মতিউর রহমান চৌধুরী
বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী। ঢাকায় ভারতের ১৭তম হাইকমিশনার। প্রথম হাইকমিশনার ছিলেন সুবিমল দত্ত। এরমধ্যে বেশির ভাগ হাইকমিশনারই ছিলেন পেশাদার কূটনীতিক। অনেকেই ছিলেন আলোচিত। কেউ কেউ ছকবাঁধা দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কাকতালীয় কিনা জানি না। ঢাকায় দায়িত্ব পালনের পর দেশে ফিরে অনেকেই পররাষ্ট্র সচিব বা সমমর্যাদার দায়িত্ব পেয়েছেন।
বলাবলি আছে, ঢাকা হচ্ছে ভারতীয় পররাষ্ট্র সেবার কর্মকর্তাদের জন্য একটি উচ্চ মর্যাদার পোস্টিং। বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী ঢাকায় এসেছেন ভূ-রাজনীতির এক টালমাটাল সময়ে। নানা চ্যালেঞ্জ তার সামনে। একদিকে ঢাকায় চীনের সরব উপস্থিতি। অন্যদিকে ভারতের কাছে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বিস্তর ফারাক। নানা টানাপড়েনও দু’দেশের সম্পর্কে ছায়া ফেলেছে। পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলার সামপ্রতিক ঢাকা সফর দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে তেমন একটা ভূমিকা রাখেনি। বিশেষ করে চীনকে হটিয়ে ভারতের একচ্ছত্র অবস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। ভারতের শাসক দলের নেতারা চীনের উপস্থিতিকে সন্দেহের চোখেই দেখেন। নাগরিকত্ব আইন পাসের পর সম্পর্কের দেয়াল তৈরি হয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অবস্থান খোলাসা করেন। বলেন, এই আইন দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নে কাঁটা। মুসলিমদের প্রতি ভারতের অসহিষ্ণুতা এবং কীটপতঙ্গ বলে বাংলাদেশিদের বিজেপি’র উপহাস করাকে ঢাকা ভালোভাবে নেয়নি। এর প্রতিফলন ঘটেছে নানাভাবে। হর্ষবর্ধন শ্রিংলা একসময় ঢাকায় ভারতের জনপ্রিয় হাইকমিশনার ছিলেন। সবার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল নিবিড়। কিন্তু তার সর্বশেষ ঢাকা সফর ঘিরে কিছু ঘটনা মিডিয়ায় আসে। কোনো পক্ষ থেকেই এর কোনো প্রতিবাদ করা হয়নি। ভারতও ভাবতে থাকে বিকল্প নিয়ে। রীভা গাঙ্গুলী দাশ তখন হাইকমিশনার। রুটিন কাজ শেষে দেশে ফিরে গেছেন। অনেকটা নাটকীয়ভাবে বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীকে হাইকমিশনার নিযুক্ত করে দিল্লি। অত্যন্ত স্মার্ট, দক্ষ, নানা ভাষায় পারদর্শী, বিশেষ করে চীনা ভাষা রপ্ত করেছেন ঈর্ষণীয়ভাবে। চার বছর চীনে ভারতীয় দূতাবাসে কর্মরত ছিলেন। ফরাসি ও কোরিয়ান ভাষায় পারদর্শী বিক্রম কুমার গৎবাঁধা কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনে বিশ্বাসী নন। বাংলা শিখতে শুরু করেছেন। ক’দিন পর দেখা যাবে চমৎকার বাংলা বলছেন। ঢাকায় এসেই উল্কা গতিতে ছুটছেন তিনি। লক্ষ্য বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক এবং আরো উন্নত করা। চীনকে দূরে রাখাও অন্যতম উদ্দেশ্য। পেশাদার এই কূটনীতিক জানার চেষ্টা করছেন- কেন বাংলাদেশের জনগণ ভারতকে সন্দেহের চোখে দেখে। সীমান্তে মানুষ হত্যা, তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়াটাই কি এর প্রধান কারণ? নাকি বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় ভারতকে টপকে চীনের অবস্থান সুদৃঢ় হওয়া? চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ঢাকা সফরের পর এই অঞ্চলে অনেক কিছুই বদলে যায়। ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহযোগিতা ঘোষণা করেন চীনা প্রেসিডেন্ট। এটা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ক্রেডিট লাইন। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যায় উন্নয়ন। বাংলাদেশও তার প্রয়োজনে উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে শুরু করে। এতে দিল্লির সাউথ ব্লকে একধরনের হতাশা তৈরি হয়। সন্দেহ আর অবিশ্বাস দানা বাঁধতে থাকে। পরিণতিতে দু’দেশের নির্ধারিত বৈঠক বাতিল হয়ে যায়। এরমধ্যে পাকিস্তানের হাইকমিশনার ইমরান আহমেদ সিদ্দিকী নীরবে পৌঁছে যান ঢাকার বিদেশমন্ত্রীর বৈঠকখানায়। খবরটি চাউর হয় বিদেশি বার্তা সংস্থার মাধ্যমে। এর আগে অবশ্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেন। এই ফোনালাপ নিয়ে ভারতীয় মিডিয়া সমালোচনামুখর ছিল বেশ ক’দিন। এসব ঘটনায় সংশয় আরো দানা বাঁধতে থাকে। তখন বলা হয়, নিশ্চয় এর পেছনে চীনের হাত রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই দোরাইস্বামী ঢাকায় এসে নিজের উপস্থিতি জানান দেন। ১০ই ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পান। এর আগে অবশ্য পাকিস্তানের হাইকমিশনার প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ পেয়ে যান। অনেকদিন যাবৎ তিনি ডাকের অপেক্ষায় ছিলেন।
