মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, কালচারের মাঝেই বিকশিত হয় একটি জাতির পরিচয়। বিশ্বের সকল জাতি রাষ্ট্রেরই আছে নিজস্ব পরিচয় তার নিজস্বতা, স্বকীয়তা। যা গড়ে উঠে নীরবে নির্ভিত্বে। লক্ষ্যে, অলক্ষ্যে। নিজস্ব গতিতে। ধর্ম ও ধর্মীয় মুল্যবোধও এই পরিচয় বিনির্মানে ণ্ডরুত্ব পূর্ন ভূমিকা রাখে। নিজস্ব কৃষ্টি কালচারের উৎস মূলে এটি এখনো একটি ভিত্তি হিসাবে কাজ করে থাকে। ৬ই মে, ২০২৩ করোনেশন অফ কিং চার্লস এর অনুষ্ঠানটি দেখলে বিষয়টি বুঝতে কিছুটা সহজ হতে পারে। (The Coronation of king charles-or Crowning of king Charles). সেক্যুলার উন্নত আধুনিক গণতান্ত্রিক দেশ হয়েও ইংল্যান্ড তার ধর্মীয় বিষয়াদি একেবারে ফেলে দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় বংশোদ্ভুত Rishi Sunak. তার বক্তব্যে বাইবেল থেকে কিছু কথা বলেছেন। শেষ জনসংখ্যা জরিপে ইংল্যান্ডে খ্রিস্টান পপুলেশন-Census 2021 will probably be remembered as the one in which Christianity became a minority religion in England and Wales. On census day, 21 March 2021, 46.2% of people identified themselves as Christians. তার পর এখনো ব্রিটেনে খ্রিস্টানরাই সবথেকে বড় ধর্মীয় গ্রূপ। ধর্মীয়মূল্যবোধের সাথে দেশের মানুষের আচার ব্যবহার, সমাজ, ধর্ম, দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রকৃতি, পরিবেশও একটি দেশের কৃষ্টি, কালচারকে প্রভাবিত করে থাকে। সমষ্টিগত ভাবে এ বিষয় ণ্ডলো দেশ ও জাতীর পরিচয় এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে এক সূত্রে সমন্বিত করে থাকে। সাধারণ ভাবে কৃষ্টি কালচারের কিছু অংশ পরিবর্তনের ধারায় যুক্ত হলেও কিছু দিক থেকে যায় পরিবর্তনের মাঝেও অপরিবর্তনিয়। সময়ের সাথে বিভিন্ন প্রকার অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিকে ধারণ, গ্রহণ ও বর্জনের ঘাতপ্রতিঘাতের মাঝেই তা প্রতিষ্ঠিত। আমাদের কৃষ্টি কালচারেরও আছে একই ইতিহাস।
আজ নিজস্ব পরিচয়, পরিচিতি নিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশিরা ছড়িয়ে আছেন। এটি এক দিকে গর্বের অপর দিকে নতুন বিস্ময়কর এক অভিজ্ঞতা। বাংলা ভাষা ভাষী বাংলাদেশী বাঙ্গালী ছাড়াও ভারতের পশ্চিম বাংলা আসাম, ত্রিপুরাতেও বাংলা ভাষী বাঙালি আছেন। রাষ্ট্রীয় পরিচয়ে তারা ভারতীয়। এই দুই রাষ্ট্রের বাংলা ভাষা ভিত্তিক নাগরিকদের মাঝে মিল ও অমিলের কিছু ণ্ডরুত্বপূর্ন দিক আছে। এ বিষয়ণ্ডলি জানা ও মানা ণ্ডরুত্ব বহন করে।
বাংলা ভাষা-ভাষী বাংলাদেশী ও ভারতীয় নাগরিকদের মত, একই ভাবে জর্ডান, সিরিয়া, লেবানন আরবী ভাষী হয়েও ভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ে, পাশাপাশি বসবাস করছেন। তেমনি অষ্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং কানাডা-আমেরিকার ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই রকম। ভাষাগত মিল এই রাষ্ট্র ণ্ডলি ও তার নাগরিকদের মাঝে যেমন একটি বিশেষ কেমিস্ট্রি সৃষ্টি করে তা যেমন বাস্তব, অন্য দিকে শুধুমাত্র এই কারনে রাষ্ট্রণ্ডলির ইতিহাস, রাজনীতি, কৃষ্টি, কালচার, সংস্কৃতির