আপন দুই ভাই ইসা বাদশা ও মুসা বাদশা। তাদের বাবা বাদশা মিয়া সওদাগর চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে গড়েছিলেন বাদশা গ্রুপের নামের প্রতিষ্ঠান। তবে বাবা মারা যাওয়ার পর গ্রুপের তালা মার্কা সাবান ও ভেজিটেবল অয়েলের সুনাম আর ধরে রাখতে পারেনি তারা। পরে জাহাজ ভাঙাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে আটটি ব্যাংক থেকে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আর তা শোধ করেননি। দেশ রূপান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইসা বাদশা ও মুসা বাদশা এখন কানাডার টরন্টোয় বাদশাহি জীবনযাপন করছেন। টরন্টোর লেকশোর এলাকায় তাদের দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি ও নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদিকে বাংলাদেশের আটটি ব্যাংক ওই ৫০০ কোটি টাকা আদায়ে তাদের পেছনে ছুটে একরকম হয়রান, আদালতের খাতায় যারা এখন ‘ফেরারি’। চট্টগ্রামের বাকলিয়ার বাদশা মিয়া সওদাগর কঠোর পরিশ্রম করে তালা মার্কা সাবান
ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাদশা গ্রুপের যাত্রা শুরু করান। পরে তার ছেলেরা পুরনো জাহাজ এনে ভাঙার বা স্ক্র্যাপের ব্যবসা শুরু করেন। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে ট্রেডিং অ্যান্ড কমিশন এজেন্ট মুসা ইসা ব্রাদার্স, স্ক্র্যাপ ট্রেড ও শিপ ব্রেকার্স প্রতিষ্ঠান মেসার্স ঝুমা এন্টারপ্রাইজ, ট্রেডিং অ্যান্ড কমিশন এজেন্ট এমএম এন্টারপ্রাইজ, সাবান ও তেল কোম্পানি বাদশা ওয়েল অ্যান্ড সোপ ফ্যাক্টরি ও ডেইরি অ্যান্ড ডেইরি ফুড প্রোডাক্ট প্রতিষ্ঠান আজান এন্টারপ্রাইজ (প্রস্তাবিত)। এছাড়া খাতুনগঞ্জের বাণিজ্যিক ভবন বাদশা মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়েন তারা। সবকটি প্রতিষ্ঠানেরই প্রধান কার্যালয় বাদশা মার্কেট ১৭৩, খাতুনগঞ্জ, চট্টগ্রামে। বড়ভাই ইসা বাদশা মিডল্যান্ড ব্যাংকের স্পন্সর (উদ্যোক্তা) পরিচালক ছিলেন। বিভিন্ন ব্যাংকে খেলাপি হওয়ায় পরিচালক পদ থেকে তাকে বাদ দেওয়া হয়। ওই ব্যাংকে ইসা-মুসার ৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
কানাডাপ্রবাসী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক দেশ রূপান্তরকে জানান, ইসার নিজের নামে লেকশোর এলাকায় দুটি কন্ডোমিনিয়ামের (বিলাসবহুল অভিজাত ফ্ল্যাট) রয়েছে। যার বর্তমান বাজার দর তিন মিলিয়ন কানাডিয়ান ডলারের বেশি। মুসার নামেও রয়েছে আলাদা বাড়ি। তারা দুই ভাই এখন সপরিবারে থাকেন কানাডায়। তারা বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে তেমন একটা মেশেন না। বিলাসবহুল গাড়িতে চলাফেরা করেন। বেনামেও কানাডায় তাদের অনেক সম্পত্তি ও ব্যবসা রয়েছে বলে ধারণা সাংবাদিকদের। তারা সেগুলোর খোঁজ-খবর নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন।
