মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
“ঈদ মোবারক” বিশ্বের একশত নব্বই কোটি মুসলমানের সব থেকে বড় আনন্দ উৎসবের দিন- ঈদ। দীর্ঘ এক মাস রোজা রেখে সিয়াম সাধনার পর মুসলমানেরা সারা বিশ্বে ঈদুল ফিতরের দিনটি অত্যন্ত আনন্দ উৎসবের সাথেই উদযাপন করে থাকেন। নানা দিক দিয়ে ঈদুল ফিতরের তাৎপর্য অপরিসীম। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অর্থাৎ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের মাঝে একটি ঈদুল ফিতর, অন্যটি ঈদুল আযহা।
ইসলামী পরিভাষায় ঈদকে ইয়াওমুল জায়েজ অর্থাৎ পুরস্কার দিবস হিসেবেও বর্ণনা করা হয়ে থাকে। বিশ্ব জুড়ে ঈদ উৎসব আজ বিশ্ব কৃষ্টি- কালচারের অংশে পরিনিত হয়েছে। পবিত্র ঈদের দিনে ধর্মীয় কর্তব্য পালন সহ মুসলমানেরা দিনটি আনন্দ উৎসবের মাঝে কাটিয়ে থাকেন। এসময় ঈদ উপলক্ষে একে অপরকে, পরিচিত জনকে “ঈদ মোবারক” বলে শুভেচ্ছা জানান। এটি একটি সুপরিচিত শুভেচ্ছা বাণী। শুভেচ্ছার এ বাণীটি এখন সবার জন্য এবং সর্ব জনিন।
মুসলিমদের জন্য রমযান মাস বিশেষ ণ্ডরুত্ব বহন করে। কারণ এটি নির্ধারিত ইসলামী পাঁচ ফরজের মাঝে একটি। ফরজ রোজা এ মাসেই পালন করা হয়। ধর্মীয় নিয়ম অনুযায়ী বিশ্ব মুসলিম রোজা রাখেন। এটি ফরজ এবং ধর্মীয় অনুশাসন। আর ঈদ উৎসব ধর্মীয় আবহ যুক্ত মুসলিম আনন্দ উৎসবের দিন।
মদিনাতে মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠার সূচনা লগ্ন থেকেই মুসলিমরা ঈদ উদযাপন করে আসছেন। বিশ্বনবী হজরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬২২ খৃষ্টাব্দে পবিত্র মক্কা নগরী থেকে হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় আসেন। তৎকালে মদিনাতে শরতে ‘নওরোজ’ এবং বসন্তে ‘ মেহেরজান’ নামে দু’টো উৎসব পালিত হত। পুরাতন যুগের এ দুটি আনন্দ উৎসব মাঝে ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বাস পরিপন্থী এবং শালীনতা ও শৃঙ্খলা বোধের সাথে সামঞ্জস্যহীন কিছু বিষয় যুক্ত ছিল। বিভিন্ন ধরনের অশালীন উগ্র নগ্ন বেল্লেপনা এবং মাদক ও জুয়ার মত কিছু বিষয়ও এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। যা ছিল ইসলাম ও মুসলিম বিশ্বাস এবং শালীনতা বোধের বিপরীত মুখী কর্মকান্ড।
অতপর রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলিমদেরকে বলেন, তোমাদের খুশি প্রকাশ করার জন্য, আল্লাহ তায়ালা পুরাতন এ দু’টি দিনের পরিবর্তে আরো অধিক উত্তম এবং বরকত পূর্ন পরিশুদ্ধ, পরিমল আনন্দময় নতুন দু’টি দিন দান করেছেন। এর একটি হচ্ছে- ‘ঈদুল আজহা’ এবং অপরটি ‘ঈদুল ফিতর’। তখন থেকেই মুসলিম জীবনে ও সমাজে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী এ দু’টি ঈদ, পালিত হয়ে আসছে। এভাবেই ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা আনন্দময় উজ্জ্বল সুন্দর ও শৃঙ্খলাবোধের সম্মিলনে মুসলিম উদযাপিত উৎসব ।