পার্থক্য ণ্ডলি মিলিয়ে, ভুলিয়ে, ঘুচিয়ে দেয়না তাও একটি সত্য। এটি বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে নিজস্ব অবস্থান গত জাতীয় পরিচয়ের বাস্তবতা। তাই ইংরেজি সাহিত্যের দিক পাল ব্রিটিশ শেক্সপিয়র আমেরিকার জাতীয় কবি হননা। আর আমেরিকানরা গাড়ি ডানদিকে চালালে ইংলিশ ড্রাইভিং চলে বামদিক থেকে। এই বাস্তবতার গভীরতা অনেক। আবেগে বা মতলবে যারা এইরূপ বাস্তবতা ভুলে থাকতে চান। তারা জাতীয় স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেন না। পার্থক্য মেনেই সম্পর্ক। জাতীয় পর্যায়কে সম্মান দেখিয়ে আন্তর্জাতিকতার শুরু। এখানেই প্রকৃত সন্মান ও মানবিক সম্পর্কের শুরু। কোন ভাবেই আলগা সংস্কৃতির স্রোত দ্বারা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, কৃষ্টি, কালচার, সংস্কৃতির পার্থক্যণ্ডলি মিলিয়ে, ণ্ডলিয়ে নিজস্বতা, স্বকীয়তার গন্ডি ভেঙে জাতীয় স্বার্থের বিপক্ষে খিচুড়ি পাকানো শুভ কিছু না। এক্ষেত্রে সীমারেখা পার করে কিছু করা নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের পক্ষে যায় না।
বিষয় ণ্ডলো পরিষ্কার ভাবে তুলে ধরতে- বুঝতে ও বোঝাতেই প্রয়োজন নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, কালচার যুক্ত বাংলাদেশী কালচারাল রেভ্যুলেশন।
বিষয়টি কোন ভাবেই কারো বিপক্ষে নয়। এটি সীমা রেখা চিহ্নিত করনের দিক কাঁটা তারের বেড়া নয়। কিছু কিছু বিষয়ে আমাদের ধারণা ণ্ডলি পরিষ্কার থাকা প্রয়োজন। যা কিনা জাতীয় ঐক্যমত সৃষ্টি করতে নিশ্চিত অবদান রাখবে। এটি সে আন্তরিক প্রচেষ্টার অংশ। তাই ছোট্ট পরিসরে সংক্ষিপ্ত ভাবে কিছু তুলে ধরা। উদ্দেশ্য প্রচলিত কিছু ভুল ধারনা খন্ডনের প্রচেষ্টা।
১। ইসলাম ও মুসলমান সম্পর্কে হিন্দু বা বিধর্মী বিদ্বেষী হবার প্রচারণাটি ভুল। মুসলমান বিশ্বাস করে প্রতিটি মানুষই আদম সন্তান। মানুষ বানর বা বেঙ থেকে উৎপন্ন হয়নি। মানব সূত্রে প্রতিটি মানুষ পরস্পর নিকট আত্বিয়। একজন মানুষ হত্যা পুরা মানবতাকে হত্যার সামিল। কিছু অজ্ঞ মুসলিম এবং অজ্ঞ মোল্লা ইসলাম ও সমগ্র মুসলমানের মুখ পত্র নয়। তাদের অনেক বক্তব্য ও প্রচারণা ইসলামের মূল বক্তব্য ও আদর্শ বিরোধী। এক সময় অজ্ঞতার কারনে কিছু মুসলিম বলতেন ইংরেজি শিক্ষা হারাম। সময়ে সবাই বুঝেছেন বক্তব্যটি সঠিক ছিল না। এইরূপ এখনও মুসলিম মাঝে অজ্ঞতা আছে। অজ্ঞ মানুষ আছেন। এ সমস্যা মিটাতে শিক্ষা ও গবেষণার বিকল্প নাই। এইরূপ অজ্ঞ মানুষের কারনে সমগ্র মুসলিম সমাজকে দোষারপ করাটাও ঠিক নয়। ২. মুসলিম বিশ্বাসে প্রতিটি মানুষের জন্ম হয় মুসলিম হিসাবে পরবর্তী তে বিভিন্ন কারনে তার অবস্থান পরিবর্তিত হয়ে থাকে। ৩. ইসলাম প্রচার করতে বলা হয়েছে। তবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে জোর করে মুসলিম করা নিষিদ্ধ। ৪. বিচারের মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ পাক। ধর্মীয় কারনে কোন মানুষ কাউকে বিচার করতে পারে না ইত্যাদি। মূল কথা ইসলাম অবিচার, অন্যায়, অনেয্য কোন বিষয় সমর্থন করে না। প্রকৃত সত্য ইসলাম আদর্শ গত ভাবে মানবতা, সত্য ও ন্যায় এর