যুবলীগের সাবেক দফতর সম্পাদক কাজী আনিসের অন্তত একশ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার সব অবৈধ সম্পদ জব্দ করা হয় বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। দুদকের পরিচালক প্রণব কুমার ভট্টাচার্য যুগান্তরকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন। জব্দ করা সম্পদের মধ্যে রয়েছে ফ্ল্যাট, জমি, বাড়ি, গাড়ি ও নগদ টাকা।
আনিসের উত্থান যেন রূপকথার গল্প। ক্যাসিনো ব্যবসা ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে গার্মেন্টকর্মী থেকে পাঁচ বছরে শতকোটি টাকার মালিক বনে যান তিনি। বিদেশেও রয়েছে তার অঢেল সম্পদ। তার বাবা পেনশনের কিছু টাকা দিয়ে কষ্টশৃষ্টে সংসার চালাতেন। মেয়েদেরও বিয়ে দেন পেনশনের টাকা থেকেই। কাজী আনিস অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়ে ঢাকায় গার্মেন্টে চাকরি নেন। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি করতেন তিনি। ২০১০ সালের পর কাজী আনিসের ভাগ্যে রূপকথার জাদুর কাঠির ছোঁয়া লাগে। যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুকের ডানহাত হয়ে রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক বনে যান।
দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কাজী আনিস ক্যাসিনো বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, যুবলীগের কমিটিতে পদ-পদবি বিক্রি ও চাঁদাবাজিসহ নানা কায়দায় প্রায় শতকোটি টাকা উপার্জন করেন। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে নাম এলে দুদক তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নামে। প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে গত বছর ২৯ অক্টোবর ১২ কোটি ৮০ লাখ ৬০ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদের মামলা করে। তবে তদন্তে বেরিয়ে আসে তার বিপুল সম্পদের তথ্য। দুদকের তদন্তে কাজী আনিসের প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।
তার অবৈধ সম্পদের মধ্যে গ্রামের বাড়ি বাউলিয়া এবং মুকসুদপুরে ২৫টি দলিলে কয়েক কোটি টাকার সম্পদের তথ্য মেলে। দলিলগুলোও জব্দ করা হয়। তার নিজের এলাকায় বর্তমান বাজারমূল্যে ২০ কোটি টাকার বেশি স্থাবর সম্পদ রয়েছে। নিজ গ্রামে পুুকুর, আলিশান বাড়ি ও পুকুরঘাট করে কয়েক কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। বাড়িটির কিছু অংশ পৈতৃক ভিটায় তৈরি করলেও তার বাবা দুদক টিমকে বলেছেন, তার কাছে বাড়ি করার মতো কোনো টাকাপয়সা ছিল না। তার ছেলে কাজী আনিস বাবা মো. ফায়েক কাজীর নামে মুকসুদপুরস্থ অগ্রণী ব্যাংকের শাখায় টাকা পাঠাতেন। সেই টাকা দিয়ে বাড়িটি তৈরি করেন তিনি। কাজী আনিসের গ্রামের বাড়ি ছাড়াও জমি ক্রয় এবং কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বাবার নামে মুকসুদপুরের দাসেরহাটে পেট্রলপাম্প ক্রয় করেন। পেট্রল পাম্পটি প্রথমে ফায়েক কাজীর নামে কোটি টাকায় ক্রয় করেন। বছর দুয়েক পর ফায়েক কাজী আবার কাজী আনিসকে হেবা করে দেন সেটি। এ ব্যাপারে ফায়েক কাজীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান, টাকা তো আনিসেরই ছিল। তাই তাকে হেবা করে দিয়েছি। দোষ কোথায়।
কেরানীগঞ্জে ৮টি দলিলে জমি ক্রয়ের রেকর্ড পায় দুদক। পরে তা তদন্তকারী কর্মকর্তা সেই দলিল এবং স্থাবর সম্পদ জব্দ করেন। এর বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১৩ কোটি টাকা। এছাড়া প্রায় ৪ কোটি টাকায় ধানমণ্ডি ১০/এ-তে ৪০০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটসহ তিনটি গ্যারেজ ক্রয় করেন কাজী আনিস। রাজধানীর ওয়ারীতে রয়েছে তার বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট, যা রেজিস্ট্র মূল্য থেকে প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি। নিউ এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে রয়েছে তার তিনটি দোকান। মার্কেটের সামনের অংশে ১৩০০ বর্গফুটের জমিও ক্রয় করেন তিনি। এর বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। রাজধানীর গুলশান উত্তর বাণিজ্যিক এলাকায় হোল্ডিং নং-২৮, ল্যান্ডভিউ কমার্শিয়াল সেন্টার ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে তার দুটি সুপরিসর দোকান। এর বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা। এছাড়া তার স্ত্রী শিমু রহমানের নামে ধানমণ্ডির শুক্রাবাদে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট রয়েছে। এর বাজারমূল্য ৫ কোটি টাকারও বেশি। অপরদিকে তদন্তকালে কাজী আনিসের ৫০টি ব্যাংক হিসাব পাওয়া যায়। এসব হিসাবে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য মিলে। ওই হিসাবে বর্তমানে জমা রয়েছে ৬ কোটি টাকা। আদালতের আদেশে ওই টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে। এছাড়া তার স্ত্রী শিমু রহমানের নামে রয়েছে ২০টি হিসাব। এই হিসাবগুলোও জব্দ করা হয়েছে।
তদন্তকালে কাজী আনিসের সম্পদের তথ্য চেয়ে ৭৬ জায়গায় পত্র দেয় দুদক। সেগুলো পাওয়ার পরই সবকিছু জব্দ করা হয়েছে বলে জানান তদন্ত কর্মকর্তা। কাজী আনিস এবং শিমু রহমানের আয়কর নথিও জব্দ করা হয়েছে। কাজী আনিস ও শিমু রহমান বর্তমানে বিদেশে পলাতক। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্টারপোলের সহায়তা নিতে চায় দুদক। গোপন সূত্র থেকে দুদক জানতে পেরেছে ভারত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় কাজী আনিসের বাড়ি-গাড়ি রয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তারা সেই তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছেন। মিজান মালিক