মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
স্বাধীনতার পর থেকে অনেক বাধা বিঘ্ন প্রতিকূলতার মাঝেও বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশীদের একক ও সমষ্টি গত অর্জনের বিভিন্ন দিক জাতি গত ভাবে আমাদের আশান্বিত করে, উদ্দজীবিত এবং গর্বিত করে। তেমনি একটি অর্জনের দিক প্রবাসে বাংলাদেশী। এক সময়কার ঘর কুনো, ঘরমুখি বাঙালি এখন বিশ্ব মুখী। বিশ্ব জয়ী বললেও কিন্তু খুব একটা বেশি বলা হবে না।
আজ এখানে প্রবাসী বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত সফল নারী রাজনৈতিকদের কথা তুলে ধরব। এই পর্বে মূলত থাকছে ইংল্যান্ড, আমেরিকা এবং কানাডার কথা। শুরুটা এদিক থেকেই।
বলে নেওয়া ভাল কোন অর্জনই কিন্তু কখন অনায়সেই ধরা দেয়নি।
রুশনারা আলি এমপি: যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি রুশনারা আলি। মাত্র সাত বছর বয়সে তিনি তার পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাজ্যে আসেন। তিনি লন্ডনের মালবেরি স্কুলস অব গার্লস এবং টাওয়ার হ্যামলেট কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জনস কলেজে তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন।
রাজনৈতিক গবেষক মাইকেল ইয়ংয়ের গবেষণা সহকারী হিসেবে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১০ সাল থেকে তিনি বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনের সংসদ সদস্য। এই আসনে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তায় তিনবার সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১০ সালে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হয়েই রুশনারা আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও শিক্ষাবিষয়ক ছায়ামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পার্লামেন্টারি ট্রেজারি সিলেক্ট কমিটির সদস্য ছিলেন।
কনজারভেটিভ সরকারের আমলেও তিনি বাংলাদেশ বিষয়ক বাণিজ্যদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ২০১৪ সালে লেবার পার্টি থেকে পদত্যাগ করেন। লেবার পার্টি যখন ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালাতে সম্মত হয় তখন তিনি তার প্রতিবাদে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন তিনি এ ধরনের যুদ্ধ কখনোই সমর্থন করতে পারেন না। এ সাহসি পদক্ষেপ তার জনপ্রিয়তাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। ২০০১ সালের দাঙ্গার মাঝেও তিনি স্থানীয় ও জাতীয় ইস্যুতে বিভিন্ন কর্মকান্ডের নেতৃত্ব দেন। বাংলাদেশ ইংল্যান্ড সম্পর্ক উন্নয়ন এবং বাণিজ্যিক উন্নয়নেও তিনি তার অবদান রেখে চলেছেন।
রুপা আশা হক: বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আর এক সফল নারী রাজনৈতিক। ব্রিটিশ রাজনীতির এক অনন্য নাম। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেবার পার্টির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। রুপা হক ১৯৯১ সালে বাবার অনুপ্রেরণায় লেবার পার্টির সদস্য হন। ২০১৫ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) হিসেবে নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে আরও দুবার ব্রিটিশ এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭২ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা রুপা হকের গ্রামের বাড়ি পাবনা শহরের মকছেদপুর। ১৯৬০ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো পিতা মোহাম্মদ হক এবং মাতা রওশন আরা হক দম্পতির তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় রুপা হক। ১৯৯৩ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৯৩ সালে গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। রুপা ১৯৯৯ সালে ইস্ট লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ.ডি লাভ করেন। ২০০৪-২০১৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাজ্যের কিংস্টন ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞান ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগে জ্যৈষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে পড়িয়েছেন। মিডিয়া ও কালচারাল স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষকও ছিলেন। তার আগে ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটিরও প্রভাষক ছিলেন রুপা হক।
শিক্ষক গবেষক কিংস্টন ইউনিভার্সিটির এই প্রভাষক। ২০১০ সালে লন্ডনের ইলিং কাউন্সিলের ডেপুটি মেয়র হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১৯ সালের নির্বাচনে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির জুলিয়ান গালান্টকে বিপুল ব্যবধানে হারিয়েছেন। দুবারের নির্বাচিত এমপি রুপা হক ২০১৯ সালে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বলেছিলেন, টানা তৃতীয়বারের মতো আসনটি ধরে রাখবেন ইনশা আল্লাহ। এবং তিনি তা পেরেছিলেন। স্থানীয়, জাতীয় ইস্যু ছাড়াও তিনিও বাংলাদেশ ইংল্যান্ড বন্ধুত্ব উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন।