দেশ রূপান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরোর সহযোগিতায় অনুসন্ধানে জানা গেছে, ইসা ও মুসার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ইস্টার্ন ব্যাংক আগ্রাবাদ শাখায় এমএম এন্টারপ্রাইজ ও ঝুমা এন্টারপ্রাইজের নামে পাওনা ১৫৬ কোটি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, ওয়ান ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখায় মুসা অ্যান্ড ইসা ব্রাদার্সের নামে পাওনা ১৬৮ কোটি টাকা, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখায় ঝুমা এন্টারপ্রাইজের নামে পাওনা প্রায় ৫৬ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় মুসা অ্যান্ড ইসা ব্রাদার্সের নামে পাওনা ১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা, মার্কেটাইল ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখায় তাদের খেলাপি ঋণ প্রায় ৭৫ কোটি টাকা টাকা, মেঘনা ব্যাংক জুবিলী রোড শাখায় তাদের খেলাপি ঋণ প্রায় ৬০ কোটি, প্রাইম ব্যাংকে ঝুমা এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ বাবদ পাওনা ৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। এছাড়া আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকেও ‘বড় অঙ্কের’ ঋণ আছে।
ইস্টার্ন ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখা গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে ইসা-মুসার বন্ধকী সম্পত্তি বিক্রির জন্য পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি দেয়। তাতে বলা হয়, ইস্টার্ন ব্যাংক চট্টগ্রামের ঋণগ্রহীতা মেসার্স এমএম ইন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স ঝুমা এন্টারপ্রাইজ। উভয় প্রতিষ্ঠানের মালিক আলহাজ মোহাম্মদ ইসা বাদশা ওরফে মহসিন ও মোহাম্মদ মুসা বাদশা। এমএম এন্টারপ্রাইজের কাছে ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত ঋণের বিপরীতে সুদসহ ৩৩ কোটি ৫১ লাখ ১৭ হাজার টাকা এবং ঝুমা এন্টারপ্রাইজের ঋণের বিপরীতে সুদসহ ১২২ কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার ৯৭৬ টাকা পাওনা। অর্থাৎ দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে সুদসহ ব্যাংকটির পাওনা ১৫৬ কোটি ৩৭ লাখ ৯৮ হাজার ৬৩ টাকা। ব্যাংক কর্র্তৃপক্ষ দলিল ও জমির নম্বর উল্লেখসহ ১০টি শর্ত সাপেক্ষে সেগুলো বিক্রির জন্য ওই নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে বন্ধকী সম্পত্তির তফসিলের বিবরণ দেওয়া হয়।
ইসা ও মুসা প্রায় ১৫৭ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে কানাডায় পালিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আলী রেজা ইফতেখার গতকাল শনিবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমরা পাওনা আদায়ের জন্য তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছি। তাদের যেসব সম্পদ বন্ধক রয়েছে সেগুলো বিক্রির জন্য নিলামে তুলেছি। যেসব সম্পদ মর্টগেজ করা নেই সেগুলো আমরা খুঁজছি। টাকা উদ্ধারের জন্য আইনি যেসব প্রক্রিয়া সবই আমরা করছি।’ দুই ভাইয়ের নামে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) কোনো অভিযোগ দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না আমরা অভিযোগ দিইনি। টাকাগুলো উদ্ধারের জন্য মামলাসহ আইনি সব প্রক্রিয়া অনুসরণ করছি। আমাদের মামলাগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি।’ অন্য ব্যাংকেও ‘বড় অঙ্কের’ ঋণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্য ব্যাংকের লোনের পরিমাণ আমার জানা নেই। তাদের জাহাজ ভাঙা ও সাবান ফ্যাক্টরির ব্যবসা রয়েছে। আমাদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণগুলো মূলত জাহাজ ভাঙার নামে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝুমা এন্টারপ্রাইজ ও মুসা অ্যান্ড ইসা ব্রাদার্সের খেলাপি ঋণ আদায়ে গত বছর ২৮ নভেম্বর ওয়ান ব্যাংক চট্টগ্রামের জুবিলী রোড শাখা অর্থঋণ আদালতে মামলা করে। এ বিষয়ে ওয়ান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম ফখরুল আলমের কাছে জানতে চাইলে গতকাল দেশ রূপান্তরকে তিনি বলেন, ‘তাদের বিরুদ্ধে পাওনা আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে মামলা চলছে। ফাইল না দেখে এ বিষয়ে বলতে পারব না।’
