দুধে পানি মেশানো হয়েছে কি না, হলে পানির অস্তিত্ব কতটুকু-এসব পরিমাপ করার যন্ত্র ‘মিল্ক টেস্টার’ কেনা বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রতিটি ৩ লাখ ৩২ হাজার টাকা। অথচ এই যন্ত্র রাজধানীর বাজারে মিলছে মাত্র ৬০ টাকায়। তবে যন্ত্রের কার্যক্ষমতা ও প্রকারভেদে এর দাম সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজধানীর টিকাটুলীর সায়েন্টিফিক মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডি) প্রকল্পের কেনাকাটায় এই অস্বাভাবিক দাম ধরা হয়েছে। দুধ পরীক্ষার যন্ত্র কেনা খাতে ৩০০ সেট যন্ত্রের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
শুধু তা-ই নয়, এলডিডি প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয়ে প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের অতিথির জন্য একটি চেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ৬ লাখ টাকা। প্রকল্প পরিচালক ও পরামর্শকের চেয়ার-টেবিলের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। গবেষণাগারের বর্জ্য রাখার জন্য প্রতিটি পাত্রের ব্যয় ধরা হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। অথচ বাজারে এটি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়।
সায়েন্টেফিক মার্কেটের একাধিক কোম্পানির মালিকরা জানিয়েছেন, ৬০ টাকার যন্ত্রটি দিয়ে দুধে পানি আছে কি না, তা পরীক্ষা করা হয়; যন্ত্রটির নাম মিল্ক টেস্টার। আর দুধের ফ্যাটসহ বিভিন্ন মান পরীক্ষায় যেসব যন্ত্র ব্যবহৃত হয়, তা ৮ হাজার টাকার মধ্যে পাওয়া যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের আওতায় ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি-উন্নয়ন’ (দ্য লাইভস্টক অ্যান্ড ডেইরি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট-এলডিডিপি) শীর্ষক এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ এরই মধ্যে শুরু করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ৪ হাজার ২৮০ কোটি ৩৬ লাখ ৪৮ হাজার টাকার এ প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এবং মেয়াদ শেষ হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। এ অর্থের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা হচ্ছে ৩ হাজার ৮৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার বেশি। বাকি টাকা দিচ্ছে সরকার। পার্বত্য ৩টি জেলা ছাড়া দেশের ৮ বিভাগের ৬১টি জেলার সব উপজেলা, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন হবে। প্রকল্পটির মূল কার্যক্রমের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রাণিসম্পদ খাতের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবন, উৎপাদক গ্রুপ প্রতিষ্ঠা, জলবায়ুর স্মার্ট-উৎপাদন কৌশলের উন্নয়ন এবং মার্কেট-লিংকেজ এবং ভ্যালুচেইনের উন্নয়নে বিনিয়োগ।
তথ্যমতে, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরুর আগেই নানা খাতে কেনাকাটায় অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির গত ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে আলোচনা হয়। কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কমিটির সদস্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী শ. ম. রেজাউল করিম, মো. শহিদুল ইসলাম (বকুল), নাজমা আকতার, মোছা. শামীমা আক্তার খানম এবং কানিজ ফাতেমা আহমেদ বৈঠকে অংশ নেন।
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে উপস্থিত মন্ত্রীর কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চান কমিটির সদস্যরা। মন্ত্রীও তাৎক্ষণিকভাবে একটা জবাব উপস্থাপন করেন। তবে এই জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেননি স্থায়ী কমিটি। আগামী বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করা হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু মানবকণ্ঠকে জানান, প্রকল্পটির কেনাকাটায় অস্বাভাবিক অনিয়ম হওয়ার বিষয়টি নজরে আসায় সংসদীয় কমিটি এটি আমলে নিয়েছে। তিনি বলেন, কোনো প্রকল্পে অনিয়ম হলে সরকার কিংবা সংসদীয় কমিটির তো দেখার প্রয়োজন আছে। সে জন্যই বিষয়টি আমরা দেখছি। কমিটির আগামী বৈঠকে এ নিয়ে বিশদ আলোচনা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
এদিকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে সংসদীয় কমিটিও আমার কাছে জানতে চেয়েছিল। আমি কমিটিকে লিখিত জবাব দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘এই মন্ত্রণালয়ে আমি যোগদানের আগেই প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। যে কারণে এতে আমার সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগ নেই। তবে আমি দায়িত্ব নেয়ার পর খোঁজ নিয়ে দেখেছি, উত্থাপিত এসব অভিযোগের ৯৫ শতাংশই মিথ্যা।’
