সিসিটিভির ফুটেজে গুলির দৃশ্যবক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য চলছিলো দীর্ঘদিন থেকেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের দুই গ্রুপের বিরোধ তুঙ্গে। স্বঘোষিত কমিটি, বহিষ্কার সবই চলছিলো। পাল্টাপাল্টি সমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রশাসন ১৪৪ ধারাও জারি করেছিল। দু-এক মাস ধরেই বিষয়টি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’। দলীয় নেতাকর্মীরা বিষয়টি জানিয়েছেন দলটির শীর্ষ নেতাদেরও। তারপরও থেমে থাকেনি বিরোধ। কেউ থামায়নি তাদের।
শেষ পর্যন্ত রক্ত ঝরেছে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে। দুই গ্রুপের সংঘর্ষ-গুলির ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন অনেকে। রাজনৈতিক এ লড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন একজন সাংবাদিক। এ ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি এখনো। বরং দুই পক্ষই মাঠে সক্রিয়। জনমনে প্রশ্ন জেগেছে, প্রশাসন ও দলের হাই কমান্ড অবগত থাকার পরও একটি তাজা প্রাণ কীভাবে ঝরে গেল, কেন থামানো যাচ্ছে না আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই পক্ষকে, কি হচ্ছে নোয়াখালীতে? কারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে। স্থানীয় প্রশাসনই বা কি করছে। উত্তাপ-উত্তেজনা, প্রকাশে রাজপথে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়ার পরও কাউকে গ্রেপ্তার না করা, মামলা না হওয়ার পেছনে কারণই বা এ নিয়ে মানুষের মাঝে নানা প্রশ্ন।
দলীয় বিরোধ নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল কাদের মির্জা। এরমধ্যেই পার হয়েছেন নির্বাচনী বৈতরণী। বসুরহাট পৌরসভার মেয়র কাদের মির্জা উপজেলার একজন নেতা হলেও তার বক্তব্যে আলোচনা হয় সর্বত্র। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই। তিনি দলের নেতাদের দ্বন্দ্ব, অনিয়ম, দুর্নীতির কথা বলেন। অপরদিকে, কাদের মির্জার বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অভিযোগ করে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায় অপর পক্ষ। সংবাদ সম্মেলন করে নোয়াখালী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ পিন্টু বলেছেন, কাদের মির্জা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি ঘোষণা করেন, যা দলের গঠনতন্ত্র পরিপন্থি। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার আগে আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড, জেলা আওয়ামী লীগ ও তৃণমল পর্যায়ের নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে (মির্জা) নিজেই উপজেলার ৮টি ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের নাম কোন্ ক্ষমতাবলে ঘোষণা করেন? আমরা তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। বিতর্ক ছড়িয়েছে দেশজুড়ে। নির্বাচন ও দলের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় পাল্টাপাল্টি বক্তব্য এসেছে ফরিদপুর-৪ আসনের এমপি মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরীর সঙ্গেও। কাদের মির্জা নোয়াখালী থেকে ঢাকায় এসে সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তর অভিযোগ করেছেন। তিনি থানা ঘেরাও করেছেন। সড়ক অবরোধ করেছেন। সম্প্রতি তার ভাই আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে সাক্ষাৎও করেছেন। দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের প্রশ্ন কাদের মির্জা আসলে কি করতে চাইছেন। কেন করতে চাইছেন। আর তার বিরোধীদেরই বা কী উদ্দেশ্য।
গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টার দিকে কোম্পানীগঞ্জের চরফকিরা ইউনিয়নের চাপরাশীরহাট বাজারে বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আব্দুল কাদের মির্জা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদলের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধ হন সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির (২৫)। গত শনিবার রাতে তিনি রাজধানীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনায় এখনো উত্তপ্ত নোয়াখালী।
কাদের মির্জাকে দলকে অব্যাহতি নিয়ে নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের রাজনীতিতে নাটকীয় ঘটনা। বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জার দলীয় কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি এবং বহিষ্কারের সুপারিশ নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ এএইচএম খায়রুল আনম সেলিম এবং সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন উভয়পক্ষ। আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি সেলিম গণমাধ্যমকে কাদের মির্জার অব্যাহতি ও বহিষ্কারের সুপারিশ প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও একরামুল করিম চৌধুরী সেলিমকে নীতিহীন অ্যাখ্যা দিয়ে অব্যাহতি এবং বহিষ্কারের সুপারিশ বহাল আছে বলে তার ভেরিফাইড ফেসবুক লাইভে এসে জানিয়েছেন। গত শনিবার রাত ৯টা ২৭ মিনিটে একরামুল করিম চৌধুরী লাইভে এসে বলেন, ‘সেলিম ভাই (জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি) ঢাকা থেকে এসে বললো মির্জার বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সে হিসাব মোতাবেক আমরা মির্জার বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নিচ্ছি। এখন ইয়েতে বলতেছে এটা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে কিন্তু আমি আপনাদের বলতে পারি আমার জানামতে, আমি জানি না, কারণ একটা লোক অপরাধী যে নোয়াখালীতে না সারা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগকে ছোট করেছে। তাকে তো ছাড়া যায় না। তার বিরুদ্ধে আমরা জেলা আওয়ামী লীগ অবস্থান নিয়েছি। আমার সভাপতি কি অবস্থানে আছেন জানি না, উনি নাকি বলতেছেন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।
জেলার সভাপতিকে নীতিহীন আখ্যা দিয়ে সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী বলেন, ‘উনি আমাকে দিয়ে নির্দেশনা করলো, পরে উনি অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ালো। উনিও নীতিগতভাবে নীতিহীন হয়ে গেল। আমি আপনাদের বলি, ওনার (কাদের মির্জা) অব্যাহতি আমরা অব্যাহত রেখেছি। বিভিন্ন জায়গায় যেসব কথাবার্তা হচ্ছে এগুলো ঠিক না। কারণ এ ধরনের লোককে দলের অবস্থানে রাখা উচিত না। তার অব্যাহতিটা বহাল রইল।’
এ ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ এ এইচ এম খায়রুল আনম সেলিম বলেন, আমি নীতিহীন, তিনি নীতিবান হয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। রাজনীতি তাদের ব্যবসা, আমি একরামুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে একমত নই। এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত শনিবার সন্ধ্যায় কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভার মেয়র আবদুল কাদের মির্জাকে সংগঠনের সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি ও বহিষ্কারের সুপারিশ করে আবার দুই ঘণ্টা পর প্রত্যাহার করে নেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এএইচ এম খায়রুল আনম সেলিম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, নোয়াখালী আওয়ামী লীগের শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে আদেশটি প্রত্যাহার করা হলো।উৎসঃ mzamin