লিখেছেন কৃষ্ণপদ সেন
প্রায় দুই যুগের উপর আমার মন্ট্রিয়লের বসতি। এই দীর্ঘ সময়ে প্রায় প্রতি বছরই পূজাতে অংশ নিয়েছি কখনো সরবে কখনো নীরবে। এই প্রবাসে এতো প্রতিকূলতার মধ্যেও যে দুর্গাপূজা করা যায় তা রীতিমতো বিষ্ময়কর। এখানকার প্রথম জীবনে যখন এই পূজা পার্বণের সাথে জড়িয়ে পড়ি তখন, বিশেষ করে দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা এবং সরস্বতী পূজা উদযাপিত হতো। কারন পূজার ভেন্যু হতো কোন চার্চ অথবা কোন স্কুলের ক্যাফেটেরিয়া বা অন্যকোন পাবলিক প্লেস। স্বাভাবিকভাবে আমাদের উদযাপনের দিন থাকতো উইকএন্ড। কারন, প্রথমতঃ ঐ সমস্ত স্কুল বা পাবলিক প্লেসগুলি উইকডেজে পাওয়া যেতো না। আর আমরা যারা পূজারী, আমাদেরও উইকএন্ড ছাড়া ছুটি ছিল না।
বিশেষ করে দুর্গাপূজা এলে নিজেদের মাঝে আলাপ আলোচনা করে একটি কার্যনিবার্হী পরিষদ গঠন করা হতো। এরপর শুরু হতো প্রস্তুতি কার্যক্রম। শুরুতে অল্প সংখ্যক বাংলাদেশী থাকায় তখন একটি পূজাই করা হতো। পরবর্তীতে লোকজন বাড়লে মতভেদও বৃদ্ধি পায়। বিভাজন হয় বাংলাদেশীদের মাঝে।
প্রথমে ছবি দিয়ে পূজা করা হতো। পরবর্তীতে ভারত থেকে মূর্তি এনে পূজার সূচনা হয়। কমিটি গঠনের পর পূজার পরবর্তী উইকএন্ডে পূজার দিন নির্ধারিত হতো। দিন স্থির হলে পরে, পূজার জন্য হল বুকিং দিতে হতো। ভাগ্য ভাল থাকলে নির্দিষ্ট দিনে হল বুকিং পাওয়া সম্ভব হতো। নয়তো আরো ১৫ দিন পিছিয়ে যেতো হল পাওয়ার উপর নির্ভর করে। কারন উইকএন্ড আসতে আসতে শুক্লপক্ষ শেষ হয়ে যেতো। ফলে দুর্গাপূজা করা সম্ভব হতো না। ফলে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজাও পিছিয়ে যেতো। ফলে প্রবাসে বৈরী পরিবেশে পূজার আনন্দের ভাটা পড়তো অনেকাংশে। তবে আনন্দ উচ্ছ্বাসের কোন কমতি থাকতো না। এখন যখন আমরা নিজেদের মন্দিরে পূজা উদযাপন করি তখন ভেবে অবাক হই যে, তখন এতো এতো কাজ আমরা কি ভাবে শেষ করতাম !