তাহলে সংসদীয় কমিটি বিষয়টি আমলে নিল কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এটি সংসদীয় কমিটির আমলে নেয়ার কথা নয়। বিষয়টি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা আসায় কমিটি আমার কাছে প্রকৃত ঘটনা জানতে চেয়েছিল। আমি তাদের ব্যাখ্যা দিয়েছি। তার পরও যদি কমিটি এটি আমলে নেন তাহলে তো কিছু বলার থাকে না।’
সূত্রমতে, এলডিডি প্রকল্পের অনুমোদিত ব্যয়ে প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের অতিথির জন্য একটি চেয়ারের দাম ধরা হয়েছে ৬ লাখ টাকা। প্রকল্প পরিচালক ও পরামর্শকের চেয়ার-টেবিলের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ লাখ টাকা। গাভি গর্ভবতী কি না, তা পরীক্ষার জন্য ৬৫ ইউনিট কিট কেনা হবে। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। প্রতি ইউনিট (এক হাজার পিস) কিটের পেছনে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা। অথচ বাংলাদেশে গাভি গর্ভবতী কি না, তা হাত দিয়েই পরীক্ষা করা হয়। কিটের ব্যবহার হয় না বললেই চলে।
প্রান্তিক খামারির মধ্য থেকে গর্ভবতী অবস্থায় ৪ হাজার গরুকে ১০০ দিনের খাবার (ক্যাটল ফিড) বিনামূল্যে দেয়ার জন্য বরাদ্দ ৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রতিটি গরুর পেছনে খাবারের বরাদ্দ ২৪ হাজার টাকা। মাঠকর্মীরা সাইকেলে বহন করতে পারবেন এমন কিটবক্স কেনার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। প্রতিটি কিটবক্সের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার টাকা। দেশের ১ হাজার ৮৬০টি স্থানে গরু-ছাগলের প্রদর্শনী করা হবে। এতে ব্যয় হবে ৪৬ কোটি ৩১ লাখ টাকা।
প্রতিটি প্রদর্শনীর পেছনে ব্যয় হবে ২ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। দেশের ২ হাজার স্কুলে দুগ্ধজাত পণ্যের প্রদর্শনীতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২১০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। প্রতিটি প্রদর্শনীর জন্য ব্যয় হবে ১০ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। কোনো পশু বা মানুষের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে যা একটি ঘূর্ণায়মাণ যন্ত্রের মধ্যে রাখা হয় যেটি ‘সেন্টার ফিউজ’ নামে পরিচিত। একটি সেন্টার ফিউজের দাম ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ২৮০ টাকা। এ ধরনের ১৯টি সেন্টার ফিউজ কেনা খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।
এদিকে তরলের অম্লতা পরিমাপের যন্ত্র পিএইচ মিটারের দাম ধরা হয়েছে ৭০ হাজার টাকা। একটি অটোক্লেভ মেশিনের দাম ধরা হয়েছে ৯ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। একটি ডিজিটাল মাইক্রোসকপির (অণুবীক্ষণ যন্ত্র) দাম ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৮২ হাজার টাকা। উপজেলা শহরে যেসব মাংস বিক্রির অবকাঠামো রয়েছে, তা সংস্কারে ব্যয় করা হবে ৪১১ কোটি টাকা। ১৯২টি উপজেলা শহরের মাংসের দোকান সংস্কারে এ ব্যয় করা হবে। প্রতিটির পেছনে ব্যয় হবে ২ কোটি ১৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। অথচ এ অর্থ দিয়ে নতুন করেই এমন অবকাঠামো নির্মাণ করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। গবেষণাগারের বর্জ্য রাখার জন্য প্রতিটি পাত্রের ব্যয় ধরা হয়েছে আড়াই লাখ টাকা। অথচ বাজারে এটি বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। এছাড়া প্রকল্পের প্রচার-প্রচারণার জন্য ব্যয় রাখা হয়েছে ২৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
জানা গেছে, প্রকল্পের কেনাকাটার এই দাম নির্ধারণ করেছেন তৎকালীন প্রকল্প পরিচালক ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ওয়াসিউদ্দিন আহমেদ। স¤প্রতি এ প্রকল্প থেকে তাকে সরিয়ে সরকারের যুগ্ম সচিব মো. আবদুর রহিমকে এ পদে নিযুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ ধরনের প্রকল্প মূলত কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত সম্পদই বৃদ্ধি করে, মানুষের লাভ হয় না। উল্টো বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে আনা ঋণ জনগণকে পরিশোধ করতে হয়।
তিনি বলেন, প্রকল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক ধাপ পেরিয়ে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর অর্থ হলো একটি সামগ্রিক দুর্নীতির চক্র এখানে কাজ করছে।