পক্ষে। অন্যায়, অবিচার অসত্যের বিপক্ষে। মুসলমান হওয়ার কারণে কারো হীনমন্যতায় ভুগবার কোন কারণ নেই। মুসলিম শাসনের পূর্বে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিম বাংলা অনেক ণ্ডলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চলে বিভক্ত ছিল। অঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র, রাঢ়, সপ্তগাঁও, ঢাকা, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা অঞ্চলকে বঙ্গ নামে অভিহিত করা হত। এছাড়াও তাম্রলিপি, সমতট, হরিকেল, মন্ডল, গৌড়, ভাওয়াল, চন্দ্র দ্বীপ এবং বরেন্দ্র ইত্যাদি নামও পাওয়া যায়।
ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী: ১২০০ সালে বিহার দখল করেন। তিনি ১২০৪ সালে গৌড় বিজয় করেন। ১৩৫২ সালে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ সমগ্র অঞ্চলকে একত্রিত করেন এবং বাঙলা নাম দেন। এটি সোনার বাংলায় পরিণত হয়। মুসলিম আমলে সাধারণ মানুষের জীবন মান উন্নত হয়।
শিক্ষা, কৃষ্টি, খাদ্যাভ্যাস পোশাক পরিচ্ছদে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মানুষের নিরাপত্তা ও জীবন মান প্রভূত উন্নত হয়। বাংলা তখন প্রকৃত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হয়। পেশা ও পেশা ভিত্তিক শিক্ষার ব্যাপক প্রসার হয়। কৃষকের কাছে কৃষিবিদ্যা, তাঁতির কাছে বুনন শিক্ষা হেকিম ও কবিরাজের নিকট চিকিৎসা বিদ্যা। ধর্মীয় শিক্ষা ছিল মসজিদ মক্তব ভিত্তিক ইত্যাদি।
যারা বাংলার মুসলিম শাসন আমলের অকারণ নিন্দা করেন তারা সত্যের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেন। এই ধরনের অপপ্রচার উদ্দেশ্য মূলক। জাতীয় বৈশিষ্ট্য ও স্বকীয়তা অনুযায়ী আমাদের কৃষ্টি, কালচার, সাহিত্য সাংস্কৃতি এগিয়ে না যাবার কারণে এই রূপ ক্ষেত্র সৃষ্টির সুযোগ হয়েছে। একই সাথে আজ সারা দেশ জুড়ে দ্রুত মূল্য বোধের অবক্ষয় ও নানা মুখী সংকট দেখা দিয়েছে। এ বিষয়টি যত দ্রুত আমরা অনুধাবন করতে পারব ততই মঙ্গল জনক। সংকট থেকে উত্তরণে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের স্বকীয়তা, নিজস্ব ঐতিহ্যের দিক ণ্ডলি তুলে ধরা সহজ হবেনা। এটি সত্য। কারন এই প্রতিষ্ঠান ণ্ডলি অতীতে এবং বর্তমানে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সহ বাইরের আগ্রাসী কুট চাল প্রতিরোধে সক্ষম হয়নি। ভারতীয় ভাব ধারার খপ্পরে থেকে সাবলীল ভাবে নিজস্বতা ধরে রাখতে পারেনি।
তাই এই সংকট থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে এবং আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা তুলে ধরতে এবং তা পুন্:প্রতিষ্ঠার জন্য একটি আন্তর্জাতিক মানের ইসলামিক কৃষ্টি-কালচার বিশ্ব-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।
এই বিশ্ববিদ্যালয় একদিকে অতীত এবং বর্তমানের মাঝে সেতু বন্ধন গড়ে তুলবে অন্য দিকে আমাদের ভবিষ্যৎ সাংস্কৃতিক বিকাশে ণ্ডরুত্ব পূর্ন অবদান রাখবে। আজ তাই প্রয়োজন বাংলাদেশী কালচারাল রেভ্যুলেশন।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
লেখক পরিচিতি: ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক