মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আজ ট্রাম্প না বাইডেন জটিল সমীকরণ

মার্কিন নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তেমন প্রতিক্রিয়া নেই, তবে কৌতূহল আছে। নীতিনির্ধারক বা সচেতন মহলের চোখ রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। মঙ্গলবারের নির্বাচনের ফল কি হতে যাচ্ছে? এটা স্পষ্ট যে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে আজ। বিশ্ব মিডিয়ার আগাম রিপোর্ট তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। এবারই প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেনশিয়াল নির্বাচন নিয়ে এতোটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়া ছাড়াও নির্বাচন আদালত পর্যন্ত গড়াতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন প্রার্থী এবং তাদের ঘনিষ্ঠরা। জালিয়াতির আগাম অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের ফল মেনে না নেয়ার হুমকি দিয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডনাল্ড ট্রাম্প।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোটা যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে নির্বাচন কেন্দ্রিক বিক্ষোভ-সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে ক’দিন ধরে প্রধান প্রধান শহরের অনেক দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। বেশকিছু স্থানে নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৯ কোটি ভোটার (আগাম) ভোট দিয়ে দিয়েছেন। ৩রা নভেম্বরে কমপক্ষে আরো ছয় কোটি ভোটার সরাসরি ভোট দিতে যাচ্ছেন। জনমত জরিপে এখনও পিছিয়ে আছেন রিপাবলিকান দলের প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। সেই বিবেচনায় পর্যবেক্ষকরা সুবিধাজনক অবস্থানে দেখছেন ডেমোক্রেট প্রার্থী, দুইবারের ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে। কিন্তু তারাও হলফ করে বলতে পারছেন না ভোটাররা চূড়ান্তভাবে কার হাতে হোয়াইট হাউসের চাবি তুলে দিতে যাচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মতামত বা জরিপ সব সময় সঠিক হবে এমন নয়। শেষ সময়ে নাটকীয়ভাবে হিসাব-নিকাশ পাল্টে যেতে পারে। এখন পর্যন্ত যত জরিপ প্রকাশিত হয়েছে তা মোটা দাগে ৩ ‘যদি’ আর ৫ ‘কিন্তু’তে আটকা। এসব জরিপের ওপর ভিত্তি করে দেশি-বিদেশি বিশ্লেষকরা নানা মন্তব্য করছেন। তারা বলছেন, অনেক কারণে এবার ডেমোক্রেট শিবির উচ্ছ্বসিত। পপুলার ভোটে দৃশ্যত তারা এগিয়ে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা জো বাইডেনের প্রতি ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে বলে মনে করেন তারা। ওয়াশিংটনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং বিশ্লেষক জো গার্সটেনসন মনে করেন করোনা মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা করছেন তাতে অধিকাংশ আমেরিকান খুশি নন। বিবিসিকে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্টের অবস্থা এমন যে, মনে হয় তিনি কেবলমাত্র প্রতিদিনের পরিস্থিতি আঁচ করার চেষ্টা করছেন এবং সে মতে সাড়া দিচ্ছেন। সর্বশেষ জনমত জরিপও বলছে যে, প্রতি ১০ জন আমেরিকানের সাতজনই মনে করেন কোভিড-১৯ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ‘ভুল বার্তা’ দিচ্ছেন। তবে মার্কিন ওই বিশ্লেষক এ-ও বলেন, এতো কিছুর পরও কোভিড ইস্যুতে রিপাবলিকান সমর্থকদের বেশির ভাগই প্রেসিডেন্টের পেছনে রয়েছেন। গার্সটেনসন বলেন, শুধু যে দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে মতামতে ভিন্নতা রয়েছে তা কিন্তু নয়। এলাকা ভেদেও জনমত ভিন্ন। যে এলাকার মানুষ এই প্যানডেমিকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তারা বেশি ক্ষিপ্ত। করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সংখ্যা- দু’দিক থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের তালিকায় এক নম্বরে। এখন পর্যন্ত দেশটির ৯০ লাখেরও বেশি মানুষ সংক্রমিত। মারা গেছে দুই লাখ ৩০ হাজারেরও বেশি। করোনার ভয়াবহ এই চিত্র এখনও সামান্যতম মলিন হয়নি বরং সংক্রমণের সংখ্যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বাড়ছে। মার্কিন বিশ্লেষকদের মধ্যে দ্বিমত নেই যে, আমেরিকায় এবারের নির্বাচনে প্রধান ইস্যু- করোনা। তাদের অনেকেই বলছেন, এবার রেকর্ড আগাম ভোটের অন্যতম কারণও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি। এ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের কারণে মঙ্গলবার কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারার উদ্বেগ যেমন রয়েছে তেমনি আগাম ভোটারদের মধ্যেও করোনা পরিস্থিতির বিষয়টি কাজ করছে। অনেক পর্যবেক্ষকের মতে কোভিড মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের দুর্বল পারফরমেন্সের প্রতিবাদ ব্যালটের মাধ্যমে প্রদর্শনে উন্মুখ হয়ে আছে মার্কিন ভোটাররা। তবে বিশ্লেষকরা এটাও বলছেন, পপুলার ভোট যাই হোক, দেখার বিষয় হচ্ছে- ইলেক্টোরাল ভোটের জটিল সমীকরণ কার জয়কে কতটা সহজ করে? যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ফেলো এম শহীদুল হক। তার মতে, জরিপ বলছে জো বাইডেন জয়ী হবেন। তিনিও তা-ই মনে করছেন। কোভিড ব্যবস্থাপনায় ট্রাম্প প্রশাসনের খেয়ালিপনাকে তিনিও অন্যতম কারণ হিসাবে দেখছেন। এই বিশ্লেষকের মতে, জো বাইডেনের প্রস্তাবিত পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে তার জয় হলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র, শরণার্থী ও মানবাধিকার বান্ধব দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন আসবে।

