয়। প্যাটার্সন দমলেন না। তিনি তার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন। অন্যান্য বিজ্ঞানীদেরকে তার কাজের কথা জানালেন। নির্ভুল তথ্য উপাত্ত এবং গবেষণা পদ্ধতির কারনে সবাই প্যাটার্সনের দাবির সাথে একমত হলেন। এর পরের স্টেপে আসল প্যাটার্সনের জীবনের প্রতি হুমকি। তেল কোম্পানিগুলো তাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইল। সুযোগ খুজতে লাগল তারা। গুপ্তঘাতকের আক্রমণ ও আসল তার উপরে। কিছুতেই তিনি দমলেন না। বেচে থাকলেন যুদ্ধ করে। তার ক্যাম্পেইন চালিয়ে যেতে লাগলেন। সীসার বিষক্রিয়া বা লেড পয়জনিং সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে লাগলেন। ভারী ধাতু শীসা শরীরে ধুকে পড়লে মূল সমস্যা করে কিডনিতে । অনেকেরই কিডনি ড্যামেজ করে। কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজে ভোগে অনেকে। উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক সমস্যা, বিষন্নতার মত সমস্যার পেছনেও দায়ী লেড পয়জনিং। শিশু এবং প্রেগন্যান্ট মায়েদের ক্ষেত্রে ইমপ্যাক্ট আরো অনেক বেশি। প্যাটার্সন এই সব রোগের সাথে TEL এবং গাড়ির তেলের সম্পর্ক বুঝালেন সবাইকে । ধীরে ধীরে তার দাবির পিছনে জনসমর্থন বাড়তে লাগল। আমেরিকার হাসপাতালে সীসার বিষক্রিয়া নিয়ে প্রচুর রোগী ভর্তি হওয়া শুরু করলে সরকার ও নড়েচড়ে বসল। ১৯৭৫ সালে সীসার ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আমেরিকা । অন্যান্য দেশ ও ধীরে ধীরে এটা গ্রহণ করে। বর্তমানে পেট্রোলের এন্টিনক হিসেবে টেট্রা ইথাইল লেড এর ব্যবহার এখন নিষিদ্ধ । ইথানল বা অন্যান্য অক্ষতিকর পদার্থ এখন ইউজ করা হয় পেট্রলের এন্টিনক হিসেবে। (বাংলাদেশে পেট্রলের ব্যবহার কম। অধিকাংশ গাড়ি ডিজেলে চলে। পেট্রল যারা ব্যবহার করে, জানামতে সেখানে TEL মেশানো হয়না। তবে বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানির রঙ,পেইন্ট,গুড়া মশলা, ব্যাটারি ইত্যাদি থেকে লেড পয়জনিং হচ্ছে অনেক। এগুলা বন্ধ করা উচিত) এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাই । পৃথিবীর অনেক বেশি সর্বনাশ করেছে বিজ্ঞান–এমন একটা আলাপ উঠেছে সম্প্রতি। আপনারা বলুন তো , পৃথিবী জুড়ে সীসার বিষক্রিয়ার এই সর্বনাশটা কে করেছে ? TEL আবিষ্কারক সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করেছে ? নাকি যে ইথানল আবিষ্কার করেছে সে ? নাকি TEL নিষিদ্ধের আন্দোলনকারী বিজ্ঞানী প্যাটার্সন সবচেয়ে বড় সর্বনাশ করেছে ? নাকি ব্যবসায়ীরা বেশি সর্বনাশ করেছে , যারা বেশি লাভের জন্য বিজ্ঞানীদের মতামত না শুনে , বিজ্ঞানীদেরই আবিষ্কার করা দুইটা জিনিসের মধ্যে ক্ষতিকর জিনিসটা বেশি বেশি মার্কেটিং করে ব্যবসা করেছে?