২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি (১/১১) বিকেলে পশ্চিমা কূটনীতিকদের একটি ছোট দল কয়েকজন বিএনপি নেতার সঙ্গে বসেছিল ঢাকায় কানাডীয় হাইকমিশনারের বাসায়। বিএনপির প্রতি তাদের বার্তার সারমর্ম ছিল—কিছু দাবি মেনে নিয়ে আওয়ামী লীগকে কেন নির্বাচনে আনা হচ্ছে না? বৈঠক চলাকালেই সেখানে উপস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসকে দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সেলর জানান, ‘জরুরি অবস্থা’ জারি হচ্ছে। বিউটেনিস তখন তাঁর ঠিক পাশে বসা কানাডীয় হাইকমিশনারকে সে খবর পাঠান ই-মেইলে। এরপর তাঁকে ফিসফিস করে বলেন, ‘মেইল চেক করুন।’ ততক্ষণে অন্য রাষ্ট্রদূতদের কাছেও ফোন আসা শুরু হয়। বিউটেনিসসহ অন্য রাষ্ট্রদূতরা অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে উপস্থিত সেই বিএনপি নেতাদের জরুরি অবস্থা জারির খবর জানান।
প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল থেকে ২০০৭ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর তিনি শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৪ সালে অবসরে যান। পরে তিনি তাঁর কর্মজীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সাক্ষাৎকার দেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক কথ্য ইতিহাস প্রকল্পকে। সম্প্রতি সেই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ১/১১-এর প্রেক্ষাপটসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে।
বিউটেনিস বাংলাদেশে এসে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলীয় মিশনপ্রধানদের নিয়ে একটি অনানুষ্ঠানিক ‘টি গ্রুপ’ গঠন করেছিলেন। এই গ্রুপের রীতি ছিল সমমনা রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে এ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা, ভাবনার লোকদের সঙ্গে বসা। সেখানে মানবাধিকার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, সহিংসতামুক্ত রাজনীতিকে উৎসাহিত করা হতো। বিউটেনিস জানান, সেই আড্ডা বা আলাপচারিতায় পরিবেশন করা হতো চা ও হালকা খাবার। প্রত্যেক রাষ্ট্রদূত অবশ্যই তাঁর সরকারের নিজস্ব নীতি অনুযায়ী চলতেন। তবে সার্বিক মানবাধিকার নীতিতে ওই রাষ্ট্রদূতরা অনেকটাই অভিন্ন অবস্থানে এসেছিলেন। রাজনৈতিক সংকটের দিনগুলোতে কূটনীতিকরা জনগণকে সহিংসতা ছেড়ে শান্ত করানোর চেষ্টা করছিলেন।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বা মানবাধিকারের বার্তাগুলো কাকে বা কাদের দিতেন এবং সেগুলোর প্রতিক্রিয়া কেমন পাওয়া ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে বিউটেনিস বলেছেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তখন তাঁর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেয়াদের শেষ বছরে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজনের স্বীকৃতি ছিল সংবিধানে। ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানে আস্থা ছিল না। নির্বাচনের আগে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে। তাদের দায়িত্ব ছিল অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা।
বিউটেনিস বলেন, ‘বিএনপি সরকারের শেষ মাসগুলোতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে পড়ছিল। বিএনপি যাঁকে প্রধান উপদেষ্টা ঠিক করেছিল তিনি আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। উভয় দলই তাদের পক্ষে দূতাবাসগুলোকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করেছিল। তারা হয় বিএনপির ঠিক করা ব্যক্তির প্রতি সমর্থন জানাতে রাষ্ট্রদূতদের বলেছিল, নয়তো বলেছিল—তাঁকে প্রত্যাখ্যান করতে।’
বিউটেনিস বলেন, ‘আমাদের কোনো পছন্দ-অপছন্দ ছিল না। তবে আমরা এমন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনকে উৎসাহিত করেছিলাম, যেখানে সরকার তার ব্যবস্থার মাধ্যমে বিএনপি প্রার্থীদের আলাদাভাবে সাহায্য করবে না। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন তাদের কঠিন দায়িত্ব পালন করবে।’
বিউটিনেস আরো বলেন, ‘এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ হাসিনা নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট কিছু দাবি জানালেন। তিনি জানতেন সেই দাবিগুলো পূরণ করা হবে না বা পূরণ করা যাবে না। যেমন—নির্বাচনে জালিয়াতি রোধে তিনি ছবিযুক্ত ভোটার তালিকার দাবি জানালেন। আমার মনে হয় না, তখন ভোটার তালিকা কম্পিউটারাইজড হয়েছে।’
