মহান বিজয় দিবস আজ। বিজয়ের দিন। ১৯৭১ সালে দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই দিনে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সূর্য। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে দীর্ঘদিনের শোষণ আর বঞ্চনার। বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকীতে আজ পুরো জাতি পরম শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী লাখো শহীদকে। যাদের জীবন উৎসর্গে আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তির স্বাদ নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার এ দিনে লাল সবুজের উৎসবে উদ্বেলিত হবে জাতি। উচ্চারিত হবে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার শপথ।
বিজয়ের ৪৯ বছর পেরিয়ে এবার ৫০তম বিজয় দিবস। এবারের বিজয় দিবস এসেছে ভিন্ন এক প্রেক্ষাপটে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর এ বছরেই ২০২১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার ৪৯ বছরে অনেক অর্জন-সাফল্য আছে। রয়ে গেছে, অনেক অপ্রাপ্তিও। এখনো একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। সামনে সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্যের অবসান ঘটানোই হওয়া উচিত বিজয় দিবসের শপথ। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে দেশব্যাপী পালিত হবে নানা কর্মসূচি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হবে এসব কর্মসূচি। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা পৃথক বাণীতে দেশবাসীকে বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
আজ প্রত্যুষে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হবে। এরপর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। আজ সরকারি ছুটির দিন। সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাসমূহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপসমূহ জাতীয় পতাকা ও অন্যান্য পতাকায় সজ্জিত করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে এদিন সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ভার্চ্যুয়ালি ‘জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ ও ডিজিটাল প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জাতীয় সমৃদ্ধি অর্জন’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভ ও ভূগর্ভস্থ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যভিত্তিক পোস্টার প্রদর্শনীর আয়োজন করা হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্পসংখ্যক দর্শনার্থীকে সেখানে প্রবেশের সুযোগ দেয়া হবে বলে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
বিজয় দিবস উপলক্ষে ডাক বিভাগ স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মার মাগফিরাত ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সুস্বাস্থ্য কামনা এবং দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি কামনা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিশেষ দোয়া ও উপাসনার আয়োজন করা হবে। এ ছাড়াও এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল, জেলখানা, শিশু বিকাশ কেন্দ্রসহ অনুরূপ প্রতিষ্ঠানসমূহে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে এবং বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে অনুরূপ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। করোনাভাইরাস ঝুঁকির কারণে এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন কর্মসূচি পালন করা হবে। প্রতি বছর তেজগাঁও পুরাতন বিমানবন্দরস্থ জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সম্মিলিত বাহিনীর বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ হলেও এবার তা বাতিল করা হয়েছে।
বিজয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জাসদ, সিপিবি, ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি উদ্যাপন করবে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ, দোয়া, মিলাদ মাহফিল, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি প্রথম জেগে উঠে ৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারি। ফাগুনের আগুনে ভাষা আন্দোলনের দাবি আর উন্মাতাল গণমানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাত একাকার হয়ে যায় সেদিন। ভাষার জন্য প্রথম বলীদান বিশ্ববাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করে। সেই থেকে শুরু বাঙালির শেকল ভাঙার লড়াই। পলাশীর আম্রকাননে হারিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার লাল সূর্য আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত হয়ে দেখা দেয় বাংলার আকাশে। বাষট্টি, ঊনসত্তর এবং ’৭০-এর পথ ধরে উত্তাল একাত্তরে বাঙালি চিরতরে পরাধীনতার শেকল মুক্তির গান রচনা করে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। ৭ই মার্চ একাত্তরের বিশাল জনসমুদ্র থেকে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি আরো দেব, তবুও এদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। মূলত সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তির সংগ্রাম। ২৫শে মার্চ ঘুমন্ত জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। শুরু হয় বাঙালি নিধনযজ্ঞ। মুক্তি পাগল বাংলার দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার রক্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনবে বলে অস্ত্র কাঁধে তুলে নেয়। ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, কামার-কুমার সবাই শরিক হয় মুক্তির এ লড়াইয়ে। ডিসেম্বর শেষ পর্যায়ে এসে চূড়ান্ত রূপ নেয় মুক্তির সংগ্রাম। অবশেষে ন’মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে আসে স্বপ্নের প্রভাত। ১৬ই ডিসেম্বর সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সূচিত হয় মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য বিজয়। বিজয়ের সোনালী দিন।