লিখেছেন রাজেশ পাল
আজ লক্ষ্মীপূজো। বাঙালি হিন্দুরা আজ ঘরে ঘরে ব্যস্ত লক্ষ্মীর ঝাঁপি সাজানো আর আলপনা দিয়ে মেঝে রাঙানোর কর্মব্যস্ততায়। সবার মনে একই প্রত্যাশা , সুখে শান্তিতে ধনে সম্পদে যেন ভরে উঠে নিজেদের ছোট্ট গৃহকোণ।
১৯৪৬ সালেও তাই করেছিলো নোয়াখালীর হিন্দুরা। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ।দিনটি ছিল কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার দিন। নোয়াখালীর হিন্দুরা বাড়িতে পূজার আয়োজনে ব্যস্ত।অন্যদিকে মুসলিম লীগ নেতারা তখন ব্যস্ত মিথ্যা সংবাদ আর গুজব রটাতে। তারা চারিদিকে গুজব ছড়িয়ে দেয় যে,শিখ সম্প্রদায় দিয়ারা শরীফ আক্রমণ করেছে। বাতাসের আগে ছড়িয়ে পড়া গুজবের ফলে আশে পাশের এলাকার মুসলিম লীগের গুণ্ডারা দলে দলে দিয়ারা শরিফে জড়ো হতে শুরু করে। গোলাম সরোয়ার হুসেনি সমবেতদেরকে সাহাপুর বাজার আক্রমণ করতে নির্দেশ দেয়।কাশেম নামের আরেকজন মুসলিম লীগ নেতাও তার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে সাহাপুর বাজারে পোঁছায় যাদেরকে “কাশেমের ফৌজ” বলা হত।
কাশেমের ফৌজ নারায়ণপুর থেকে সুরেন্দ্রনাথ বসুর ‘জামিনদার অফিসের’ দিকে এগিয়ে যায়। কল্যাণনগর থেকে আসা আরেকদল দাঙ্গাবাজ দল কাশেমের ফৌজের সাথে যোগ দেয়।এদের সাথে আরও অনেক ভাড়া করে আনা মুসলিম লীগের গুণ্ডারা জামিনদার অফিসে আক্রমণ করে।সামান্য প্রতিরোধের পরই সুরেন্দ্রনাথ বসু ধারাল অস্ত্রের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন। মুসলিম লীগের গুণ্ডারা হাত-পা বেধে তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে।সুরেন্দ্রনাথ বসুকে আক্রমণ করেছে শুনতে পেয়ে পাশের পাঁচঘরিয়া গ্রামের ডাক্তার রাজকুমার পাল তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। কিন্তু পথিমধ্যে তাকে দুর্বৃত্তরা ছুরিকাহত করে খুন করে।
অক্টোবর মাসের ১১ তারিখে গোলাম সরোয়ারের ব্যক্তিগত বাহিনী যা ‘মিঞার ফৌজ’ নামে পরিচিত ছিল নোয়াখালী বার এ্যাসোসিয়েশন ও জেলা হিন্দু মহাসভার সভাপতি রাজেন্দ্রলাল রায়চৌধুরীর বসতবাড়িতে আক্রমণ করে। সে সময়ে ভারতসেবাশ্রম সঙ্ঘের স্বামী ত্রেম্বকানন্দ তাঁর বাড়িতে অতিথি হিসেবে ছিলেন। রাজেন্দ্রলাল পুরোটা দিন তাঁর বাড়ির ছাদ থেকে রাইফেল নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করেন। রাত নেমে আসার পর যখন দাঙ্গাবাজেরা ফিরে গেল তখন রাজেন্দ্রলাল স্বামী ত্রম্বকানন্দ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেন। পরের দিন আবার দাঙ্গাকারীরা সংগঠিত হয়ে রাজেন্দ্রলালের বাড়িতে আক্রমণ করে। তারা বাড়িতে অগ্নি সংযোগ করে।রাজেন্দ্রলাল,তাঁর অগ্রজ চিন্তাচরন এবং অনুজসতীশ সহ পরিবারের ২২ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়। রাজেন্দলাল রায় চৌধুরীর শরীর থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তারা।এরপর সে ছিন্ন মস্তক একটি থালায় করে গোলাম সরোয়ার হুসেনির নিকট নিয়ে আসে তার বাহিনী।রাজেন্দ্রলালের বাড়ি থেকে তাঁর দুই মেয়েকে অপহরণ করে নিয়ে আসে হুসেনির বাহিনী যাদেরকে হুসেনি তার দুই বিশ্বস্ত অনুচরকে গনিমতের মাল হিসেবে দেয়।