টিউলিপ সিদ্দিক এমপি: যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে আর একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত প্রভাবশালী রাজনিতিক। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বরের যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো জয় পান টিউলিপ সিদ্দিক। হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে লেবার পার্টি থেকে ২৮ হাজার ৮০ ভোট পেয়ে তিনি জয়ী হন। লন্ডনের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আসনে টিউলিপের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ পার্টির জনি লাক পান ১৩ হাজার ৮৯২ ভোট। ২০১৫ সালে ২৩ হাজার ৯৭৭ ভোট পেয়ে হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন থেকে লেবার পার্টির হয়ে প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হন টিউলিপ। এরপর ৩৪ হাজার ৪৬৪ ভোট পেয়ে ২০১৭ সালের নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন তিনি। ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ডের ২০১৯ সালের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের তালিকায় টিউলিপ সিদ্দিক স্থান পেয়েছেন। ২০১৫ সালের মে মাসে হাউস অব কমন্সে প্রথম ভাষণেই নজর কাড়েন টিউলিপ সিদ্দিক। সম্ভাবনাময় তরুণ এই রাজনীতিকের আর একটি বড় পরিচয় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নাতি। বাংলাদেশ ব্রিটেন সম্পর্ক উন্নয়নে তিনিও কাজ করে চলেছেন।
আফসানা বেগম এমপি: টাওয়ার হ্যামলেটসে জন্ম ও বেড়ে উঠা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আফসানা বেগম। বাংলাদেশের সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর তার আদি পৈতৃক নিবাস। যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে প্রথমবারেই নিজের শক্তিশালী অবস্থানের জানান দিয়েছেন। বলা চলে প্রথমবারেই চমক দেখিয়েছেন বাংলাদেশি নুতন প্রজন্মের এই তরুণী। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনে পূর্ব লন্ডনের পপলার অ্যান্ড লাইমহাউস আসন থেকে প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। লেবার দলের আফসানা পেয়েছেন ৩৮ হাজার ৬৬০ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী শন ওক পেয়েছেন ৯ হাজার ৭৫৬ ভোট। প্রথমবারই বিপুল ব্যবধানে জয় পেলেন আফসানা।
তাঁর বিজয়ের মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল চারজন। পপলার অ্যান্ড লাইমহাউস পূর্ব লন্ডনের বাংলাদেশি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার আসন। এটি লেবার দলের নিরাপদ আসন হিসেবে পরিচিত। প্রায় দুই দশক ধরে এ আসনে এমপি ছিলেন লেবার দলের জিম ফিটজপেট্রিক। তিনি রাজনীতি থেকে অবসরের ঘোষণা দিলে অনেকটা চমক জাগিয়ে লেবার দলের মনোনয়ন কেড়ে নেন রাজনীতিতে অপেক্ষাকৃত তরুণ বাঙালি কন্যা আফসানা বেগম। তিনি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আবাসন বিভাগেও কাজ করেছেন। নতুন প্রজন্মের দারুন সম্ভাবনাময় তরুণ এই এম পি, আফসানা বেগমও দারুন উৎসাহ নিয়ে বাংলাদেশ ইংল্যান্ড বন্ধুত্ব উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন।
ডলি বেগম এমপিপি: কানাডার অন্টারিও প্রদেশের পার্লামেন্টে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এমপিপি নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছেন ডলি বেগম। তার নির্বাচিত হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত অন্যান্যদের জন্যও দেখিয়েছে নুতন আশার আলো। বিশেষ করে নুতন প্রজন্মের মাঝে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছে উৎসাহ, উদ্যম, উদ্দীপনা। কঠোর পরিশ্রম দৃঢ়চেতা ও ব্যক্তিত্ব ণ্ডণে বিদেশের মাটিতে উজ্জ্বল করেছেন বাংলাদেশি ভাবমূর্তি। ২০১৮ সালের ৭ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৪ হাজার ১৫০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন তিনি। টরন্টো ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক এবং ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে ডেভেলপমেন্ট, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও প্ল্যান্টে মাস্টার্স করেছেন ডলি। স্কারবোর হেলথ কোলিশনের কো-চেয়ার এবং ওয়ার্ডেন উডসস কমিউনিটি সেন্টারের ভাইস-চেয়ার হিসেবে কাজ করেছেন। ডোই প্রদেশের ওয়াইড হাইড্রো পাবলিক প্রচারাভিযানের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন, যারা সফলভাবে টরন্টো হাইড্রো এবং ওয়াসগা বিতরণের ব্যক্তিগতকরণ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। নির্বাচনী প্রচারণায় বলেছেন ‘আমাকে নির্বাচিত করুন, আমি আপনাদের আশাহত করব না।’ ডলির এই বিজয় কানাডায় বেড়ে ওঠা বাংলাদেশি নতুন প্রজন্মের তরুণদের প্রেরণা জোগাবে। তিনি হয়েছে প্রবাসী বাংলাদেশী কমুনিটির ঔকের প্রতীক। তিনি নিজ নির্বাচনী এলাকার সবার জন্য বিশেষ করে বাংলাদেশী কমিউনিটির বিভিন্ন ছোট বড় ণ্ডরুত্বপূর্ন বিষয় ণ্ডলি নিয়ে নিজ ক্ষমতার আওতায় এবং অনেক ক্ষেত্রে আরো এক মাইল আরো এক ধাপ এগিয়ে ছুটে চলেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসাবেই নিজ দলে ডেপুটি লিডারও হতে পেরেছেন।
শাহানা হানিফ: যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনের ডিস্ট্রিক্ট-৩৯ নির্বাচনে নারী কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন শাহানা হানিফ। তিনিই প্রথম কোন বাংলাদেশী নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে শাহানা হানিফ পান ১০ হাজার ৪৪৯ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রান্ডন ওয়েস্ট পেয়েছেন সাত হাজার ২৩৫ ভোট। এ নির্বাচনে সিটির ৫টি বরোর মধ্যে তিনটি বরো থেকে মোট ১৩ জন বাংলাদেশি-আমেরিকান বিভিন্ন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরমধ্যে ৬টি কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্ট থেকে ১১ জন, কাউন্টি বিচারক পদে একজন এবং ফিমেল ডিস্ট্রিক্ট লিডার পদে আরও একজন অংশ নেন। মঙ্গলবার প্রাইমারি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদের জন্য ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নির্বাচিত হন ।
এভাবেই বিশ্বের চারিদিকে বাংলাদেশী নারীরাও অবদান রাখছেন এবং এগিয়ে চলেছেন। উজ্জ্বল করে তুলছেন দেশের ভাবমূর্তি।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)