হোয়াইট হাউস জয়ের যত হিসাব-নিকাশ
যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইলেক্টোরাল কলেজের ৫৩৮ ভোট গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। দেশের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বিজয় নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে একজন প্রার্থীকে কমপক্ষে ২৭০টি ভোট পেতে হয়। পপুলার ভোটের ধারা যাই হোক ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান প্রার্থীদ্বয়ের নির্বাচনী কৌশল প্রণয়নে পূর্ণ মনোযোগ থাকে ওই ইলেক্টোরাল ভোট জয়ে।  ২০২০ সালের নির্বাচনও এর ব্যতিক্রম নয় এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস, অর্থনীতিতে সংকট, পুলিশি নিপীড়নের বিরুদ্ধে ও নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত মার্কিন রাজনীতির মানচিত্র পরিবর্তন হওয়ার মতো কোনো ঘটনা নেই। তাছাড়া ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের প্রার্থীও এমন নয় যে, তার ক্যারিশমা ভোটের অঙ্ক সমূলে পাল্টে দিতে পারে। ওই বিশ্লেষকের মতে, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে ৩০টি অঙ্গরাজ্য এবং মেইন অঙ্গরাজ্যের একটি ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছিলেন। এবার যদি সেটি ধরে রাখতে পারেন তবে তার জয় ঠেকানো অসম্ভব। কিন্তু আগের নির্বাচনে জয় পাওয়া মিশিগান (১৬), উইসকনসিন (১০) ও পেনসিলভানিয়ায় (২০) এবারে তার জয়কে অভূতপূর্ব বলেই বিবেচনা করা হয়। জনমত জরিপ ইঙ্গিত দিচ্ছে, মিশিগান ও উইসকনসিনে ট্রাম্পের বিজয়ের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সে ক্ষেত্রে ওই অঙ্গরাজ্যদ্বয় বাদ দিলে তার ভোট দাঁড়ায় ২৭৬টি। সে ক্ষেত্রেও হোয়াইট হাউস ধরে রাখতে তার সমস্যা হবে না, যদি তিনি পেনসিলভানিয়া জিততে পারেন। কারণ হিসাব বলছে, ট্রাম্প ফ্লোরিডায় জিতবেন। তার ঘাঁটি বলে পরিচিত অ্যারিজোনায়ও কোনো ধরনের বিপদ ঘটবে না। ওহাইও এবং আইওয়াতে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার ইঙ্গিত রয়েছে তবে চূড়ান্ত বিচারে ট্রাম্প জিতে যাবেন। আলী রীয়াজ মনে করেন পেনসিলভানিয়ায় হেরে গেলেও ২০১৬ সালে যে ৩টি রাজ্য- মিনেসোটা (১০), নেভাদা (৬) ও নিউ হ্যাম্পশায়ারে (৪) ট্রাম্প হেরেছিলেন অল্প ব্যবধানে, এগুলো পুনরুদ্ধার করতে পারলেও তার জয়ের পথে বাধা থাকবে না। এখন পর্যন্ত এসব অঙ্গরাজ্যে তার জয়ের সম্ভাবনা খুবই কম তথাপি যদি তিনি বিজয়ী হন, তবে অনুমান করা যায় তিনি অন্যত্র বড় ধরনের চমক দেখাবেন। বাইডেনের জয় প্রশ্নে আলী রীয়াজ লিখেন- এটা স্পষ্ট যে, মিশিগান ও