মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দীন
আমরা সবাই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে বেশ চিন্তিত। আমার ছেলে কেমন হবে! আমার মেয়েটা কেমন হবে! ওদের জীবন নিয়ে, ওদের ক্যারিয়ার নিয়ে প্রতিটি বাবা-মা ভীষণ চিন্তিত! আমরা যারা দেশের বাহিরে আছি, আমাদের চিন্তাটা অবশ্য একটু বেশী। ওদের জীবন, ভবিষ্যত, ক্যারিয়ার নিয়ে একেক বাবা-মার একেক ধরনের চিন্তা-ভাবনা। কেউ চান আমার ছেলে ডাক্তার হোক, কেউ চান আমার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হোক। আবার কেউ চান আমার মেয়ে ভালো একজন শিল্পী হোক। আবার কেউ চান মানবিক সব গুনাবলী নিয়ে যেন আমার সন্তান ভালো একজন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্টিত হোক। কেউ কেউ জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দেন। আবার কেউ ধর্মীয় শিক্ষাকে তোয়াক্কা না করে শুধু জাগতিক শিক্ষাকে বেশি বেশি প্রাধান্য দেন। একেক পিতা-মাতার একেক রকম চিন্তা ভাবনা। আসলে নির্ভর করে আমরা কে-কি চাই?
আমরা যারা পরকালের বিশ্বাস করি। আপনি হয়তো ভাবছেন আপনার ছেলে বা মেয়ে খুবই প্রতিষ্টিত। চিন্তা নেই! পড়াশুনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করছে। দামি গাড়ি! সুন্দর বাড়ি! সুন্দর জীবন! বেশ ভালোইতো আছে! কিন্তু তার মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের খুবই অভাব। হালাল-হারামের মধ্যে তফাৎ সে বুঝে না। ইসলামী অনুশাসন মেনে চলেনা। নামাজ রোজার প্রতি উদাসীনতা! পরকালের প্রতি বিশ্বাস কম। আবার ধরুন আপনার ছেলে নামাজ পড়ে, রোজাও রাখে। কিন্তু অবৈধভাবে উপার্জন করে। লোকজনের সাথে খারাপ আচরণ করে। বাব-মার সাথে খারাপ ব্যবহার করে। অন্যের সম্পত্তি দখল করে, লুঠ করে। আপনি কি মনে করেন যে, সে একজন সফল মানুষ এবং আপনিও একজন সফল অভিবাভক! অনেকে এটাকে সফলতা মনে করেন আবার কেউ কেউ নিজের ব্যর্থতাও স্বীকার করেন!
প্রিয় জামিল ভাই (Scotia Jamil) বেশ আগে ঊনার ফেইসবুক ওয়ালে একটা পোষ্ট দিয়েছিলেন – “আপনার সন্তান কতোটা ব্রিলিয়েন্ট সে ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার নাকি জজ-ব্যারিস্টার হচ্ছে, সেটা নিয়ে বড়াই না করে বরং সে আসলে ‘মানুষ’ হচ্ছে কিনা পারলে সেটা নিশ্চিত করুণ”। সেটা আমরা অনেকেই ভাবি!
