মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ছিলেন অবিভক্ত বাংলার একজন প্রিয় নেতা। একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী নবাব একধারে ছিলেন সমাজ সেবক, শিক্ষা, সাংস্কৃতি, কৃষ্টি কালচারের পৃষ্ঠ পোষক এবং দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজনৈতিক। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন জন দরদী, কল্যানকামী, দানশীল, ন্যায়পরায়ণ জমিদার। ১৮৬৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর তিনি তার নানা নাটোরের জমিদার মুহম্মদ আলী খান চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা রাবেয়া খাতুন চৌধুরাণী ছিলেন নানার বড় মেয়ে। পিতা জনাব মোহাম্মদ আলী চৌধুরী ছিলেন টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ীর বিখ্যাত জমিদার। সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত মুসলিম পরিবারের বহুণ্ডণ সম্পন্ন এক যোগ্য সন্তান হিসাবেই তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শিক্ষা জীবনে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি শিক্ষালাভ করেন। ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষায় তার ছিল ব্যাপক বুৎপত্তি। শিক্ষা শেষে তিনি ময়মনসিংহে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন দেশের প্রকৃত অবস্থা নতুন ভাবে ভিন্ন এক আঙ্গিকে তার চোখে ধরা দেয়। মানুষের দুঃখ-দুর্দশার বাস্তব চিত্র খুব কাছ থেকে স্পষ্ট ভাবে দেখবার পর তিনি সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দেবার সিদ্ধান্ত নেন এবং রাজনীতিতে অংশ নেন।
ময়মনসিংহ পৌরসভার কমিশনার ও ময়মনসিংহ জেলা বোর্ডের সদস্য হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবনের শুরু।
পারিবারিক জীবন: নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, বণ্ডড়ার নবাব সৈয়দ আব্দুস সোবাহান চৌধুরীর বড় মেয়ে আলতাফুন্নেসা চৌধুরাণীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই ঘরে তাদের একটি পুত্র সন্তান হয়। এই সন্তানের নাম রাখেন সৈয়দ আলতাফ চৌধুরী। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেন কিশোরগঞ্জের নিকটস্থ জঙ্গলবাড়ীর জমিদার পরিবারে। এই পক্ষে তার কোন সন্তান ছিলোনা। দ্বিতীয় স্ত্রী ও অসুস্থ্য হয়ে মারা যান। দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আবার বণ্ডড়ার নবাব সৈয়দ আব্দুস সোবাহান চৌধুরীর চতুর্থ কন্যা সৈয়দা সাকিনা খাতুনকে বিয়ে করেন। এই ঘরে তার দ্বিতীয় পুত্র নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী জন্ম গ্রহণ করেন।
তার প্রথম পুত্র সৈয়দ আলতাফ চৌধুরীর পুত্র অর্থাৎ তার নাতি ছেলে মোহাম্মদ আলী চৌধুরী যুক্ত বাংলার অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন। এবং তিনি বণ্ডড়ার মোহাম্মদ আলী নামেই সু পরিচিত ছিলেন।
দ্বিতীয় পুত্র নবাবজাদা সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী ছিলেন বংগীয় আইন সভার সদস্য, ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রাদেশিক সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী, ১৯৬২-১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে শিল্পমন্ত্রী এবং দেশ স্বাধীন হয়ার পর তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। এবং সৈয়দ হাসান আলী চৌধুরী একমাত্র কন্যা এবং নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর পৌত্রী আশিকা আকবর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সাংসদ ছিলেন।
তিনি নিজে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার সদস্য হয়েছিলেন (১৯০৬-১৯১১ খ্রিঃ), বাংলা প্রেসিডেন্সি ব্যবস্থাপক সভার সদস্য ছিলেন (১৯১২-১৯১৬ খ্রিঃ), ভারতীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন (১৯১৬-১৯২০ খ্রিঃ)। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বংগীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং প্রথম রিফরমড কাউন্সিলে ১৯২১-১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বেঙ্গল এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন। তিনি তার কর্মময় জীবনে বহু সংগঠনের সাথে জ্যড়িত ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আলীগড়
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য বৃটিশ সরকার কতৃক ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘খান বাহাদুর’, ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে সি.আই.ই. ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে ‘নবাব’ উপাধি পান।
তিনি নবাব স্যার সলিমুল্লাহর রাজনৈতিক অনুসারী ছিলেন। ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহ যখন অল্প বয়সে মৃত্যুবরন করেন। তারপর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর উপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আন্দলনের মূল দায়িত্বভার এসে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তিনি তার অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, তা আমাদের ইতিহাসের পাতায় উজ্জল হয়ে আছে। এ বিষয়ে আরো অনেকেরই অবদান আছে এটিও সত্য। এখানে অবশ্যই শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের অসামান্য অবদানের কথাও কখনও ভুলবার নয়। তবে নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী এক্ষেত্রে অনেক বেশি সক্রিয় অবদান রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি আদায়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ জানুয়ারী লর্ড হার্ডিঞ্জ কতৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেবার পর থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ, পর্যন্ত যেদিন বড় লাট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক্ট পাস পাশ হবার ঘোষণা দেন, সেদিন পর্যন্ত এর পেছনে নওয়াব আলী চৌধুরী চেষ্টার কোন বিরাম ছিলনা। ছিলোনা কোন অলসতা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর কতৃক মনোনীত উচ্চ কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম শুরুর প্রথম দিকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন কৃতি ছাত্রের জন্য বৃত্তি বাবদ ১৬ হাজার টাকার একটি তহবিল বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেন। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিলে ৩৫ হাজার টাকা দান করেন। এই ভাবে যাদের বিভিন্ন মুখী অবদানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠা ও নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। তাদের মাঝে অন্যতম। খাজা মুহম্মদ আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় নওয়াব আলী চৌধুরীর অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেন- তার প্রচেষ্টা না থাকলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ত জন্মই হতোনা।
নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সাহেব বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং সাংবাদিকতারও একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি নিজেও একজন সুলেখক ছিলেন। তার লিখিত বই ণ্ডলি হলো: ভার্নাকুলার এডুকেশন ইন বেঙ্গল (১৯০০), ঈদুল-আজহা (১৯০০) ও মৌলুদ শরীফ (১৯০৩)। তা ছাড়াও বিভিন্ন ইংরেজি ও বাংলা পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে তার লিখিত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি সাপ্তাহিক মিহির ও সুধাকর পত্রিকার (১৮৯৫) সম্পাদক ও মালিক ছিলেন। ইসলাম প্রচারক (১৮৯১) এবং প্রচারক (১৮৯৯) এ পত্রিকা দুটিকে তিনি নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দান করেছেন। ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তার ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটি নওয়াব আলী চৌধুরীর নামে উৎসর্গ করেন। মহা কবি কায়কোবাদ তার ‘মহাশ্মশান’ কাব্যের ১ম খন্ড (১৯০৪ খ্রিঃ), রেয়াজ উদ্দিন আহমদ আল মাশহাদীর ‘সুরিয়া বিজয়’, কবি দাদ আলীর ‘সমাজ শিক্ষা’ (১৯১০ খ্রিঃ), নদীয়ার কবি মোজাম্মেল হকের ‘জাতীয় ফোয়ারা’ (১৯১২ খ্রিঃ) নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর নামে উৎসর্গ করেছেন। এবং নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী আইন পরিষদে সর্বদাই কৃষকের স্বার্থে কথা বলেছেন। এবং স্মরণ রাখতে হবে একই সঙ্গে তিনি কৃষির অগ্রগতির জন্য ও সার্বিক চেষ্টা করেছেন।
ঢাকাতে যেন বিশ্ববিদ্যালয় না হয় তার জন্য সেই সময় কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দুদের একটি মহল তীব্র বাধার সৃষ্টি করে। সকল বাঁধা অতিক্রম করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী।
১৯০৫ সালের ১৬ই অক্টোবর ইংরেজ সরকার ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ব বাংলা এবং আসাম নিয়ে একটি নুতন প্রদেশ সৃষ্টি করে। এই পরিবর্তনটি বঙ্গভঙ্গ নামে পরিচিতি পায়। নুতন প্রদেশ সৃষ্টির ফলে ঢাকাতে অন্যানো বিষয়ের সাথে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং একটি হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠা অবধারিত হয়ে উঠে। একই সঙ্গে বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় শিক্ষা সহ বিভিন্ন দিকে প্রভূত উন্নয়নের সম্ভাবনা দেখা দেয়। বঙ্গ বিভক্তির বিষয়টি তৎকালীন কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু সমাজের প্রভাবশালী অংশের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।
তারা কলকাতার ণ্ডরুত্বের হানি এবং এই বিভক্তির মাঝে নিজেদের স্বার্থ ক্ষুন্ন হবার আশঙ্কায় এর তীব্র বিরধিতা শুরু করেন। এর বিরুদ্ধে প্রচুর আবেদন, নিবেদন, লবিং চালিয়েও কাজ হচ্ছে না দেখেই তখন তারা সাথে জনমত সংগ্রহে জনসভা সহ পাশে ভিন্ন এক আন্দোলন গড়ে তুলেন। এক পর্যায়ে এই বিরধিতায় উগ্র সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও যুক্ত হয়ে পড়ে। আন্দলনের তীব্রতায় ১৯১১ সালের ১লা নভেম্বর দিল্লির দরবারে ঘোষণার মাধ্যমে ১২ই ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গে উন্নয়নের যে নুতন জোয়ার এসেছিল তা অচিরেই স্তিমিত হয়ে আসে। এবং ঘটনাটি একই সঙ্গে মুসলিম মনে বিক্ষোভ, জনরোষ তৈরি করে। হিন্দু চাপের মুখে ইংরেজ বঙ্গ ভঙ্গ রদ করে পুনরায় বৃহৎ বেঙ্গল কাঠামোতে ফিরে আসে। কলকাতা কেন্দ্রিক এই আন্দলনের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের প্রশাসনিক রাজধানীও কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে যায়। এটি অনেকটা ছিল তৎকালীন ইংরেজ প্রশাসনের একপ্রকার অসন্তুষ্টি প্রকাশ ও শাস্তি মূলক এক্ট। কলকাতা কেন্দ্রিক এক শ্রেণীর বাবুদের অ্যাকশন এর রি-অ্যাকশন। এইরূপ নানান ঘটনা প্রবাহের মাঝেও নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলার মুসলিম স্বার্থের পক্ষে নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন। এ বিষয়টি অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে।
নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল দার্জিলিং-এ তার ‘ইডেন ক্যাসেল’ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। ২০ এপ্রিল নিজ জমিদার বাড়ি এলাকায় তার নিজ হাতে গড়া বিখ্যাত জামে মসজিদের অভ্যন্তরে একটি কক্ষে তাকে সমাহিত করা হয়েছে।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর মৃত্যু উপলক্ষে বংগীয় ব্যবস্থাপক সভায় বেঙ্গল গভর্ণর স্ট্যানলি জ্যাকসন শোক প্রস্তাবে বলেছিলেন-“By this deth Bengal has lost True son of the Mohammadan Community, an ardent and fearless parson.”
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)