একই দিনে অর্থাৎ গত ২৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের অর্থঋণ আদালতে ঝুমা এন্টারপ্রাইজের বিরুদ্ধে ৫ কোটি ৫৭ লাখ টাকা আদায়ের জন্য একটি মামলা করে প্রাইম ব্যাংক। এর আগে ৩১ মে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা ঝুমা এন্টারপ্রাইজের ৫৬ কোটি টাকা আদায়ের জন্য মামলা করে। সম্প্রতি এক্সিম ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা মুসা অ্যান্ড ইসা ব্রাদার্সের ১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার পাওনা আদায়ের জন্য বাকলিয়া ও কোতোয়ালি থানা এলাকায় থাকা প্রায় ৫২ ডিসিমেল জমি (বন্ধকী সম্পত্তি) বিক্রয়ের জন্য নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। গত ২৩ জানুয়ারি ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখায় এই নিলাম হয়।
দেশ রূপান্তরের চট্টগ্রাম ব্যুরোর মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, খাতুনগঞ্জের বাদশা মার্কেটে তৃতীয় তলায় বাদশা গ্রুপের প্রধান বাণিজ্যিক অফিস। বেশ কয়েকটি টেবিল থাকলেও মাত্র একজন অফিস সহায়ক কাজ করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই অফিস সহায়ক বলেন, ‘আমাদের গ্রুপের অবস্থা ভালো নয়। অফিসে কথা বলার মতো কেউ নেই। দুই মালিক দেড় বছর আগে পরিবারসহ কানাডায় চলে গেছেন। শুনেছি ব্যাংকের সঙ্গে ঝামেলা চলছে। তারা আর ফিরবেন না।’
মিডল্যান্ড ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপির হওয়ায় মিডল্যান্ড ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালক পদ থেকে বাদ পড়েছেন ইসা বাদশা। তিনি ব্যাংকের অডিট কমিটির সদস্য ছিলেন। ব্যাংকটিতে ইসা ও তার পরিবারের নামে ৫ শতাংশ শেয়ার আছে।
ইসা-মুসা সম্পর্কে জানতে চাইলে খাতুনগঞ্জ ব্যবসায়ী সমিতির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একসময় তালা মার্কা সাবান ও ভেজিটেবল অয়েল বিক্রি করে বাদশা গ্রুপ ভালোই ব্যবসা করেছিল। বাদশা মিয়া সওদাগরের নিজহাতে গড়া প্রতিষ্ঠানটি ছেলেরা ধরে রাখতে পারেনি। তারা বাড়তি লাভের আশায় জাহাজ ভাঙা ও অন্যান্য ব্যবসা শুরু করে। অনভিজ্ঞতার কারণে ব্যর্থ হয়। আটটি ব্যাংক তাদের কাছে ৫০০ কোটি টাকারও বেশি পাবে। তারা ঋণ খেলাপি হলেও সেগুলো পুনঃতফসিলের চেষ্টা করেনি। ওই ব্যবসায়ীর দাবি, তারা মূলত ব্যাংক লোন নিয়ে অবৈধপথে ওইসব অর্থ কানাডায় পাচার করেছে। শুনেছি পাচারের অর্থ দিয়ে তারা সেখানে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। ইসা-মুসার আবাসিক ঠিকানা চট্টগ্রামের খুলশী থানার ৫ নম্বর সড়কের ১৩, খুলশী হিলে। সীতাকুণ্ডে মধ্যসোনাই ছড়িতে তাদের জমিসহ বিভিন্ন সম্পত্তি রয়েছে। এছাড়া নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তাদের ব্যবসা ছিল।আলাউদ্দিন আরিফ |
সুত্র:
দেশ রূপান্তর