একটা সত্য ঘটনা। আমেরিকার এক শহরে এক বাংলাদেশী পরিবার বসবাস করতেন। একটি মাত্র ছেলে। বাব-মার বড় আদরের সন্তান। ছেলেকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন। ছেলে গ্রেইড ১১-এ পড়তো। পড়ালেখায় সে খুবই ভালো ছিল, তাই বাব-মার স্বপ্নও ছিল অনেক বড়। ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সবরকম প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বাবা-মা হঠাৎ ওর মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। ছেলে নামাজ পড়ে। বাসায় কোরআন পড়ে এবং ইসলামি বই-পুস্তক পড়ে। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে একটু দেরিতে বাড়ি ফিরে। হঠাৎ একদিন সে মা’কে ফোন করে বলল মা, আমি তিন দিন পর বাড়ি ফিরবো। আমি তিন দিনের জন্য তাবলীগ জামায়াতে যাচ্ছি। বাবা-মা এটা কিছুইতে মেনে নিতে পারলেন না। ঊনারা খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। ভাবলেন ওর কি হলো? কোন জংগীবাদের সাথে জড়িয়ে পড়লো নাকি! তিনদিন পর সে যখন বাড়ি ফিরলো। বাবা-মা খুবই উত্তেজিত হয়ে ছেলেকে অনেক বকাঝকা করলেন এবং কিছুটা মারধরও করলেন। মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবকেও শাসিয়ে আসলেন, বললেন ঊনার ছেলের ব্যাপারে আর যেন বাড়াবাড়ি না করতে। ইমাম সাহেবকে এক ধরনের অপমানিত করলেন। ছেলেকে কড়াকড়িভাবে বলে দিলেন মসজিদে যেন আর না যেতে। নামাজ পড়লে বাসার যেন পড়ে। ছেলে ঊনাদের এই আচরণে খুবই কষ্ট পেল। সেও আস্তে আস্তে নামাজ পড়া ছেড়ে দিল। কিছুদিন পর বাবা-মা ছেলের মধ্যে অন্য রকম একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। ছেলের লেখা-পড়ার গ্রতি মনোযোগ নেই। স্কুল ছুটির পর একটু দেরিতে বাড়ি ফিরে। বাব-মার সাথে কথা কম বলে। নিজের রুমে দরজা লাগিয়ে সারাক্ষণ বসে থাকে। তাঁর কথা-বার্তা, চাল-চলন সবদিকেই কেমন যেন একটা পরিবর্তন! খাওয়া দাওয়াতে কোন রুচি নেই। যতদিন যাচ্ছে অবস্থার তত অবনতি ঘটছে। স্কুলও মিস দিচ্ছে। পড়ালেখার প্রতি তার কোন মনযোগই নেই। বাব-মার আর বুঝতে আর দেরি হয়নি ছেলে যে ড্রাগে আসক্ত! ছেলের এই অবস্থা দেখে ঊনাদের একেবারে ঘুম হারাম। এদিকে মা কান্নাকাটি করছেন। একটি মাত্র ছেলে। ছেলেকে অনেক চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনতে পারছেন না। উপায়ান্তর না দেখে একদিন মসজিদের ইমাম সাহেবকে গিয়ে সবকিছু খুলে বললেন এবং ঊনার কাছে ক্ষমা চেয়ে ছেলেকে আবার মসজিদে ফিরিয়ে আনার জন্য সজোরে বিনীত অনুরোধ করলেন। ইমাম সাহেব বললেন, এখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। আপনারা চেষ্টা করুণ। বাবা-মার ধর্মের প্রতি অজ্ঞতা এবং বেশি বাড়াবাড়ির জন্য আজ ছেলের এত বড় সর্বনাশ!
আরেকটি ঘটনা। আমেরিকার নিউইয়র্ক সিটিতে আরেক বাংলাদেশী পরিবার। ছেলে লেখা পড়া শেষ করে ভালো একটা চাকরি করছে। দামি গাড়ি আর সুন্দর বাড়ি! নম্রভদ্র, অমায়িক ছেলে! মানবিক সব গুনাবলীই ওর মধ্যে আছে, যেটা প্রত্যেক বাবা-মা তাঁদের ছেলে-ময়েদের কাছ থেকে আশা করেন। সবার শখ থাকে, ছেলে একদিন বড় হবে, ভালো চাকরি করবে, তারপর সুন্দর একটা মেয়ে দেখে বিয়ে দিবো। নাতি-নাতনি হবে। কত স্বপ্ন! কত প্রত্যাশা! ছেলে বড়। বিয়ের উপযুক্ত। ছেলেকে বিয়ের জন্য বাব-মা চাপ দিচ্ছেন। ছেলে কিছুতেই রাজী হচ্ছে না। শুধু সময় নিচ্ছে। এদিকে মা আর কত অপেক্ষা করবেন। মা যখনই বিয়ের কথা বলেন, ছেলে আরেকটু সময় নেয়। কিন্তু আর কত! মা ভাবছেন, ছেলে মনে হয় কাউকে পছন্দ করে, লজ্জায় হয়তো আমাদের বলছেনা। মা ছেলেকে একদিন ডেকে বললেন, বাবা ‘তোর পছন্দের কেউ থাকলে বল্’। ছেলে কিছু বলছেনা। মা আবারো একদিন ডেকে ছেলকে বললেন। ‘তোর যাকে পছন্দ হয় শুধু বল, আমরা তাঁর সাথে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করবো’। ছেলে রাজি হলো, বলল ঠিক আছে আমি আমার পছন্দের মানুষ নিয়ে আসবো। মা’তো মহা খুশি। ভাবছেন যাক ছেলে শেষ পযর্ন্ত রাজি হলো। একদিন ছেলে ঠিকই তাঁর পছন্দের মানুষকে নিয়ে আসলো। তাঁর পছন্দের মানুষটি হলো আরেকটা ছেলে, যাকে সে বিয়ে করবে! এই বেদনাটুকু একজন মা ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ বুঝবে না! আমরা যে ধর্মেরই হই না কেন, কোন পিতা-মাতা এটাকে মেনে নিতে পারবে না। ছেলেকে সঠিক সময়ে ইসলামের সঠিক শিক্ষা দেননি বলেই আজ এই অবস্থা!
