সুদীর্ঘ বিশ বছরেরও বেশি সময়ের পর আমেরিকা আফগানিস্থান থেকে তার সমস্ত সেনা প্রত্যাহার করার ঘোষণা হয়তো আজকে মধ্যাহ্নের আগেই দিয়ে দিবে। আর, ঠিক এই সময়ে নিউ অরলিন্স শহরের এক কনফারেন্সে ম্যারিয়ট হোটেলের লবিতে বসে আমার আলফ্রেড উইলিয়ামস নামক এক মার্কিন সেনা কর্মকর্তার কথা বেশ মনে পড়ছে।
আলফ্রেড বলেন-আমি তখন আফগানিস্তানে। একদিন প্রচণ্ড ঝড়ের রাত। আমরা কয়েক বন্ধু মিলে বাজি ধরলাম- এমন তীব্র ঝড়ে ভোরের “প্রেয়ার কল” (ফজরের আযান) দেয়ার জন্য কেউ আসবে না। কিন্তু, আমাদের ধারণা ভুল। ঝড়ের তীব্র নিনাদের মাঝেও প্রতিদিনের মতো ভোরের সেই আহ্বান ভেসে এলো।
শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। পরদিনের সমস্ত প্রোগ্রাম যেখানে মূলতবি হয়ে গেছে। সাহস করে কেউ যেখানে ঘরের বাইরে পা রাখছে না। সেখানে এই লোক কীভাবে এমন বিপদ সংকুল অবস্থায় এতো ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে এলো।
একজন বললো- তুমিও বের হয়ে আসবে যদি তোমাকে ওভারটাইম দেয়া হয়। উনি নিশ্চয়ই এজন্য বাড়তি টাকা আয় করবেন।
কিছুদিন পর, একেবারে কৌতুহল থেকেই দোভাষীর সাহায্যে উনার সাথে আলাপ করলাম।
এ্যাসিসটেন্ট প্রিচার (মুয়াজ্জিন) হেসে বললেন- জ্বি এজন্য ওভারটাইম পাই। তবে, এখানে না। পরলোকে। আমাদের সমস্ত ওভারটাইম হলো – আমাদের প্রতি আমাদের রবের সন্তুষ্টি। আপনারা যদি সিনিয়র অফিসারের নির্দেশে সুদূর আমেরিকা থেকে কাবুল এসে যেতে পারেন তবে, যিনি সারা দুনিয়ার সৃষ্টিকর্তা তার নির্দেশ পালনে কেন আমরা এই সামান্য ঘর থেকে মসজিদে যেতে পারবো না?
তার এই একটি কথা যেন আমার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিলো। স্রষ্টাকে তো এমন করে কোনদিন ভাবিনি, কোনদিন ডাকিনি। অথচ, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, যুদ্ধ-বিগ্রহ যাই হোক, সব কিছু উপেক্ষা করে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর তারা মানুষকে স্রষ্টার দিকে, কল্যাণের দিকে এভাবে ডেকে যাচ্ছেন।
এরপর ইমামের কাছ থেকে আমি অনেক কিছুই শিখেছি। ইউরিনেট করার পর যে পরিচ্ছন্নতার একটা ব্যাপার আছে- সেটা উনি শিখিয়েছেন। এটা আগে কোনোদিন ভাবিনি।
তবে, আমার মনে হয় মুসলমানরা মসজিদ থেকে- নামাজ থেকে যে শিক্ষাটা গ্রহণ করতে পারতো তা তারা গ্রহণ করেনি।
আমি বলি- মিঃ আলফ্রেড কি সেই শিক্ষা।
মাটির তৈরি মসজিদও দেখেছি। ভিতরটা খুবই পরিষ্কার। কিন্তু আশেপাশের পরিবেশটা বড়ই নোংরা। শেখ আর ভৃত্যকে দেখেছি এক সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে। কি অপূর্ব সাম্য। কিন্তু এই শেখকেই আবার দেখেছি- সামান্য ভুলের জন্য ভৃত্যকে নির্মমভাবে প্রহার করতে।
প্রতিদিন পাঁচবার একেবারে ঘড়ির কাটায় প্রার্থনা শুরু হতে দেখেছি। কিন্তু আফগানদের একটা অনুষ্ঠানও ঠিক সময়ে শুরু হতে দেখিনি।
মসজিদের ইমামকে দেখেছি। শুকনো একটা মানুষ। অথচ, তিনি মসজিদের লীডার। ব্রেণকে বডির উপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু আর অন্য কোনো ক্ষেত্রে যার যার যোগ্যতাকে সেভাবে গুরুত্ব দিতে দেখিনি। ফলে, এই দেশগুলো নানা ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়েছে। গনতন্ত্র উদ্ধারের নামে আমাদেরকেও সেখানে গিয়ে ঘাঁটি গড়তে হয়েছে। জানিনা, ভিন দেশে সেনা ঘাঁটি গড়ার এই সব পরিকল্পনা থেকে কবে আমেরিকা সরে আসবে।
আলফ্রডের কথাগুলো যত শুনছি, তত অবাক হচ্ছি।
আমি আলফ্রেডকে বললাম -মিঃ আলফ্রেড। কিছু মনে না করলে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। জানি, এরকম প্রশ্ন করা আদৌ ঠিক না। ইসলাম ধর্ম , মুসলমান এসব নিয়ে মানুষের যে একটা ভয়, ভীতি কিংবা অনেক মুক্ত মনের মানুষের মাঝেও যে একটা এলার্জি আছে। আপনার সাথে আলাপে বুঝতে পারলাম- একজন মার্কিন সেনা অফিসার হয়েও সেটা আপনার মাঝে নেই। ব্যক্তিগত ভাবে- আপনি কি কোন ধর্ম চর্চা করেন। করলেও সেটা কী?
আলফ্রেডের শেষ কথাগুলো এখনো আমার কানে প্রতিধবনিত হয়। আলফ্রেড স্মিত হেসে বলেন-
আমার মনে হয়- আমি কর্মে মুসলমান কিন্তু ধর্মে না।
আমি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মনে মনে বললাম- আর আমরা শুধু ধর্মে আর নামে মুসলমান। কিন্তু কর্মে না।
Arif Mahmud