ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ঐতিহাসিক স্থাপত্য কুতুব মিনারের প্রাঙ্গণে অতীতে হিন্দু ও জৈন মন্দিরের অস্তিত্ত্ব ছিল, এই দাবি জানিয়ে মামলা করেছেন দু’জন আইনজীবী।
ওই কথিত মন্দিরে হিন্দু ও জৈনরা যাতে পূজা এবং উপাসনা করার অধিকার ফিরে পান, সেই দাবি জানিয়ে তাদের করা আবেদন দিল্লির একটি দেওয়ানি আদালত গ্রহণ করেছে।
বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এই দাবিতে সক্রিয় সমর্থনও জানাচ্ছে।
তবে ভারতে ইতিহাসবিদরা অনেকেই মনে করছেন, সে দেশে মুসলিম শাসনামলের বিভিন্ন পুরাকীর্তিকে যেভাবে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণে ‘পুনরুদ্ধারে’র চেষ্টা চলছে – কুতুব মিনার সেই তালিকায় সবশেষ সংযোজন।
শাহী দিল্লির আইকনিক স্থাপত্য কুতুব মিনারের নির্মাণ শুরু করেছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেক, যিনি ছিলেন মুহাম্মদ ঘোরীর একজন সেনাপতি।
১১৯২ সালে মুহাম্মদ ঘোরীর কাছে পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের পরই দিল্লিতে হিন্দু শাসনের অবসান হয়, আর তার কয়েক বছর পরেই শুরু হয় এই মিনারের নির্মাণকাজ।
এখন দিল্লির সাকেত ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে পেশ করা এক আবেদনে আইনজীবী হরিশঙ্কর জৈন এবং রঞ্জনা অগ্নিহোত্রী বলেছেন, ওই কমপ্লেক্সে আগে থেকেই শ্রীবিষ্ণুহরিসহ হিন্দু ও জৈন দেবতাদের ২৭টি মন্দির ছিল।
তাদের দাবি, সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেক সেগুলো ভেঙ্গেই তৈরি করেছিলেন কুওয়াত-উল ইসলাম মসজিদ, আরবি ভাষায় যার অর্থ হলো- ‘ইসলামের শক্তি’।
হিন্দুদের ভগবান বিষ্ণুহরিদেবের ‘মিত্র’ হিসেবে মামলাটি যিনি দায়ের করেছেন, সেই অ্যাডভোকেট হরিশঙ্কর জৈন বলছিলেন, ‘আট শ’ বছর ধরে ওই মসজিদ খালিই পড়ে আছে, কেউ সেখানে নামাজ পড়েনি।’
‘অন্য দিকে ওই স্থানটির ওপর হিন্দুদের দাবি প্রতিষ্ঠিত – স্বাধীন ভারতেও তারা যদি সেখানে পূজা বা দর্শনের অনুমতি না-পায়, তাহলে আর কী বলার থাকে?’
আর সহ-আবেদনকারী রঞ্জনা অগ্নিহোত্রী বলেন, ‘কুতুবউদ্দিন আইবেকের নিজের স্থাপিত ফলকেও পরিষ্কার বলা ছিল, ২৭টি হিন্দু ও জৈন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের ওপরই এই মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বছরখানেক আগে যে রামমন্দির নির্মাণের রায় দিয়েছিল, সেখানেও ভেঙ্গে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় আগে প্রাচীন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্ত্বকে মেনে নিয়েছিল দেশের শীর্ষ আদালত।
সেই ধারাবাহিকতায় কুতুব মিনার কমপ্লেক্সেও হিন্দুরা পূজা-অর্চনার অধিকার ফিরে পাবেন বলে মনে করছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।
পরিষদের জাতীয় মুখপাত্র বিনোদ বনসল বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ইতিহাস এই সাক্ষ্যই দেয় যে, অতীতে বহু মন্দির ভেঙ্গেই সেই ধ্বংসস্তূপের ওপর মসজিদ কিংবা মুঘল যুগের নানা স্থাপত্য নির্মিত হয়েছিল। কুতুব মিনারেও একই ঘটনা ঘটেছিল।’
‘এখন তাজমহল চত্বরে যদি মুসলিমদের নামাজ পড়ার অধিকার থাকে, তাহলে তো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে হিন্দুদেরও কুতুব মিনারে একই অধিকার পাওয়া উচিত।’
তবে ইদানীংকালে ভারতে বিভিন্ন মুসলিম যুগের স্থাপত্যকে যেভাবে হিন্দু ঐতিহ্যর আলোকে নতুন করে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে, এটাকেও সেই চেষ্টারই অংশ বলে মনে করছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইতিহাসবিদ পারুল পান্ড্য ধর।
ড. পান্ড্য ধরের কথায়, ‘এখানে প্যাটার্নটা তো আমাদের খুব চেনা, ন্যারেটিভটাও নতুন নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইতিহাসকে আপনি কীভাবে পাল্টাবেন আর ঠিক কোন পয়েন্ট থেকে পাল্টাবেন?’
‘তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই কুতুব মিনারেও ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয়কে বদলে দেয়া হয়েছিল, তাহলেও আপনি এখন এরকম ক’টা জিনিস বদলাবেন?’
‘হিন্দু রাজাদের নিজেদের মধ্যেও তো অনেক লড়াই হয়েছে – পল্লব আর চালুক্যরাও একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ফলে ইতিহাসের কোন মুহূর্তটাকে আপনি বিশুদ্ধ, আদি ও অকৃত্রিম ধরবেন? এটা তো হাস্যকর চেষ্টা’, বিবিসিকে বলছিলেন এই ইতিহাসবিদ।
দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্স জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠান ইউনেসকোর স্বীকৃত একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, যা ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সংস্থা বা এএসআইয়ের নিয়ন্ত্রণে।
এখন আদালত যদি সেখানে হিন্দু বা জৈনদের সত্যিই পূজার অধিকার দেয়, তাতে যে নতুন বিতর্কের দরজা খুলবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সূত্র : বিবিসি