স্বপ্নদ্রষ্টারা প্রস্থান করেন না
জানুয়ারির শেষের দিকে কোনো একদিনের বিকেল। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে ফোন করলাম। উদ্দেশ্য, ব্যাংকিং খাতের দুর্নীতি নিয়ে তার কমেন্ট নেওয়া। যখন স্পর্শকাতর কোনো অনিয়মের ঘটনা সামনে আসতো, সাংবাদিকদের কাছে তিনি ছিলেন অন্যতম ভরসা। কারণ, সুনির্দিষ্ট ব্যবসায়িক গ্রুপের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দেশের আর্থিকখাতের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করতেন। কেননা, এরাই দেশের ব্যাংক-বীমা, রাজনীতি ও ক্ষেত্রে বিশেষে গণমাধ্যমও নিয়ন্ত্রণ করেন। এদের বিরুদ্ধে কথা বলা ভীষণ কঠিন।
কিন্তু, ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন এর বিপরীত। ওইদিন তিনি জানালেন, শরীর তার বেশ খারাপ এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ফলে অপেক্ষা করছিলাম, কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার মতো উচ্চকিত কণ্ঠস্বর খুব একটা ছিলেন না। তখনও বুঝতে পারিনি, আমার এই অপেক্ষা আর কখনোই শেষ হবে না। আমার আর তার কথোপকথনের এটিই ছিল সর্বশেষ অধ্যায়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার কথা বলার শক্তির উৎস কোথায় ছিল? তার জীবন ছিল খোলা বইয়ের মতো। চার দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাংকিং খাতে তিনি কাজ করেছেন। ১৯৯৪-৯৫ সালে তিনি কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর একই পদে কাজ করেছেন সোনালী ও অগ্রণী ব্যাংকে।
১৯৯৮ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর। এর পর বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংকে আবার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। তার যোগ দেওয়ার আগে খেলাপি ঋণে জর্জরিত ওই ব্যাংকের অবস্থা ছিল ভীষণ খারাপ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূবালী ব্যাংকতে ‘প্রবলেম ব্যাংক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু, ইব্রাহিম খালেদের শক্ত নেতৃত্বে সেই ব্যাংক ঘুরে দাঁড়ায়। লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
২০১০ সালে একশ্রেণির চিহ্নিত জালিয়াত চক্রের কারণে পুঁজিবাজার বিপর্যস্ত হলো। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের জন্য ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে কমিটি গঠন করে সরকার।
অনুসন্ধানের পর তিনি সরকার থেকে শুরু করে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ একচেঞ্জ কমিশনের দিকে আঙ্গুল তুললেন। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দুর্দশার জন্য এরা সবাই দায়ী। পুঁজিবাজারে সাধারণ মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার সঙ্গে যুক্ত রাঘব-বোয়ালদের কথা নির্ভীকভাবে তিনি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন। এমন একটা সময়ে তিনি এদের নাম উল্লেখ করেছিলেন যখন দেশের আর্থিকখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ক্ষেত্রবিশেষে এদের দুর্নীতি আড়াল করতে বাধ্য হন।
ব্যাংকিং সুবিধা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হওয়ার পর খুব সম্ভবত ওই পর্যায়ে পদধারী একজন ব্যক্তি প্রথমবারের মতো গ্রামে সফর শুরু করে। ১৯৯৪ সালে ব্যাংকের সংখ্যা ছিল হাতে গোণা। ফলে কোনো ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মানে বিশাল পদবী। গ্রাম-গঞ্জে কৃষকদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করতেন। তাদের সমস্যার কথা শুনতেন। পাশাপাশি ত্বরিৎগতিতে তাদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করতেন। কৃষকদের সমস্যা সমাধানের জন্য বিভিন্ন জেলায় প্রশাসকদের সঙ্গেও বৈঠক করতেন।
পরে কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জে জন্ম নেওয়া ইব্রাহিম খালেদের একাডেমিক ক্যারিয়ারও ছিল উজ্জ্বল। ১৯৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হন। এরপর ১৯৬৩ সালে সেখান থেকে এমএ সম্পন্ন করেন। পরে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
