সুনামগন্জের শাল্লা উপজেলাধীন একটি গ্রামে সম্প্রতি ধর্মীয় উগ্রবাদীদের হামলা, লুটপাট ও নিরীহ হিন্দু লোকজনের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় কবি আসাদ চৌধুরী সহ কানাডা প্রবাসী বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিবর্গ তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এক যুক্ত বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, আমরা প্রায়ই উচ্চারণ করি, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ’। কিন্তু যে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে, এসব কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেই সম্প্রীতির সুনাম কী আমরা ধরে রাখতে পারছি ? ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার মুসলমান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান ; আমরা সবাই একই মায়ের সন্তান। অধিকার আমাদের সবার সমান’। – বর্বর, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক গোষ্টীর উন্মত্ততা, হিংস্রতা আমাদের এই ঐতিহ্যের প্রতিটি সৌন্দর্য বিনষ্ট করে দিচ্ছে। বিনষ্ট করে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল ক্ষমতায় থাকার পরও বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, হুমকি আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি ! ঘটনাগুলো ঘটেই যাচ্ছে ! ঘটনার পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া কিছু ব্যবস্থা ছাড়া টেকসই ও দৃষ্টান্তপূর্ণ কোনো পরিণতি আমরা দেখতে পাই না।
তাঁরা বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, যদি সাম্প্রদায়িক নির্যাতনগুলোর দৃষ্টান্তপূর্ণ শাস্তি জাতির কাছে দৃশ্যমান হতো তাহলে মৌলবাদী গোষ্ঠীর আস্ফালন বৃদ্ধি পেতো না। তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্রশস্ত্র সহ হুংকার দিয়ে এই পাশবিক ঘটনাগুলো ঘটিয়ে যাচ্ছে এরা – ভাবতেই অবাক লাগে এত দু:সাহস এদের ! সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তি করে, অথচ এদের কিছুই হয় না ! অথচ এসব মৌলবাদীদের ধর্মীয় উস্কানীমূলক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বক্তব্যের সমালোচনা করলে প্রশাসন কঠোর হয়ে ওঠে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক লোকজনের ওপর !
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, সুনামগন্জের দিরাইয়ে হেফাজতে ইসলামের সভায় ধর্মীয় উস্কানীদাতা, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অপশক্তির অন্যতম নেতা, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে আস্পর্ধাপূর্ণ বক্তব্যদানকারী বিতর্কিত মাওলানা মমিনুল হকের বক্তব্য রাখার পরদিন শাল্লায় যে ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ঘটলো সেটি আবারও প্রমাণ করলো সোনার বাংলায় এই দুর্বৃত্তদের দাপট কতো ভয়ংকর হয়ে ওঠছে। দুর্ভাগ্যজনক যে, আওয়ামীলীগের সরকার, শেখ হাসিনার সরকার যখন ক্ষমতায় তখনও এসব দেখতে হচ্ছে ! একই সাথে আরো লজ্জা ও বিব্রতকর বিষয় যে, সরকার, প্রশাসন ছাড়াও দেশের প্রগতিশীল, স্বাধীনতার পক্ষ শক্তিগুলোর ভূমিকাও চোখে পড়ার মতো নয় !
বিবৃতিদাতারা বলেন, দেশের অন্যান্য স্থানে পূর্বে ঘটিত বর্বরতার মতোই শাল্লায় নিরীহ হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অতর্কিত হামলা, লুটপাট, নির্যাতন কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পিত। হিন্দু মুসলমান মিলেমিশে শতশত বছরের শান্তির জনপদ এই দিরাই শাল্লা তথা এই বাংলাদেশ। ভ্রাতৃত্বের এই সহাবস্থানকে অশান্ত করা, ভয়ার্ত পরিবেশের বাতাবরণে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন করা আর লাখো শহীদের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশকে একটি তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত করার হীন চক্রান্তেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশদ্রোহী গোস্ঠী বারবার এসব ছোবল মারছে। সরকারের নীরবতায় এরা এতই দু:সাহসী হয়ে ওঠেছে যে, এখন এরা জাতির পিতার ভাস্কর্যও ভেঙ্গে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার ধৃষ্টতা পর্যন্ত দেখাতে পারে !
দিনদিন এই অশুভ চক্রটি যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠছে, শক্ত হাতে এখনই সেটি মোকাবেলা করতে না পারলে, জাতীয় জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসার দৃশ্য করুণভাবে অবলোকন করা শুধুই সময়ের ব্যাপার বলে তাঁরা আশংকা প্রকাশ করেন।
তাঁরা বলেন, আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, সকল প্রকার ধর্মীয় মৌলবাদ ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের মূলোৎপাটন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা তথা একাত্তরের সংবিধান পুন:প্রবর্তন ছাড়া প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে চলমান অভাবনীয় অবকাঠামো উন্নয়নও মানব-উন্নয়নের মাপকাঠিতে ম্লিয়মান হয়ে পড়বে।
তাঁরা আরো বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর অতীতে সংঘটিত প্রতিটি হামলা-ঘটনার মতো শাল্লার হিন্দু অধ্যূষিত নোয়াগাঁও গ্রামে হামলারও তীব্র নিন্দা জানাই, ঘৃণা জানাই এই দুর্বৃত্তদের প্রতি। এই হামলা সহ অতীতের প্রতিটি হামলার সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি যেন জাতি দ্রুতই দেখতে পারে এই জোর দাবী জানান তাঁরা সরকারের প্রতি।
বিবৃতিতে তাঁরা আশা করেন, দেরীতে হলেও সরকার এখনি বিষয়টিকে জনগুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নেবে এবং দেশকে অন্ধকারের পথে নিয়ে যাবার গভীর চক্রান্ত রোধে তৎপর হবে।
কানাডার টরন্টোতে বর্তমানে অবস্থানরত বাংলাদেশের বিশিষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী সহ অপর বিবৃতিদানকারীরা হচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক তাজুল মোহাম্মদ, কবি ইকবাল হাসান, শিল্পী সৈয়দ ইকবাল, সাংবাদিক সুমন রহমান, মুক্তিযোদ্ধা মেজর ( অব: ) দিদার আতাউর হোসেন, মেজর ( অব: ) সুরন্জন দাশ, মানবাধিকার কর্মি ও লেখক শাহ মোস্তাইন বিল্লাহ, শিক্ষাবিদ ফনীন্দ্র কুমার ভট্টাচার্য্য, ড. কুদরতে খোদা, রাজনীতিক শ্যামল দত্ত, লেখক ড. শোয়েব সাঈদ, সাবেক সচিব অপূর্ব বিশ্বাস, প্রকৌশলী ড. জাহিদ হোসেন, লেখক মহসীন বখত, সাংবাদিক, দীপক ধর অপু, কবি দেলওয়ার এলাহী, সাংবাদিক গোপেন দেব, ডা. সুধেন্দু বিকাশ দাশ, সাংবাদিক সদেরা সুজন,লেখক সালমা বাণী, অটোয়া প্রবাসী শহীদ সন্তান ড. শংকর রায় চৌধুরী।
এছাড়া, শাল্লায় হামলার ঘটনার প্রতিবাদে গত শনিবার ( ২০ মার্চ ) কানাডায় একটি ভার্চুয়াল মিটিংও অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত লেখক তাজুল মোহাম্মদের সঞ্চালনায় বিশিষ্ট কবি আসাদ চৌধুরী সহ উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বসবাসরত বিশিষ্টজনরা এতে অংশ নেন। তাঁরা শাল্লায় হিন্দু গ্রামে হামলার সাথে জড়িত দোষীদের দ্রুত বিচার আইনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।