হল বুকিং এর জন্য যেতে হতো স্কুল বোর্ডের অফিসে। একসাথে পর পর দুই তিনটি উইকএন্ড বুকিং দিতে হতো। কারন দুর্গাপূজার পর লক্ষ্মীপূজা আর কালীপূজার জন্য ও হল বুকিং দিতে হতো। এরপর স্কুল বোর্ডের অফিসার সংশ্লিষ্ট স্কুলের সাথে কনফার্ম হতেন ঐসব নির্দিষ্ট দিনে তাদের নিজস্ব কোন বুকিং আছে কিনা। স্কুলের ক্লিয়ারেন্স পেলে পরে হলের ইন্সুরেন্স করতে হতো। ইন্সুরেন্সের টাকা পরিশোধ করে রসিদ নিয়ে আবার স্কুল বোর্ডের অফিসে জমা দিলে পরে হল বুকিং এর কাজ সম্পন্ন হতো। এই ইন্সুরেন্স ও হল বুকিং এর টাকা সভাপতি, সম্পাদককে প্রথমে নিজেদের পকেট থেকে জমা দিতে হতো। এরপর পূজার নিমন্ত্রণপত্র আর চাঁদার রশিদ বই ছাপানোর কাজ করা হতো। এই ছাপার কাজ শেষ হলে চাঁদা আদায় ও নিমন্ত্রণপত্র কিছু নির্দিষ্ট কর্মীদের মাধ্যমে আদায়ের ব্যবস্থা করা হতো। তবে, একথা অতি অপ্রিয় শুনালেও অতি সত্য যে, বাড়ি বাড়ি নিমন্ত্রণ পাঠালেও চাঁদা আদায় তখন সামান্যই হতো। অবশ্য পূজার দিনে পূজা মন্ডপেই সবাই চাঁদা পরিশোধ করতেন। কিন্তু এরই মধ্যে পূজার একটা সিংহভাগ খরচ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়ে যেতো। এরপর ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের আয়োজন, নাটক মঞ্চায়ন, স্থানীয় শিশু, কিশোর-কিশোরীদের সহ অন্যান্য গুণীশিল্পীরাও অংশ নিতেন। এছাড়াও ভারত বাংলাদেশ থেকে সঙ্গীত শিল্পী আনার একটা রেওয়াজ ছিল যা এখন বহাল আছে। পূজা উপলক্ষে স্মরনিকা প্রকাশ, যা সেদিনও ছিলো এবং আজও আছে।
প্রথম দিকে শনিবার ও রবিবার দুই দিন পূজা হতো এবং কয়েক বছর পর শুক্রবার বিকালকেও সংযোজিত করা হয়। আমাদের একই মূর্তিতে প্রতি বছরই পূজা হতো। মূর্তি রাখা থাকতো বেলশ্বাসস্থ হিন্দু মিশন মন্দিরে। সেখানে নীচতলার একটি ঘরে মাথার উপরে ছোট ছোট খোপের মত কিছু ষ্টোর ছিল। যারা ঐ সময় এই মূর্তি উঠানো নামানোর পূণ্যের কাজটি করেছেন শুধু তারাই বলতে পারবেন কাজটা কেমন আনন্দের (!!) ছিল। সকালে এই কর্মীবাহিনী মূর্তি নিয়ে হলে পৌঁছে যেতেন। তারপর শুরু হতো মন্ডপ তৈরির কাজ। আর অন্যদিকে চলতো কলাবৌ তৈরির কাজ। সবশেষে সবকিছু মিলিয়ে পূজা শুরু হতে দুপুর ১টা-২টা বেজে যেতো। একই দিনে ষষ্ঠী, সপ্তমী আর অষ্টমীর পূজা শেষ করতে হতো। তবে দেবতার ভোগ ব্রাক্ষ্মণ দিয়ে রান্না করার একটা রেওয়াজ চালু হয়েছিল, যা থেকে এখনও সম্পূর্ন মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়ে ওঠা যায়নি। দুর্গাপূজা করতে যেসব আনুষাঙ্গিক উপাদানের প্রয়োজন হয়, বেশ্যা মৃত্তিকা তার অন্যতম। বেশ্যা মৃত্তিকা ছাড়া দুর্গাপূজা অসম্পূর্ণ। এর মূল দর্শন হচ্ছে সমাজের সব শ্রেণী, বর্ণ, পেশা, ইতর, ভদ্র সবাইকে সাথে নিয়ে, সবাই হাত ধরাধরি করে, সব দুঃখ বেদনা, উচ্চ-নীচ ভাবনা দূরে সরিয়ে আমরা পূজায় সামিল হবো। কিন্তু এই ভাবনাগুলি, এই মহামিলনের স্বার্বজনীনতাকে এক বাক্যে পরিহাস করে।
