সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়া ঋণের অর্থ ড্রেজিংসহ অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হবে
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অর্থ থেকে ঋণ প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলার বা ৩ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। সাধারণত, তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য সন্তোষজনক রিজার্ভ থাকলেই হয়। কিন্তু বাংলাদেশের রিজার্ভ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে, যে কারণে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের কথা ওঠে।
উৎপাদনশীল খাতে রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে চিন্তা করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন। এরই ধারাবাহিকতায় অবকাঠামো উন্নয়নে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
জানা যায়, রিজার্ভের অর্থ থেকে প্রাথমিকভাবে ৫ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে এই ঋণ দেওয়া হবে। এ লক্ষ্যে গঠন করা হয়েছে বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল। ১০ বছর মেয়াদি এই ঋণের অর্থে বন্দরের ড্রেজিংসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন করা হবে। রিজার্ভের অর্থ দিয়ে প্রথম উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে পায়রা বন্দরের রাবনাবাদ চ্যানেলের ক্যাপিটাল ও মেনটেইনেন্স ড্রেজিং প্রকল্প। এ প্রকল্পে সুদের হার হবে ২ শতাংশ। সোনালী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে দেবে ১ শতাংশ সুদ।
এদিকে রিজার্ভের উদ্বৃত্ত অর্থ থেকে বেসরকারি খাতেও ঋণ দেওয়ার চিন্তাভাবনা চলছে। বিদ্যুৎ খাত এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। পর্যায়ক্রমে অন্যান্য খাতেও ঋণ দেওয়ার বিষয়টি ভাবা হবে। তবে অবকাঠামো খাতই থাকছে শীর্ষ গুরুত্বে।
রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক বলেছেন দেশের অর্থনীতিবিদগণও। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার ড. আতিউর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয়তার বিবেচনায় সরকার সময়োপযোগী একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগেও এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড গঠন ও বোয়িং কেনার সময় রিজার্ভের অর্থ খরচ করা হয়েছে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেখানে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, তার মাধ্যমে যেন ফরেন এক্সচেঞ্জ সাশ্রয় হয়, একই সঙ্গে ফরেন এক্সচেঞ্জ আয়ও হয়। অর্থাৎ যত খরচ হবে, তার চেয়ে যাতে বেশি অর্থ আসে, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
সাবেক এই গভর্নর বলেন, রিজার্ভ হলো দুঃসময়ের সাথি। তাই খরচের বিষয়ে দীর্ঘ মেয়াদের কথা মাথায় রাখতে হবে। সেটা যেন দেশের উন্নতিতে কাজে লাগে। তিনি বলেন, আগে রিজার্ভ ব্যবহার হলেও এখন এটার আনুষ্ঠানিক রূপ পেল। এই ঋণে ঝুঁকি নেই। কারণ, সরকার সভরেন গ্যারান্টি দেবে। সার্বিক বিবেচনায় এই ফান্ড থেকে খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিনিয়োগ করতে হবে। আর এই রিজার্ভ ফান্ড থেকে একবারে বেশি খরচ বা বিনিয়োগ করা যাবে না। সরকারকে ধন্যবাদ যে রিজার্ভ ফান্ড থেকে সরকার ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেওয়ার কথা বলেছে।
প্রসঙ্গত, গত এক দশকে রিজার্ভের পরিমাণ বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। ২০১০ সালে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো। বর্তমানে তা বেড়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিগত সময়ে রপ্তানি খাত চাঙ্গা হওয়া এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের কারণে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার এই রিজার্ভ। বিশ্বব্যাংকের এক হিসাবে দেখা গেছে, সারা বিশ্বেই বেড়েছে রেমিটেন্সের প্রবাহ। বিগত ২০১৭ সাল থেকেই রেমিটেন্স প্রবাহের জন্য উজ্জ্বলতর বছর চলে আসছে।
আগের বছরের তুলনায় সারা বিশ্বে ২০১৭ সালে প্রবাসী আয় সাড়ে ৮ শতাংশ বেড়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ক্রমাগত বেড়েছে রেমিটেন্স প্রবাহ। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে, অর্থাৎ আট মাসে রেমিটেন্স এসেছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৫ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা বেশি। রেমিটেন্স প্রবাহে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ফলেও প্রবাসীরা দেশে অর্থ পাঠিয়েছেন।
ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী বলেন, রিজার্ভের উদ্বৃত্ত অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়নের যে উদ্যোগ সরকার গ্রহণ করেছে, তার সুফল শিগিরই পাওয়া যাবে। উন্নত দেশ হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা এদেশের মানুষের রয়েছে, এই উদ্যোগ তার বাস্তবায়নের পথ সুগম করবে।
ইত্তেফাক/