মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুলের বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকার সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। সিআইডি জানায়, পাপুল ও তার পরিবারের সদস্যের ব্যাংক হিসাবে তদন্ত করে মোট ৩৫৫ কোটি ৮৬ লাখ ৩০ হাজার টাকার মতো জমা পেয়েছে তারা। এগুলো মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সিআইডি।
সিআইডির অর্গানাইড ক্রাইম ইউনিটের (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) সহকারী পুলিশ সুপার আল আমিন হোসেন জানান,
দীর্ঘ তদন্তের পর পাপুল ও তার পরিবারের লোকজনের নামে মঙ্গলবার পল্টন থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা করা হয়েছে।
মামলার আসামিরা হচ্ছেন কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুল, মোহাম্মদ সাদিকুর রহমান মনির (পাপুলের ব্যক্তিগত কর্মচারী), জেসমিন প্রধান(পাপুলের শ্যালিকা), ওয়াফা ইসলাম (পাপুলের কন্যা), কাজী বদরুল আলম লিটন (পাপুলের ভাই), গোলাম মোস্তফা (৫৬) (মানবপাচারে সংশ্লিষ্ট জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। এছাড়াও মামলায় দুইটি প্রতিষ্ঠানকে আসামি করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে জে. ডব্লিউ লীলাবালী ও জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল।
জে. ডব্লিউ লীলাবালীর প্রোপ্রাইটর পাপুলের শ্যালিকা জেসমিন প্রধান এবং জব ব্যাংক ইন্টারন্যাশনালের প্রোপাইটার পাপুলের ভাই কাজী বদরুল আলম লিটন।
মামলায় অজ্ঞাত নামা ৫/৬ জনের আসামির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। দীর্ঘ তদন্তের পর তাদের বিরুদ্ধে মামলাটি করেন সিআইডির অর্গানাইড ক্রাইম ইউনিটের (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আল আমিন হোসেন।
তদন্তের বিষয়ে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ‘অনুসন্ধানকালে জানা যায়, কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুল সংঘবদ্ধভাবে তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি ও সত্তার সহযোগিতায় মানব পাচারের মাধ্যমে প্রচুর অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন।
মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ধারা ২(শ)(১৬) অনুযায়ী মানব পাচার একটি সম্পৃক্ত অপরাধ। এই অপরাধলব্ধ আয় জ্ঞাতসারে অর্জন, ভোগ ও অন্যান্য স্থাবর/অস্থাবর সম্পদে রুপান্তর করা একই আইনের ৪(২) ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাজী শহিদুল ইসলাম পাপুল এবং তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যক্তি ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব ব্যবহার করে মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত অপরাধলব্ধ আয়ের প্রকৃত উৎস গোপনের অভিপ্রায়ে সম্পৃক্ত অপরাধলব্দ অর্থ গ্রহণ, ব্যাংক হিসাবে জমা ও স্থানান্তর করে নামে-বেনামে স্থাবর/অস্থাবর সম্পদে রুপান্তর করেছেন বলে অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয়।
অনুসন্ধানে সিআইডি জানতে পারে, পাপুলের ব্যক্তিগত কর্মচারী হিসেবে সাদিকুর রহমান মনির দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের সন্ধানে কুয়েতে গমনে ইচ্ছুকদের কাছ থেকে নগদ ও ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে জন প্রতি ৫-৭ লাখ টাকা গ্রহণ করে। মনিরের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সাদিকুর তার নিজ নামে রুপালী ব্যাংকের রাজারবাগ শাখায় ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত কুয়েত গমনে ইচ্ছুক ভিকটিমদের কাছ থেকে মোট ৩৮ কোটি ২২ লাখ ৪০ হাজার ৫৬৭ টাকা জমা করা হয়েছে। এসব টাকা পাপুল, তার শ্যালিকা জেসমিন প্রধান, কন্যা ওয়াফা ইসলামের নামে পরিচালিত ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে ট্রান্সফার ও উত্তোলন করা হয়েছে।
সিআইডির অনুসন্ধানে জেনেছে, সাদিকুর রহমান মনিরের ব্যাংকের হিসাব থেকে জেসমিন প্রধান ও তার নাম-সর্বস্ব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান জে. ডোব্লিউ লিলাবালি’র ব্যাংক হিসাবে ১৭ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার টাকা স্থানান্তর করা হয়েছে। মনির ও জেসমিনের মধ্যে টাকার আদান প্রদান হলেও অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্কের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে সিআইডি আরও জানতে পারে, জেসমিন প্রধান তার নিজ ও প্রতিষ্ঠানের নামে ২০১৪-২০১৯ সাল পর্যন্ত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং সাউথইস্ট ব্যাংকের মোট ৩৮টি (এফডিআরসহ) ব্যাংক হিসাবে ১৬৪ কোটি ৯১ লাখ ৯৮ হাজার ৭০২ টাকা জমা ছিল। তার বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা করেছে দুদক।
সিআইডি জানায়, দীর্ঘ তদন্তে পাপুল, তার স্ত্রী- সেলিনা ইসলাম, কন্যা- ওয়াফা ইসলাম, শ্যালিকা- জেসমিন প্রধান ও ব্যক্তিগত কর্মচারী সাদিকুর রহমান মনিরের বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে হিসাবের শুরু থেকে ২০২০ সালের পর্যন্ত সর্বমোট ৩৫৫ কোটি ৮৬ লাখ ২৯ হাজার ৬৭০ টাকা জমার তথ্য পাওয়া যায়। তবে ৩৫৫ কোটি টাকার মধ্যে বর্তমানে অ্যাকাউন্টগুলোতে মাত্র ১ কোটি ৩০ লাখ ১৯ হাজার ৭০৩টাকা রয়েছে। বাকী টাকা তুলে ফেলা হয়েছে। এই টাকার প্রধান উৎস মানব পাচারের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জিত। বিস্তারিত তদন্তে প্রকৃত লন্ডারকৃত অর্থের সঠিক পরিমাণ নিরুপণ করা সম্ভব হবে।