দীর্ঘকাল কূটনৈতিক রিপোর্টার ছিলাম। এখনো খোঁজখবর রাখি। কখনও ঢাকার মাটিতে এভাবে ভারত-চীনের কূটনৈতিক লড়াই দেখিনি। একসময় চীন শুধু উন্নয়ন নিয়েই ব্যস্ত ছিল। এখন কৌশল পরিবর্তন করে রাজনীতিতেও প্রবেশ করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশে দেশে রাজনীতি নিয়েও খেলছে চীন। ২০১৮ সনের নির্বাচনে একক প্লেয়ার হিসেবে চীনের আবির্ভাব ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। দূর থেকে ভারতের দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। ঢাকায় ভারতের মিত্ররা তখন হতাশায় ডুবে যান। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জোট সব হারিয়ে নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। সময় যত গড়াতে থাকে তখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে তৎপরতা দৃশ্যমান হয়। যদিও ভারত-আমেরিকার এই খেলা থেকে বাংলাদেশ নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু পরাশক্তিগুলো বাংলাদেশকে তোয়াজ করতে শুরু করে অব্যাহতভাবে। ভারতীয় বিশ্লেষক সি রাজামোহন বলেছেন, সামপ্রতিক বছরগুলোতে ভারতের অর্থনীতির মন্থর গতি দেখে উদ্বিগ্ন হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ঢাকার সন্তোষজনক অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়টি নিয়ে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে ভারত একটা দিক বেমালুম ভুলে গেছে। আর সেটা হলো, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কৌশলগত ফলাফল। এই যখন অবস্থা, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক কূটনীতি চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেয়। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী এসময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। এসব তৎপরতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল, বাংলাদেশ থেকে চীনকে হটানো। ওয়াশিংটনে দৃশ্যপট বদল হয়ে যাওয়ায় ফের দুশ্চিন্তা বেড়েছে ভারতের। ভারত-চীন সীমান্তে গুলির লড়াই যখন তীব্র তখন ঢাকার ভূমিকা ছিল একদম নিরপেক্ষ। এটাও দিল্লিকে হতাশ করে। সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরের উন্নয়ন, তিস্তা প্রকল্পে চীনের অর্থায়নকে ঢাকা দখলের কৌশল হিসেবেই দেখতে থাকে দিল্লি। বাংলাদেশে হাজারখানেক পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণার ফলে নতুন বার্তা দেয়ার চেষ্টা করে বেইজিং। এর ফলে অভিজ্ঞ ঝানু কূটনীতিক বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর জন্য কাজটি কঠিন হয়ে যায়। যদিও চীনা ভ্যাকসিনকে ঢাকায় আসতে না দিয়ে প্রাথমিক সাফল্য পেয়ে গেছেন। এখন যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন ভারত হয়ে ঢাকা আসছে। প্রায় একই সময় চীনের প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রস্তাবিত ঢাকা সফর স্থগিতের ঘটনা নতুন এক বার্তা দেয়। বিক্রম কুমার দোরাইস্বামীর অব্যাহত কূটনৈতিক তৎপরতা নজিরবিহীন। মেলামেশা করছেন সব মতের মানুষের সঙ্গে। কখনও নৈশভোজে, কখনও টি-পার্টিতে। খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন কেন ঢাকার মানুষজন দিল্লির প্রতি বিরক্ত? একমাত্র ৭১ কার্ড যে সবসময় কার্যকর থাকবে এটা নিয়ে সাউথ ব্লকেই ভিন্ন মত স্পষ্ট। চীনকে ঠেকাতে গিয়ে তারা যে ঢাকাকে হারাতে বসেছে এটার ওপর নজর রাখছেন বিক্রম কুমার। সামপ্রতিক এক নৈশভোজে তিনি দীর্ঘ সময় শুনেছেন ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের অতীত, বর্তমান। এই নৈশভোজে বাংলাদেশের নির্বাচনে সুজাতা সিং-এর ভূমিকা এসেছিল আলোচনায়। অতিথিরা এক বাক্যে বলেছেন, তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং নির্বাচন নিয়ে যেভাবে একরোখা ভূমিকা রেখেছিলেন তা ছিল সম্পূর্ণ অকূটনৈতিক। বিপুল সংখ্যক মানুষ তখন গণতান্ত্রিক ভারতকে দেখতে শুরু করে অন্যভাবে। বিক্রম কুমার এসব আলোচনা শুনেছেন দারুণ আগ্রহ নিয়ে। তৃতীয় একটি দেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে একজন কূটনীতিকের এমন ভূমিকা কাম্য নয় এটা বলার মধ্য দিয়ে আলোচনা অন্যদিকে মোড় নেয়। প্রশ্ন হচ্ছে, বিক্রম কুমার কি চেনা পথেই হাঁটছেন? তিনি এখনো এক ঝুড়িতে সব আম রাখার নীতি থেকে পুরোপুরি সরে এসেছেন- এমনটা দৃশ্যমান নয়। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মধ্যে চীনের অবস্থান এখন মুখ্য আলোচনায়। যদিও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এটা একধরনের হাইপ সৃষ্টির প্রয়াস। প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে টানাপড়েন থাকতেই পারে। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বীণা সিক্রি যখন ঢাকায় হাইকমিশনার তখন দু’দেশের সম্পর্ক চলে গিয়েছিল একদম তলানীতে। পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী এসে মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। যাই হোক, দু’দেশের সম্পর্ক শুধু আবেগ দিয়ে যাচাই করা ঠিক হবে না। দেনা-পাওনার বিষয়টা তো থাকেই। শুধু বন্ধুত্ব নয়, অনেক সময় উন্নয়ন ছাপিয়ে যায় সবকিছু। মনে রাখতে হবে, আবেগের মূল্য দিতে গিয়ে কেউ নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারবে না।