মুসলিম ধর্মীয় অনুশাসনের অংশ হিসাবে পাঁচটি ফরজ সারা বিশ্বে- সর্বত্রই এক। উৎসব পালন ক্ষেত্রে কৃষ্টি-ঐতিহ্য, অঞ্চল ভেদে এবং সামর্থ অনুসারে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। তারপরও তা অবশ্যই মূল মুসলিম রীতিনীতি অনুসারেই গড়ে উঠা।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র মাহে রমজানের প্রাক্কালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এবং কুয়েতে ‘হক আল লায়লা’ নামের একটি অনুষ্ঠানের কথা বলা যায়। দীর্ঘ দিন থেকেই এ দুটি দেশে এটি প্রচলিত। যা কিনা তাদের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির অংশ হয়ে উঠেছে। এসময় ছোট ছোট শিশুরা তাদের আশেপাশের বাড়ির দরজায় কড়া নাড়তে থাকে এবং মিষ্টি এবং চকলেটের জন্য গান গায়। এর মূল উদ্দেশ্য হল রমজানের ণ্ডরুত্ব সম্পর্কে শিশু সহ সবার মাঝেই সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো কুয়েতে ও এটি পালন করা হয়। এবং তা যথারীতি উদযাপন করা হয়। এসময় শিশুরা ব্যাগে মিষ্টি সংগ্রহ করে এবং সুর করে বলতে থাকে “আতোনা আল্লাহ ইউতিকোম, বাইত মক্কা ইউদিকুম, যার অর্থ “আপনারা আমাদেরকে দিন, আল্লাহ পাক আপনাদেরকে দিবে। আল্লাহ পাক আপনাদের পুরস্কৃত করবেন এবং মক্কা পরিদর্শনের – তৌফিক দেবেন।”
এরূপ বাংলাদেশেও সেহরির আগে বিভিন্ন এলাকায়, এলাকাভিত্তিক কিছু মানুষ প্রতিবেশীদের ঘুম থেকে ওঠানোর জন্য ইসলামী গানের সাথে ডেকে থাকেন। বাংলাদেশের মত মিশর, জর্ডান ও মরক্কোতেও এই একই কাজ কিছু মানুষ করে থাকেন। রমযানের শেষ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশণ্ডলোতে ‘চাঁদ রাত’ নামে পরিচিত একটি উৎসব হয়। এই উৎসবের অংশ হিসেবে নারীরা হাতে মেহেদি লাগান।
সংযম শালীনতা শৃঙ্খলাবোধের পরিসীমায় সারা বিশ্বে ঐতিহ্যময় মুসলিম মূল্যবোধ ভিত্তিক কৃষ্টি কালচার গড়ে উঠেছে। মুসলিম কৃষ্টি কালচারের সার্বজনীন বিশ্ব দৃষ্টি ভঙ্গির গভীরতা উপলব্ধির ব্যর্থতাও কিছু আছে যা- অস্বীকার করবার নয়। এটি মূলত অজ্ঞতা, শিক্ষা ও জ্ঞানের অভাব প্রসূত। এক্ষেত্রে অনেকে অকারণ বিতর্কিত বিষয় অবতারণার সুযোগ পান। এটি দুঃখ জনক। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের ইসলামী কৃষ্টি কালচার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল লক্ষ্য হবে- কৃষ্টি কালচারে মুসলিম দৃষ্টি ভঙ্গি সঠিক ভাবে তুলে ধরা সহ বিদেশী সংস্ক্রিতিক আগ্রাসন থেকে বাংলাদেশী কৃষ্টি, কালচার, ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন এবং বাংলাদেশী মুসলিম কালচারাল ভীত পুনর্গঠন।
ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা চিরতরে বন্ধ হবে। একই সাথে পুরন হবে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রত্যাশা। শিকড় ছেড়া কালচার কখনো শক্ত ভীত গড়তে পারে না। ঈদ আনন্দে বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের সাথে বিশ্ব মুসলিম ও বিশ্ব বাসীর সুখ, শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আসুক। সবার সাথে এটাই হোক এবারের ঈদ আনন্দ প্রত্যাশা।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)