শৈশবই হল সন্তানের সুশিক্ষার শ্রেষ্ঠ সময়।বাচ্চাদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা একেবারে ছোটবেলা থেকেই দিতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা থাকলে সে পৃথিবীর যেখানেই যাক না কেন, যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে নিজেকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে এবং পথভ্রষ্ঠ হবেনা। ভাল-মন্দ বুঝতে পারবে। ন্যায়-অন্যায় বুঝতে পারবে। হালাল-হারাম বুঝতে পারবে।আর ধর্মীয় শিক্ষা না হলে সে যত বড়ই শিক্ষিত হোক না কেন পথভ্রষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। যেমন বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত আমেরিকা প্রবাসী উচ্চশিক্ষিতা ইয়াশরিকার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে। প্রায় অর্ধ মিলিয়ন ডলার খরচ করে নিজের পছন্দের আরেক নারীকে বিয়ে করলেন বাংলাদেশের মেয়ে ইয়াশরিকা জাহরা হক। আমেরিকান নারী এলিকা রুথ কাকলিকে (৩১) সম্প্রতি বিয়ে করে ঘরনি হলেন ৩৪ বছর বয়সী ইয়াশরিকা। উত্তর আমেরিকায় ইয়াশরিকাই সম্ভবত প্রথম বাংলাদেশি নারী, যিনি সমলিঙ্গের আরেক মেয়েকে বিয়ে করে পেতেছেন ভালোবাসার সংসার। ২০১৯ সালের ৭ জুন বাংলাদেশী কায়দায় নিউইয়র্কে ইয়াশরিকা তাঁর পছন্দের নারী এলিকা রুথ কাকলিকে বিয়ে করেন। এদিকে আবার যুক্তরাজ্যে সমলিঙ্গের সঙ্গীর সঙ্গে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক মুসলিম তরুণের বিয়ে হয়েছে৷ বিভিন্ন ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম জানায়, ব্রিটিশ মুসলিম জনগোষ্ঠীতে এটিই প্রথম সমকামী বিয়ের ঘটনা!
আমরা যারা দেশের বাহিরে আছি, আমাদের সামনে খুব কঠিন সময় আসছে। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের ছোট বেলা থেকেই ইসলামের সঠিক শিক্ষা দিতে পারি, তাহলে তাঁদের বংশধর এবং পরবর্তী বংশধর এবং তাঁর পরের রংশধর এভাবে বংশ পরম্পরায় ইসলামের ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে। আর যদি তাঁদেরকে ইসলামের সঠিক শিক্ষা সঠিক সময়ে দেওয়া না হয় তাহলে তাঁদের পরবর্তী এক বা দুই জেনারেশন পর ইসলামের অস্তিত্ব আর খোঁজে পাওয়া যাবে না। যেমনটি ঘটেছে লন্ডনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন-এর ক্ষেত্রে। বরিস জনসনের প্রপিতামহ অর্থাৎ তার দাদার বাবার নাম ছিল আলী কেমাল। জাতিতে তুর্কি মুসলিম। তিনি একজন কোরআনে হাফেজও ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন Winifred Brun-কে। মাত্র দুই জেনারেশন পর তাঁদের বংশধরের মধ্যে ইসলামের কোন অস্তিত্বই আর খোঁজে পাওয়া যায় নি। এটা আমাদের সবার জন্য একটা লেসন! শুধু রবিস জনসন না, আমাদের চারপাশে হয়তো আরো অনেক রবিস জনসন পড়ে আছেন, আমরা জানিনা!