বিউটেনিসের মতে, নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হওয়ার জন্য এতে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণকে তাঁরা (পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতরা) অপরিহার্য মনে করতেন। আর এটিই আওয়ামী লীগকে সুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে এসেছিল। বিউটেনিস স্বীকার করেন, “আওয়ামী লীগ যাতে নির্বাচনে অংশ নেয় সে জন্য উদ্যোগ নিতে সরকারকে আমরা চাপ দিয়েছিলাম। পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবের ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা’ বন্ধসহ মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নেও আমরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলাম।”
শ্রম অধিকার পরিস্থিতি নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বিউটেনিস বলেন, তখনই বাংলাদেশ জিএসপির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রাপ্য বাণিজ্য সুবিধা হারানোর ঝুঁকিতে ছিল। সে সময় প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ না নিলে যুক্তরাষ্ট্র তা মেনে নেবে কি না—এমন উদ্বেগও ছিল। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেন, নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি না হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য তা মেনে নেওয়া কঠিন হবে। বিউটেনিস বলেন, ‘আমরা একদিকে বিএনপি সরকারকে আওয়ামী লীগের কিছু দাবি মেনে নিতে চাপ দিচ্ছিলাম, একই সঙ্গে আওয়ামী লীগকে চাপ দিচ্ছিলাম দাবি পূরণ না হলেও তারা যেন সহিংসতা শুরু না করে।’
দাবি পূরণ না হলে রাস্তায় নামার হুমকি দিয়ে রেখেছিল আওয়ামী লীগ। বিউটেনিসের স্মৃতিচারণা অনুযায়ী, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ—উভয় দলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমমনা দেশগুলোর বার্তা ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ। পশ্চিমা দূতাবাসগুলোর এ অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে বিতর্কের কিছু আছে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি কাউকে ছাড় দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
জরুরি অবস্থা জারির পর বিউটেনিস ও তাঁর সে সময়ের সহকর্মীরা ‘থার্ড ফোর্স’ বা তৃতীয় শক্তির উত্থানের গুঞ্জন শুনেছিলেন। বিউটেনিসের মতে, এটি একধরনের ইঙ্গিত যে তৎকালীন সামরিক বাহিনী কিছু করবে। তিনি বলেন, ‘সামরিক বাহিনী ও সমাজের কিছু অংশ খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার ওপর এবং তাঁদের অন্তহীন বিদ্বেষ ও তাঁদের দলগুলোর একসঙ্গে কাজ না করার ব্যাপারে বেশ হতাশ ছিল। কিছু লোক হয়তো এই তৃতীয় শক্তির বিষয়ে আমাকে বলতেন এবং আমার প্রতিক্রিয়া জানার চেষ্টা করতেন। আমি সব সময় বলেছি, কোনোভাবেই না। রাজনীতি ও শাসনকাজে সামরিক বাহিনীর কোনো ভূমিকা নেই। আপনারা আপনাদের সংবিধান মেনে চলুন। আমার কূটনৈতিক সহকর্মীদের বার্তাও ছিল এমন।’
বিউটেনিস সেই উদ্বেগের সময় পার করেছিলেন অন্য রাষ্ট্রদূত ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক ও ফোনালাপের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া বা অন্তত আলাপ-আলোচনা করানোর চেষ্টার অংশ হিসেবে বিউটেনিস তাঁর বাসায় একই সময়ে একেকটি রাজনৈতিক দলের একজন করে জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু এসব উদ্যোগ কোনো ফল দেয়নি।
বিউটেনিস বলেন, সে সময় নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম থেকে বাংলাদেশের বাদ দেওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে একদিন বিকেলে বিএনপির কিছু নেতার সঙ্গে রাষ্ট্রদূতদের বৈঠক শেষ হওয়ার সময় জরুরি অবস্থা জারির খবর আসে।
বিউটেনিসের মতে, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে তাঁদের বৈঠকের সময় সামরিক বাহিনীর তৎপরতায় জরুরি অবস্থা জারির ঘটনা থেকে অনেকের এমন বিশ্বাস হয়েছিল যে জরুরি অবস্থা জারির পেছনে কূটনীতিকদের উসকানি ছিল। তিনি বলেন, ‘সামরিক বাহিনী যা করেছিল তাতে অবশ্যই আমরা অখুশি হয়েছিলাম। তারা বিশ্বব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা, অত্যন্ত সম্মানজনক একজন ব্যক্তিকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করল। নির্বাচন স্থগিত হলো। এরই মধ্যে উভয় বড় দল ও তাদের নেতাদের নিষ্ক্রিয় করতে যা যা করতে পারত সবই সামরিক বাহিনী করেছিল। শেষ পর্যন্ত তারা সফল হয়নি। ২০০৮ সালে যখন নির্বাচন হলো, তখন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট জয়ী হলো। আমি অবশ্যই বলব, বাংলাদেশের রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও তাদের সংস্কৃতি নিয়ে শুধু সেনাবাহিনীই হতাশ ছিল না। তবে তাদের সম্পৃক্ততা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেনি।’