উইসকনসিনকে বাদ দিয়ে বাইডেনের অগ্রসর হওয়ার পথ অত্যন্ত সীমিত, বলা যেতে পারে অসম্ভব। কেননা, এই দুই অঙ্গরাজ্য জেতার মতো সমর্থন না থাকলে অন্য অঙ্গরাজ্যে তার সমর্থন থাকবে, এমন মনে করার কারণ কম। সে ধরনের দৃশ্যপট হবে অতিমাত্রায় নাটকীয়। হিলারি ক্লিনটন যে অঙ্গরাজ্যগুলোয় জিতেছিলেন, সেই ২০টি অঙ্গরাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসিকে ধরে রেখে বাইডেনের হোয়াইট হাউস জয়ের জন্য দরকার হবে আরো ৩৮টি ভোট। সে ক্ষেত্রে তিনি যদি মিশিগান (১৬), উইসকনসিন (১০) ও পেনসিলভানিয়ায় (২০) জেতেন, তবেই তার বিজয় নিশ্চিত। আর যদি তিনি ফ্লোরিডা (২৯) জিততে পারেন তবে পেনসিলভানিয়ায় হারালেও বিজয় বাধাগ্রস্ত হবে না। তবে এখন পর্যন্ত ফ্লোরিডাতে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে জরিপগুলো। ওই বিশ্লেষকের মতে, মিশিগান (১৬), উইসকনসিন (১০) ও নর্থ ক্যারোলাইনায় (১৫) জিতেও বাইডেন জয়ী হতে পারেন। যদি ডেমোক্রেট দলের ২০১৬ সালে হিসাব ঠিক থাকে। কিন্তু মিশিগান (১৬) ও উইসকনসিনের (১০) সঙ্গে অ্যারিজোনা (১১) জয়ী হলে অর্থাৎ ২৬৯ ভোট পেলে গ্যাঁড়াকলে পড়ে যাবেন বাইডেন। সে ক্ষেত্রে তৈরি হতে পারে অচলাবস্থা। তবে সেটিও উতরানো সম্ভব যদি মেইন অঙ্গরাজ্য অর্থাৎ ওয়াশিংটন ডিসির চারটি ভোটই বাইডেন নিজের পক্ষে নিতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তার ভোট দাঁড়াবে ২৭০ এ। তবে ওই ফল টিকবে কিনা? তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মায়ামি বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড সায়েন্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দুই অধ্যাপক জোসেফ ই উসিনস্কি ও ক্যাসি ক্লফস্টাড। তারা মনে করেন- মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা যে রায়ই দিক না কেন, নির্বাচনের ফল মূল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদ্বয় শেষ পর্যন্ত মানবেন কিনা, তা এখনও বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। কারণ প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে জালিয়াতির আশঙ্কা ব্যক্ত করে এরইমধ্যে নির্বাচনের ফল মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকার ও চূড়ান্ত ফল সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জের ঘোষণা দিয়েছেন।  তার ওই মন্তব্য ভোটের মাঠে তো বটেই নির্বাচন পরবর্তী অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

মিজানুর রহমান

এমন আরো সংবাদ

একটি উত্তর দিন

দয়া করে আপনার মন্তব্য লিখুন !
দয়া করে এখানে আপনার নাম লিখুন

সর্বশেষ সংবাদ