জাগতিক শিক্ষার যেমন গুরুত্ব রয়েছে তেমনি ধর্মীয় শিক্ষারও গুরুত্ব রয়েছে। মানুষের কল্যান, পার্থিব প্রয়োজন পূরণ এবং সামাজিক ব্যবস্হাপনা ও ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য জাগতিক শিক্ষার বিকল্প নেই। বহু ধর্মীয় কাজের জন্যও জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। দুনিয়ার নিয়ম এবং ব্যবস্হাপনা ঠিক রাখার জন্য যেমন জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজন তেমনি দ্বীনের হিফাজতের জন্য এবং দুনিয়ার সকল কাজ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনী শিক্ষার প্রয়োজন।
ধর্মীয় শিক্ষা না থাকলে ধর্ম সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করা অনেক সহজ। বিশেষত, ইসলামের অপব্যাখ্যা করে একটি পক্ষ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একদিকে মুসলমান তরুণদের সহজেই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে, অন্যদিকে এসব সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডকে কাজে লাগিয়ে পশ্চিমাবিশ্ব ইসলামভীতি ছড়াচ্ছে। সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। ধর্মীয় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো সন্তানকে মানুষরূপে গড়ে তোলা। যে শিক্ষা আত্মপরিচয় দান করে, মানুষকে সৎ ও সুনাগরিক হিসেবে গঠন করে এবং পরোপকারী, কল্যাণকামী ও আল্লাহর প্রতি অনুরাগী হতে সাহায্য করে, সে শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত করে, দূরদর্শিতা সৃষ্টি করে। আমরা যতবড় জ্ঞানী হই না কেন, আমাদের যদি কোরআন-হাদীসের জ্ঞান না থাকে তবে সে জ্ঞান একবারেই মূল্যহীন। তাই ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন “তুমি যতবড় জ্ঞানীই হও না কেন- যদি তোমার মধ্যে ইসলামের জ্ঞান না থাকে, তাহলে তুমি একজন মূর্খ ছাড়া কিছুই নও”।
ধর্মীয় শিক্ষা অর্জন করা সব মানুষের উপর ফরজ। তাই বাচ্চাদের দৈনন্দিন ইবাদতে এবং জীবন যাপনের জন্য যতটুকু ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা দরকার কমপক্ষে ততটুকু ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্হা করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। সেই সাথে সন্তানের উন্নত চরিত্রগঠন, ভদ্রতা, শিষ্ঠাচার এবং ব্যবহারিক জীবনে আমলের অভ্যাস তৈরি করতে দ্বীনি শিক্ষাও দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- “কোন পিতা তার সন্তানকে ভালো আদব তথা শিষ্ঠাচার শিক্ষা দেয়া থেকে উত্তম কোন পুরস্কার দিতে পারে না” [তিরমিযি]। সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা দিয়ে গড়ে তোলার দায়িত্ব পিতামাতার। আল্লাহ্ কোরআনে বলেছেন – “দোজখের আগুন থেকে তোমার নিজেরাও বাঁচো এবং তোমাদের পরিবারকেও বাচাও।” [ সূরা তাহরীম, আয়াত- ৭]। সন্তানকে দ্বীনের প্রয়োজনীয় বিষয়াদি শেখানো পিতা-মাতার উপর ফরজ। এটা না শেখানো সন্তানের উপর সবচেয়ে বড় জুলুম। আল্লাহর কাছে বাবা-মাকে এ ভুলের জন্য জবাব দিতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “জেনে রেখো, তোমরা প্রত্যেকে দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। পুরুষ তার পরিবার বর্গের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। তাদের ব্যাপারে তাকে জবাবদিহি করতে হবে। [সহীহ বুখারী ১/২২২-৮৯৩]