যা হোক, এসব মেনে নিয়েই আমাদের প্রবাসের পূজা হতো। সারা বছর সবাই অপেক্ষায় থাকতেন এই দিনের জন্য। সবার জন্য রান্না হতো খিচুড়ি, সবজি, টক বা পায়েস আর দশমীর রাতে একটা মিষ্টি অবশ্যই থাকতো। এই রান্না কখনো কারো রেষ্টুরেন্টে হতো পরবর্তীতে এটা হিন্দু মিশন মন্দিরেই রান্না হতো। তিন তলার উপর রান্না হতো। তখন হিন্দু মিশনে লিফট ছিল না। সমস্ত বড় বড় খাবার ভর্তি হাড়ি বাসন সিড়ি দিয়ে নীচে নামানো হতো। তারপর প্রত্যেক রাতে খাবার শেষে ঐ বাসনপত্র পরের দিনের রান্নার জন্য ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে আসতে আসতে রাত প্রায় শেষ হয়ে যেতো। শেষের রাতে মূর্তিও হিন্দু মিশনে রেখে আসতে হতো। সেই টেবিলের উপর চেয়ার বসিয়ে বাষ্ক ভর্তি মূর্তিগুলো উপরে উঠানো যে কি কষ্টকর ছিল তা বলাই বাহুল্য।
পূজা শেষ হলে পরে, হল পরিষ্কার করে আসতে হতো। কোন প্রকার অপরিচ্ছন্নতা স্কুল কর্তৃপক্ষ পছন্দ করতো না। আমাদের খাবারের মশলার দাগ টেবিলে লেগে গেলে পরবর্তী বছর হল পাওয়া মুস্কিল হয়ে যেতো। তাছাড়া আমাদের অতিথিরাও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে খুবই যত্নশীল নাকি উদাসীন তা এবার মন্দিরে পূজার সময় আপনারা পরখ করে নিতে পারবেন।
পূজার সময় কিছু সংখ্যক ব্যক্তি বিশেষের মান অভিমান রাগ ইত্যাদি রোগের প্রকোপ ভয়ংকর ভাবে বেড়ে যেতো। এদের এই মান অভিমান দূর করার জন্য একটি ( মেডিকেল টিম !!) টিমকে সব সময় মাঠে থাকতে হতো। এখন যখন আমরা আমাদের নিজেদের মন্দিরে এই পূজা পার্বণগুলো উদযাপন করি তখন স্বভাবতই মনে পুরানো দিনের সেই দুঃখ, কষ্ট আর আনন্দে ভরা স্মৃতিগুলো সামনে এসে ভিড় জমায়। এখন কত সহজে আমরা দুর্গাপূজা বা অন্যান্য সব পূজা-পার্বণ সম্পন্ন করতে পারছি। আমাদের মূর্তি আমাদের মন্দিরে সুরক্ষিত।
নীচতলা থেকে শুধু উপরে নিয়ে আসলেই হলো। সাউন্ড, লাইটিং, হল সবকিছুই আমাদের মন্দিরে। রান্নার জন্য আছে আমাদের রান্না ঘর। প্রসাদ কম বেশি হলে সাথে সাথেই রান্না বসানো কোন ব্যাপারই না। হল বুকিং এর জন্য স্কুল বোর্ডের অফিসে ছুটতে হয় না। ইন্সুুরেন্সের জন্য ইন্সুরেন্স অফিসেও যেতে হচ্ছে না।
গত পাঁচ ছয় বছর যাবৎ আমাদের মন্ট্রিয়লে দুর্গাপূজা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে উদযাপিত হচ্ছে। অতীতে পূজা উদযাপন করতে যেসব বিশেষ কাজ আমাদের সম্পন্ন করতে হতো, নিজেদের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে আমরা ঐসব সমস্যা থেকে এখন মুক্ত। এখন অনেকটা রিলাক্স মুডে আমরা আমাদের পূজার আনন্দটা অনুভব করি অনুধাবন করি। ভবিষ্যতে হয়তো আরো সহজ ও সুন্দর হবে আমাদের এই পূজা উদযাপন। আজ এই আনন্দযজ্ঞের প্রথম সকালে যাদেরকে সাথী করে পূজা শুরু হয়েছিল তাঁদের অনেকেই আজ আর আমাদের মাঝে নেই। একদিন এই আমরাও বিদায় নিবো। কালের বিবর্তনে আরো নূতন নূতন মুখ এখানে এই কাজগুলো চালিয়ে নিয়ে যাবে। এরা হয়তো আরো উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে পূজাকে আরো সুন্দর আরো আকর্ষণীয় করবে। তখন শুধু মনে রেখো আজকের এই প্রজন্ম তাঁদের, যারা এই মহাযজ্ঞ সূচনা করেছিল তাঁদের। আমরাও বেঁচে থাকবো তোমাদের কাজে তোমাদের কাছে।
‘‘তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি,
সকল খেলায় করবো খেলা এই আমি ”।।