কংগ্রেস সভাপতি আচার্য্য কৃপালনির স্ত্রী সুচেতা কৃপালিনির মতে, রাজেন্দ্রলাল শিবাজি এবং গুরুগোবিন্দের পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং তার পরিবারের সম্মান ও নিজের বিশ্বাস কে রক্ষা করতে গিয়ে শহীদ হন। গান্ধিবাদী অহিংস আন্দোলনের একনিষ্ঠ অনুসারী আচার্য কৃপালিনী মনে করেন, রাজেন্দ্রলাল আর তার পরিবার নিজেদের রক্ষা করতে সম্পূর্ণ অহিংস পন্থা বেছে নিয়েছিলেন। তিন মাস পরে নোয়াখালী পরিদর্শনের সময় মহত্মাগান্ধী লুটপাট আর ধ্বংসকৃত রাজেন্দ্রলালের বাড়িতে যান।১৯৪৭ সালের ১১ জানুয়ারি রাজেন্দ্রলালের গলিত শব আজিমপুরের জলা থেকে তুলে লামচর হাই স্কুলে গান্ধীজীর প্রার্থনা সভাতে নিয়ে আসা হয়। প্রার্থনার পরে রাজেন্দ্রলালের মস্তক বিহীন শরীর হিন্দু রীতিতে দাহ করা হয়।
অক্টোবরের ১২ তারিখে রাইপুর থানার অন্তর্গত শায়েস্তাগঞ্জের চিত্তরঞ্জন দত্ত রায়চৌধুরীর বাড়িতে একদল হামলা করে। তিনি তাঁর পরিবারের সকল সদস্যদেরকে বাড়ির ছাদে তুলে দেন এবং নিজে ছাদ থেকে রাইফেল দিয়ে গুলি করে আত্মরক্ষার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু আক্রমণকারীদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি অপরদিকে তাঁর গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল।তখন তিনি প্রতিরোধের জন্য আক্রমণকারীদের উপর জল কামান ব্যবহার করেন। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তিনি তাঁর বৃদ্ধ মা এবং বাচ্চাদেরকে নিজ হাতে গুলি করেন এবং সব শেষে নিজে আত্মহত্যা করেন। রামগঞ্জ পুলিশের নিয়ন্ত্রণাধীন সোমপাড়া বাজারের কাছে গোপাইরবাগে দাস পরিবারের উপর কাশেমের নিজস্ব বাহিনী আক্রমণ করে।দাস পরিবার ছিল কাশেমের নিকটতম প্রতিবেশী। আক্রমণকারী বাহিনী দাস পরিবারের ১৯ জন সদস্যকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। মুসলিম লীগের ক্যাডাররা রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের আওতাধীন নোয়াখোলা গ্রামের চৌধুরী পরিবারের উপর হামলা চালায় বর্বর দাঙ্গাকারীরা। হামলাকারীরা উন্মত্তের মত হত্যার তাণ্ডব চালায়, লুটপাট করে এবং আগুন লাগিয়ে দেয়।ওই বাড়ির মোট ৮ জন পুরুষ সদস্যের সবাইকে হত্যা করা হয়। তাদের আরেকটি দল রামগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের গোবিন্দপুরের যশোদা পাল ও ভরত ভূঁইয়ার বাড়িতে আক্রমণ করে।তারা পরিবারের ১৬ জন সদস্যকে দড়ি দিয়ে বেধে জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। আমিশাপাড়া এবং সাতঘরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকার ভৌমিক এবং পাল পরিবারের সবাইকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানানো হয়। এই দুই পরিবারের ১৯ সদস্যকে হত্যা করে মুসলিম লীগের গুণ্ডারা।
নোয়াখালীতে ঠিক কতজনকে হত্যা করা হয় তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়না। তবে তা আনুমানিক লক্ষাধিক এর কম নয় বলে বেশিরভাগ গবেষকের ধারণা। এছাড়া ধর্ষণের শিকার হন সহস্রাধিক নারী। বাস্তুহারা হন কয়েক লক্ষ মানুষ।
এই দাঙ্গা ঠেকাতে স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী ছুটে আসেন নোয়াখালীতে। মজার ব্যাপার হলো নোয়াখালীর মুসলিম লীগের ক্যাডাররা মহাত্মা গান্ধীর সাথে থাকা ছাগলটি পর্যন্ত রাতে চুরি করে নিয়ে যায় আর জবাই করে মেজবান সারে।
অতএব বোঝা যায় , লক্ষ্মীদেবী সেদিন নোয়াখালীর হিন্দুদের পূজোয় তুষ্টের পরিবর্তে রুষ্টই হয়েছিলেন। না হলে এই দুর্ভোগ নেমে আসে কী করে?
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর ভাষায় বলি, “ঈশ্বর থাকেন ঐ ভদ্রপল্লিতে। এইখানে তাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবেনা”!