এদেশে বাচ্চাদের মানুষ করা, সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলা, যুদ্ধে জয়ী হওয়ার চেয়েও আরো কঠিন কাজ। বাংলাদেশে আমরা যেভাবে বড় হয়েছি বলা যায়, আমরা অনেকটা অটো মুসলমান। বাংলাদেশ যেখানেই যান সব জায়গাই একই কালচার, একই চিত্র। যে চুরি করে আর যে ঘুষ খায়, সেও শুক্রবারে নামাজে যায়। না গিয়ে উপায় নেই! কারণ সবাই নামাজ পড়ছে। কেউ না জানলেও দেখে দেখে শিখে ফেলে। বাংলাদেশে আমাদের পিতা-মাতা আমাদের নিয়ে এত চিন্তা করেননি। আমরা যারা দেশের বাইরে আছি, আমাদের অবস্থাটা একটু ভিন্ন। এখানে ঘরে একরকম পরিবেশ, স্কুলে আরেকরকম পরিবেশ, বাহিরে গেলে অন্যরকম অবস্থা। বাংলাদেশে একজন বাব-মা সন্তানের পিছনে যে সময় দেন, এখানে আমাদেরকে সন্তানদের পিছনে তার দশগুন সময় দিতে হবে। সঠিক সময়ে ইসলামের সঠিক শিক্ষা দেননি বলে অনেক বাবা-মা আজ নিরবে চোখের জল ফেলছেন। সন্তানদেকে এখানে বাংলাদেশী স্টাইলে শাসন করলে হবেনা, হিতে বিপরীত হতে পারে। তাঁদেরকে তাঁদের মতো করে বুঝিয়ে, আদর করে শিখাতে হবে। এজন্য ছেলে-মেয়েদের সাথে আমাদের সব সময় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা উচিত। কানাডাতে গত কয়েক বছরে প্রায় পনেরো জন বাংলাদেশী ছাত্র আত্মহত্যা করে। এর মূল কারণ ছিল পিতা-মাতার সাথে সন্তানের সুসম্পর্কের অভাব!
সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়ার আগে আমাদের নিজেদেরকে প্রথমে ধার্মীক হতে হবে, ইসলাম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে হবে। কোরআন এবং হাদীসের জ্ঞান থাকতে হবে। আমরা নিজেরা যদি সংশোধন না হই তাহলে কি করে আশা করবো উত্তম চরিত্রবান সন্তানের। আমি যদি নামাজ না পড়ি তাহলে আমার ছেলে নামাজ পড়বে না। আমি যদি হালাল-হারাম মেনে না চলি, তাহলে সেও মানবে না। আমি ইসলামি অনুশাসন মেনে চললে, সেও মানবে। ওরা আমাদের দেখেই শিখবে। আমাদেরকে তাদের সামনে রোল মডেল হতে হবে। আমরা এবং আমাদের ঘরকে ঐ রকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যেখান থেকে ওরা দেখবে এবং শিখবে। সন্তানদের মানুষ করার জন্য আমরা যতই ভালো প্রতিষ্টানেই ওদেরকে দেইনা কেন আমরা নিজেরা এবং আমাদের ঘর যদি ঠিক না থাকে তাহলে কোন শিক্ষা প্রতিষ্টান কিংবা কোন শিক্ষকই ওদেরকে সুসন্তান বানাতে পারবে না। সন্তানেক সুশিক্ষিত করার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্টান হলো নিজের ঘর। আমরা বাবা-মা হলাম ওদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক!