ইব্রাহিম খালেদ এমন এক সময় চলে গেলেন যখন ব্যাংকিংখাতের সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। দেশের ৩৬টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিকপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে কমপক্ষে ১০টি সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকা ফেরত দিতে পারছে না। গোটাজীবন চাকরি করে অনেকে এসব প্রতিষ্ঠানে টাকা আমানত রেখেছিলেন, যাতে একটা নিরাপদ ভবিষ্যৎ পাওয়া যায়। তাদের জন্য হয়তো অপেক্ষা করছে আরও নিকষ অন্ধকারের দিন। সবকিছু ভেঙে পড়ার সময়ে এদের জন্যই কথা বলতেন ইব্রাহিম খালেদ, যাতে নতুন কিছু নির্মাণ করা যায়।
ব্যাংকিংখাতের শুধুমাত্র একজন বিশেষজ্ঞই তিনি ছিলেন না, ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন একজন অ্যাকটিভিস্টও। গণমাধ্যমে সেল্ফসেন্সরশিপের এই যুগে তিনি ছিলেন রিপোর্টারদের সাহসের অন্যতম কেন্দ্রস্থল। আর্থিকখাত থেকে টাকা পাচারের বিরুদ্ধে তিনি নিয়মিত গণমাধ্যমে লেখার পাশাপাশি সাংবাদমাধ্যমের প্রতিবদনে নিজের শক্তিশালী মতামত দিতেন। এই প্রক্রিয়ায় সাংবাদিকদের তিনি নিরন্তর সাহস জুগিয়েছেন বছরের পর বছর।
২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশে স্বাধীন জাতীয় পুঁজি শক্তিশালী হওয়ার বিষয়টি দৃশ্যপটে আসে। এখানে গড়ে ওঠতে থাকে শক্তিশালী বেসরকারিখাত। কিন্তু, একই সময়ে দুর্নীতিবাজরা আর্থিকখাত থেকে টাকা লুটের নিত্যনতুন কলাকৌশল নিয়ে আসে। হয়তো বাংলাদেশ আজ ভিয়েতনামের অর্থনীতির সঙ্গে সমানতালে পাল্লা দিতে পারতো, যদি এসব দুর্নীতি সময়মতো মোকাবেলা করা যেত।
ইব্রাহিম খালেদ সংকটের এই বিষয়গুলো উন্মোচন করে গেছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থাকাকালে (১৯৯৮ – ২০০০) তিনি একটি অনুষ্ঠানে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার উপস্থিতিতে বলেছিলেন, মাফিয়ারা এখন ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছে। জনসমক্ষে তার ওই বক্তব্য অর্থমন্ত্রীকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে বাধ্য করেছিল।
আর্থিকখাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সংকটে পড়ছে আরও অনেক ব্যাংক। ব্যাংকিংখাতের আইনকানুন পরিবর্তন করে খেলাপিদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বৈশ্বিকক্ষেত্রে চর্চা করা বহুলপ্রচলিত নিয়মগুলোকে এখানে আর অনুসরণ করা হচ্ছে না। এর মাধ্যমে খোলাপি ঋণ কৃত্রিমভাবে কম দেখানো হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। ইব্রাহিম খালেদের ভাষায় এটা হচ্ছে এক ধরনের টাইম বোমা, যা ওত পেতে আছে অর্থনীতিতে। এটা যদি নির্মূল করা না যায়, তাহলে সামনের দিনগুলোতে দেশের অর্থনীতি আরও বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে। এসব সংকট নির্মূলের কোনো উদ্যোগ দেখার আগেই ইব্রাহিম খালেদের প্রস্থান। অন্ধকারের মাঝে শূন্যতা আরও গ্রাস করল আমাদেরকে।
ব্যক্তিজীবনে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না তিনি। চাকরির পর পেনশনের টাকার একটা অংশ সঞ্চয়পত্রে রেখেছিলেন। আর তা দিয়েই জীবন চালাতেন। জানুয়ারির শেষদিকে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর প্রথমে একটা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তার ঘনিষ্ঠ একজন জানান, সেই হাসপাতালের বিল পরিশোধ করতে গিয়েও তার পরিবারকে সংকটে পড়তে হয়েছিল।
এতসব কিছুর পরও ইব্রাহিম খালেদ ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। জীবনভর স্বপ্ন দেখেছেন সুন্দর আর্থিকখাতের, যেখানে দুর্নীতি থাকবে না। এখন সেই স্বপ্ন বহন করার দায়িত্ব আমাদের সবার। মাস্টার দা সূর্যসেনের ফাঁসির আগমুহূর্তের বাণী ভীষণভাবে মনে পড়ছে—
‘এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি।’
এ কে এম জামীর উদ্দীন: সিনিয়র রিপোর্টার, দ্য ডেইলি স্টার