চাঞ্চল্যকর জিবরান তায়েবি হত্যা মামলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইয়াসিন রহমান (টিটু)। অভিযোগ রয়েছে, জেলবন্দি অবস্থায় কারাগারের ভেতরেই কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠান কেওয়াই স্টিলের ব্যবসায়িক নীতিনির্ধারণী সভা করে গিয়েছেন তিনি। এমনই এক সভা চলাকালে প্রতিষ্ঠানের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে কারাগারের ভেতরেই মারধরের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
১৯৯৯ সালে চট্টগ্রামের দেওয়ানহাট এলাকায় একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের সামনে খুন হন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা টিএ খানের ছেলে জিবরান তায়েবি। বেসরকারি একটি শিপিং কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তাকে হত্যার ঘটনায় মামলা করেন তার স্ত্রী তিতলী নন্দিনী। ২০০২ সালের ১২ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালত আসামি ইয়াসিন রহমানকে বেকসুর খালাস দিয়ে অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন। রাষ্ট্রপক্ষ এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে উচ্চ আদালত ২০০৭ সালের ২৮ মার্চ ইয়াসিনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ঘোষণা করেন। পরে ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর যুক্তরাজ্য থেকে এসে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। আত্মসমর্পণের পর অসুস্থতার অজুহাতে ইয়াসিন এক বছর আড়াই মাস হাসপাতালে ছিলেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে সঙ্গে সঙ্গেই তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
অভিযোগ রয়েছে, এর পর থেকে কারাগারের ভেতরেই ব্যবসায়িক নীতিনির্ধারণী বৈঠক করতেন ইয়াসিন রহমান। দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হওয়ায় আইনি কারণেই কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আনুষ্ঠানিক কোনো পদে ছিলেন না তিনি। যদিও কারাগারে বসেই তিনি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেন। জেলে বসেই নিয়মিত বৈঠক করে গিয়েছেন কেওয়াই স্টিলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
এ রকমই একটি সভা চলাকালে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল বিকালে বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে কারাবন্দি ইয়াসিন রহমান টিটু চট্টগ্রাম কারাগারের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠানটির তত্কালীন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মুনির হোসেন খানকে মারধর করেন। ঘটনাটি ঘটে জেল সুপারের কক্ষের পাশে কনফারেন্স রুমে। প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টস ইনচার্জ ইমরান হাসান ও জিএম আব্দুল কালামও তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. কামাল হোসেন বলেন, ঘটনাটি যখন ঘটে তখন আমি দায়িত্বে ছিলাম না। মাত্র কিছুদিন হলো যোগদান করেছি। তবে কারাগারের ভেতরে অফিশিয়াল সভা পরিচালিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
খোঁজ নিয়ে জনা যায়, ওই সময় চট্টগ্রাম জেলের সুপার ছিলেন বর্তমানে ময়মনসিংহ কারাগারের দায়িত্বে থাকা ইকবাল কবীর। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ইকবাল কবীর এ প্রসঙ্গে বলেন, কারাগারে কেওয়াই স্টিলের কর্মকর্তাদের সভা বা কাউকে মারধরের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এর বেশি কিছু বলতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন এবং মুঠোফোনের সংযোগটিও বিচ্ছিন্ন করে দেন ।
এদিকে ঘটনার পর থেকেই ভয়াবহ হয়রানির মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন ইয়াসিন রহমানের মারধরের শিকার মুনির হোসেন খান। ওই সময় বিষয়টি কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের বড় ছেলে ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমানকে অবহিত করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে অপমানবোধ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। পরে ২০১৯ সালে তিনি ভিন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেন। এর পর থেকেই তার নামে একের পর এক মামলা করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, মুনির হোসেন খান কেডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমানের স্কুল জীবনের সহপাঠী। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে বন্ধুর অনুরোধে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশে এসে কেওয়াই স্টিলে যোগদান করেন মুনির। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেডিএস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানটির ব্যবসায়িক সাফল্যও বাড়তে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৭ সালে তিনি নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পান। ব্যবসায়িক কলেবর আরো বড় হতে থাকলে ২০১০ সালে কোম্পানির পরিচালক হিসেবেও (পেইড ডিরেক্টর) পদায়ন করা হয় তাকে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, মুনির হোসেন খান চাকরিতে থাকা অবস্থায় ভারতের আগরতলায় একটি ফ্যাক্টরি স্থাপন করে কেডিএস গ্রুপ। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বিনিয়োগের জটিলতা থাকায় ওই কারখানার দলিল প্রস্তুত করা হয় মুনির হোসেন খানের নামে। মার্কিন পাসপোর্টধারী হওয়ায় কারখানা স্থাপন থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় সুবিধা পেতেই ওই সময় তার নামে দলিল প্রস্তুত করা হয়।
পরে জিবরান তায়েবি হত্যার দায়ে ইয়াসিন রহমানের কারাদণ্ড শুরু হয়। দণ্ড শুরু হওয়ার পর কারাগারে নিয়মিত কেওয়াই স্টিলের ব্যবসায়িক পলিসি ও কার্যক্রম নিয়ে প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। এক পর্যায়ে কেওয়াই স্টিল পরিচালনা নিয়ে ইয়াসিন রহমান টিটুর সঙ্গে মুনির হোসেন খানের দূরত্ব তৈরি হয়, যা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এর জের ধরেই কারাগারের ভেতর তাকে মারধর করেন ইয়াসিন রহমান।
কেডিএস থেকে পদত্যাগ করার পর মুনির হোসেন খানকে এক পর্যায়ে ভারতে স্থাপিত ফ্যাক্টরির মালিকানা থেকে শুরু করে সব দলিলাদি স্থানান্তর করে দিতে বলা হয়। প্রতিষ্ঠান থেকে চাকরি ছাড়ার এনওসি (ছাড়পত্র) পেলেই তিনি ফ্যাক্টরির সবকিছু বুঝিয়ে দেবেন বলে কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেন তিনি। কিন্তু কেডিএস কর্তৃপক্ষ এনওসি দেয়ার বদলে উল্টো মামলার হুমকি দেয়। এক পর্যায়ে গাড়ি চুরির মামলা দিয়ে তাকে হয়রানি করা শুরু হয়। একের পর এক মামলা মাথায় নিয়ে একপর্যায়ে জেলে আটক হন মুনির হোসেন খান। কেডিএস গ্রুপের মামলাগুলোয় শুধু তাকে নয়, মুনির হোসেন খানের বাবা, ছোট ভাই ও স্ত্রীকেও আসামি করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন মুনির হোসেন খানের পিতা চট্টগ্রাম বন্দরের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোয়াজ্জেম হোসেন খান। পুলিশও এখন বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
মোয়াজ্জেম হোসেন খান বলেন, আমার ছেলে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যানের ছেলে ইয়াছিন রহমানের সঙ্গে কেওয়াই স্টিলের সভা করতে যায়। সভা চলাকালে এক পর্যায়ে মুনিরকে অপদস্থ ও মারধর করেন তিনি। পরে মুনির অপমানবোধ থেকে কেডিএস গ্রুপে পদত্যাগপত্র দিয়ে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদান করলে তারা একের পর এক মিথ্যা মামলা দিতে থাকে। অথচ মুনির কেওয়াই স্টিলের কোনো টাকা আত্মসাৎ করেনি। আমি ছেলের জামিনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করায় আমাকে ও আমার ছোট ছেলেকেও মামলার আসামি করা হয়েছে। কিছু মামলায় মুনিরের স্ত্রীকেও আসামি করা হয়েছে। বিভিন্নভাবে এর সমাধান চেয়েও প্রতিকার পাইনি।
আদালতের নথি ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, মুনিরের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী থানায় পাঁচটিসহ ঢাকার গুলশান থানা ও আদালতে চলতি বছরের ৯ নভেম্বর পর্যন্ত মোট মামলা করা হয়েছে ২৪টি। সবক’টি মামলার এজাহার অভিন্ন। শুধু সময় ও অর্থের পরিমাণ ভিন্ন। তাকে গাড়ি চুরির মামলারও আসামি করা হয়েছে। অথচ যে সময় চুরির কথা বলা হয়েছে সে সময় মুনির হোসেন খান ঢাকায় ছিলেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সবক’টি মামলার বাদী কেডিএস গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান কেওয়াই স্টিলের চিফ অপারেটিং অফিসার জাবির হোসেইন। মামলাগুলোর অভিযোগে বলা হয়েছে, কেওয়াই স্টিলের বিপুল পরিমাণ টাকা বিল ও পেমেন্ট ভাউচারের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন মুনির হোসেন খান।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে কেডিএস গ্রুপের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, কেওয়াই স্টিলের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় চালকের আসনে ছিলেন মুনির হোসেন খান। কোম্পানির কোটি কোটি টাকা সরিয়ে নেয়ার অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে মামলাগুলো করা হয়েছে।
এ সময়ে কারাগারে মারধরের বিষয় জানতে চাইলে তিনি এ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। বণিক বার্তা