নিজেকে সংশোধন করার জন্য ইচ্ছা শক্তিই যতেষ্ঠ। আল্লাহ্ হেদায়াত করলে, যে কাউকে কোন কে কোন সময় হেদায়াত করতে পারেন। আল্লাহ্ কোরআনে বলেন – “আল্লাহ্ যাকে হেদায়াত দেন সে-ই সঠিক পথ লাভ করে। আর আল্লাহ্ যাকে গোমরাহ্ করেন তার জন্য তুমি কোন অভিভাবক কিংবা পথপ্রদর্শক পাবে না”। [সূরা আরাফ: ১৭৮]। সম্প্রতি বাংলাদেশের তথাকথিত এক বুদ্ধিজীবী ড. এনায়েতুল্লাহ আব্বাসীর সাথে টকশোতে এসে যেভাব নাজেহাল হয়েছিলেন। নিজের ভুলগুলো হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। মাশাল্লাহ্,! তিনি এখন কোরআন শিখছেন। কোরআন পড়ছেন। ইসলামের কথা বলছেন। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজেকে সংশোধন করে নিয়েছেন। এজন্য আমরা এবং আমাদের সন্তানদের হেদায়েতের জন্য আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া করা উচিত। সন্তানের জন্য বাবা-মার দোয়ার কোন বিকল্প নেই। পিতা-মাতার দোয়া আল্লাহ্ সাথে সাথে কবুল করেন। সন্তান যদি পথভ্রষ্ঠ কিংবা অবাধ্য হয়েও যায়, তাঁর জন্য বদদোয়া না করে আল্লাহর কাছে তাঁর হেদায়াতের জন্য আমাদের দোয়া করা উচিত।
আমরা অনেকেই মনে করি আমার ছেলে নামাজ পড়ে, রোজা রাখে। ইসলামের মধ্যেইতো আছে। কিন্তু শুধু নামাজ পড়া আর রোজা রাখার নামইতো ইসলাম না। ইসলাম হলো একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্হা। জীবনের সবকিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমে করা এবং চলার নাম ইসলাম। মানবজাতির হেদায়াত এবং পথ প্রদর্শক হিসেবে আল্লাহ্ কোরআন নাজিল করেছে। জন্ম থেকে মৃত্যু পযর্ন্ত সবকিছুই এ মহাগ্রন্ত্রে বলা হয়েছে। নৈতিক মানদণ্ডের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আল-কুরআন। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব বিষয়ের সবিস্তার ভারসাম্যপূর্ণ বিধান প্রণীত হয়েছে এ গ্রন্থে। তাই সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের জন্য কুরআনের শিক্ষার বিকল্প নেই। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন- “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কোরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়”।[বুখারী:৫০২৭]। এ কুরআনের সুশিক্ষাই মানুষের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশু-কিশোরদেরকে সঠিক জীবন ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের কারিগর হিসেবে তৈরি করতে পারে। আমাদের জীবনের সকল কাজ ইসলামের বিধান মোতাবেক করার জন্য ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প নেই। কোরআন এবং রাসূলের সুন্নাহর মধ্যে জীবনের সকল কল্যাণ নিহিত। আর ইসলামই হচ্ছে সর্বত্তোম জীবন ব্যবস্হা।
প্রতিটি সন্তানই জন্ম নেয় নিষ্পাপ হয়ে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং মা-বাবার অহহেলা এবং দায়িত্বজ্ঞানহীনতা কারনে কারনেই সন্তান খারাপ পথে পা বাড়ায়। তাই সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, কি করছে, কি দেখছে সবকিছু দেখাশোনা করা আমাদের একান্ত দায়িত্ব। ভালো বন্ধু এবং খারাপ বন্ধু বাচ্চাদের চরিত্রে খুবই প্রভাব ফেলে। তাই ভালো বন্ধু জোগাড় করে দিতে আমাদেরকে সহযোগিতা করা দরকার। ইলেকট্রনিকস বিশেষ করে ভিডিও গেম থেকে বাচ্চাদের যত সম্ভব দূরে রাখা উচিত। ভিডিও গেম একধরনে নেশা। এই নেশা বাচ্চাদের পড়ালেখায় এবং ইসলাম চর্চায় বিমুখ করে রাখে। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া ছোট বাচ্চাদের কোনো অবস্থায় মোবাইল ফোন দেওয়া উচিত নয়। ইলেকট্রনিকস ব্যবহারে বাচ্চাদের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত। আমি আমেরিকাতে এক পরিবারকে দেখেছি, উনাদের দুই ছেলে গ্রেইড ৯ এবং ১০-এ পড়তো। রাতে ঘুমানোর সময় মা’র কাছে ফোন রেখে ওরা ঘুমাতে যেত। কম্পিউটার ছিল ওদের লিভিং রুমে। বাচ্চারা কি করছে, কি খেলছে সবার সামনে তা উন্মুক্ত ছিল।
সন্তান আমাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় এক নেয়ামত। আল্লাহ্ কোরআনে বলেছেন -“তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা সন্তান এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদেরকে দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল”[ সূরা শূরা:৪৯-৫০]। আল্লাহ্ আমাদেরকে সন্তান দিয়ে এবং না দিয়ে পরীক্ষা করেন। দুনিয়াটা হচ্ছে আমাদের জন্য একটা পরীক্ষার জায়গা। আল্লাহ্ কোরআনে বলেছেন – “সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। (এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে) তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে মহাপুরস্কার রয়েছে” [সুরা আনফাল : ২৮]।
আমরা যারা পরকালে বিশ্বাস করি। আমাদের সবাইকে তাঁরই কাছে ফিরে যেতে হবে যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ্ কোরআনে বলেন -“আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনিই তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন। তারপরও মানুষ অতি-অকৃতজ্ঞ!” [সূরা হজ: ৬৬]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ মানুষ যখন মৃত্যুবরণ করে, তখন তার সমস্ত আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় কেবল তিনটি আমল ব্যতীত। যথাঃ ১) ছাদাক্বায়ে জারিয়াহ। যেমন, মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা, রাস্তা ও বাঁধ নির্মাণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থাকরণ, দাতব্য চিকিৎসালয় ও হাসপাতাল, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি। ২) ইলম, যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। যেমন, যা মানুষকে নির্ভেজাল তাওহীদ ও সহীহ সুন্নাহর পথ দেখায় এবং যাবতীয় শিরক ও বিদ‘আত হ’তে বিরত রাখে। ৩) সুসন্তান, যে তার জন্য দো‘আ করে। যেমন, মৃতের জন্য সর্বোত্তম পুরস্কার হ’ল সুসন্তান বা নেক সন্তান, যে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, ছাদাক্বা করে, তার পক্ষ হ’তে হজ্জ করে ইত্যাদি। [মুসলিম: ১৬৩১, মিশকাত: ২০]
সন্তানের দোয়া ও নেক আমলের অংশীদার হয় বাবা-মা। সুসন্তান রেখে যাওয়ার মানেই হলো বাবা-মার জন্য পরকালের অবিরত সঞ্চয়পত্র খুলে যাওয়া। এ নেক সন্তানের উসিলায় মৃত্যুর পর বাবা-মার নেক আমল চালু থাকবে। সুসন্তানই হবে পরকালের মুক্তির সর্বোচ্চ উপলক্ষ। সুতরাং দুনিয়ার সব বাবা-মার উচিত, নিজেদের সন্তানকে দ্বীনি শিক্ষায় গড়ে তোলা। সন্তানের প্রতি যথাযথ দায়িত্ব পালন করা। যে শিক্ষা পেয়ে সন্তান হবে দুনিয়ার রিজিক প্রাপ্তি ও পরকালের মুক্তি লাভের অনন্য উপায়।
সন্তানরাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আমাদের স্বপ্ন।ছেলে বা মেয়ে ডাক্তার হলো, না ইঞ্জিনিয়ার হলো সেটার পাশাপাশি তারা এবং তাদের বংশধর যাতে ইসলামকে আকড়ে ধরে রাখতে পারে সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদের। তা না হলে আমাদেরকে আল্লাহর কাটগড়ায় দাড়াতে হবে। সন্তানের জন্য সম্পদ রেখে যাওয়ার চেয়ে সন্তানকে সম্পদে পরিনত করাটাই বেশী প্রয়োজন।
আসুন, আমরা এই ব্যস্ততম জীবনের ব্যস্ততার ফাঁকে নিজেকে সংশোধন করে আমাদের সন্তানদের একটু কোয়ালিটি সময় দিয়ে জাগতিক শিক্ষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে তাঁদেরকে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তুলি। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে যেন সেটা বোঝার এবং আমল করার তৌফিক দান করেন।