মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরেন্টো
বি আম্মা বেগম ১৮৫০ সালে উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদের আমরোহা গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। জন্ম কালে তার নাম রাখা হয় আবিদা বানু বেগম। পরবর্তীতে দেশের সবার কাছে বি আম্মা বেগম নামেই তিনি সু পরিচিত হয়ে উঠেন। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের এক সংগ্রামী পরিবারের বিপ্লবী মেয়ে। পিতা সহ তার পরিবারের অনেকেই ১৮৫৭ সালে দেশের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের নেতৃত্বে সংগঠিত ব্রিটিশ বিরোধী সিপাহী জনতার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তার বয়স ছিল মাত্র ৭ বছর।
এই বিপ্লব ব্যর্থ হবার ফলশ্রুতিতে যুদ্ধ ও সংগ্রাম শেষে পরিবারের অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে ইংরেজ দমন ও নিপীড়নের শিকার হন। ইংরেজ অত্যাচারের স্টীম রোলার তার ঋদয়কে ছোট বেলা থেকেই ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তুলে। জীবনের নানা মুখী ঝড় ঝঞ্ঝার মাঝে অল্প বয়সে পরিবারিক ভাবে তার আর এক সংগ্রামী বিপ্লবী আব্দুল আলী খানের সঙ্গে বিবাহ হয়। তাদের এই বৈবাহিক জীবন খুব একটা দীর্ঘ হয়নি। আব্দুল আলী খান বিবাহের কয়েক বছর পর কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। তাদের ছিল পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে।
সংসার জীবনের এইরূপ দুঃখ বেদনায় আবাদী বানু বেগম ভেঙে পড়েননি। দুনিয়ার দুঃখ বেদনা তাকে মানসিক ভাবে দমিত করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে নুতন করে সংগঠিত করেন। নিজেকে নুতন করে পরাধীনতার সৃঙ্খল ভাঙার সংগ্রামে প্রস্তুত করে তুলেন। তিনি প্রকাশ্যে দেশের লক্ষ কোটি মানুষের দুঃখ দুর্দশার জন্য সম্রাজ্যবাদী ইংরেজ ও তাদের কলোনিয়াল শাসনকেই চিহ্নিত করেন। এদেশ থেকে চিরতরে ইংরেজ বিতাড়ন এবং উৎখাতের মাঝেই দেশবাসীর সত্যিকার মুক্তি অর্জিত হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। এবং এই লক্ষ্য অর্জনকেই জীবনের ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন। চিন্তা ও বিশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দিতে সামর্থের সবটুকুই করেছেন। তিনি ছিলেন নিখাদ নিঃস্বার্থ একজন দেশ প্রেমিক।
নিজে জীবনে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগ পাননি। গৃহ শিক্ষার মাধ্যমেই তার শিক্ষা জীবন কেটেছে। কিন্তু সেই তিনি তার সব ছেলে মেয়েকেই সমস্ত বাধাবিঘ্ন পার করে স্কুলে পাঠিয়েছেন। এবং প্রয়োজনে নিজ অলংকার বিক্রি করতেও পিছপা হননি। তিনি তার সব ছেলে মেয়েকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছেন। ওই সময় কালে এটিও ছিল এক বৈপ্লবিক চিন্তা।
সমস্ত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে একজন বিধবা মা নিজ প্রচেষ্টায় সন্তানদের সরল সাদা সিধা জীবন, সাধারণ খাদ্য আর সাধারণ পোশাক পরিচ্ছদে অভ্যস্ত করে গড়ে তুলতে পারেন। পাঠাতে পারেন আলীগড় আর অঙ্ফোর্ডে। একই সাথে সত্যিকার দেশ প্রেম আর মাতৃ ভক্তির শিক্ষা। মনের মাঝে সযত্নে কি ভাবে বুনে দিতে হয় দেশ প্রেম তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ- বি আম্মা বেগম।
১৯১৭ সালে কলকাতায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের এক ঐতিহাসিক যুগ্ম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বি আম্মা বেগম বোরকা পরেই সেই সভায় উপস্থিত হন এবং এক তেজস্বী যুগান্তকারী ভাষণ রাখেন। বোরখার আড়াল থেকে ভেসে আসা ওই তেজস্বী ভাষনে উপস্থিত সবাই নুতন করে মন্ত্র মুগ্ধের মত শুনতে পান হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের কথা, খিলাফত
আর অসহযোগ আন্দোলনের কথা ঘোষণা দেন, শুধুমাত্র মানুষই নয়- এ ‘দেশের কুকুর -বিড়ালও ব্রিটিশদের দাসত্বের অধীনে থাকতে পারেনা।’ এরপর ব্রিটিশ সরকারি রেকর্ড তাঁকে ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল।
Despite her all progressive nature, Bi Amma believed in the concept of ÔpurdahÕ. She broke all shackles that were associated with veiled women. She becoming the first Muslim woman to address a political gathering .
In 1917, Abedi Bano Begum joined a demonstration that petitioned for the release of both her sons– Muhammad Ali and Shaukat Ali, who had been imprisoned for their anti-British activities. It was during this agitation that Mahatma Gandhi convened a meeting with Bi Amma and sought her assistance to solicit womenÕs support for the Indian independence movement.
রাখহরি চ্যাটার্জির লেখা ”গান্ধি এন্ড দা আলি ব্রাদার্স: বায়োগ্রাফি অব ফ্রেন্ডশিপ” বইতে তার সম্পর্কে লিখা হয়েছে ‘যদিও তিনি কোন প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি অর্জন করেননি তারপরও বলা চলে তাঁর চেয়ে বাস্তব বুদ্ধি সম্পন্ন, জ্ঞানী, ঐশ্বরিক এবং আধ্যাত্মিক কাউকে আমরা এ সময় কালে দেখিনি।’ গান্ধিজি ও তাকে সন্মান করতেন। তার মৃত্যুর পর গান্ধিজি বলেছেন, আম্মিজান- বি আম্মা বেগম বয়সে বৃদ্ধা হলেও তাঁর মধ্যে ছিল যুবদের ন্যায় অদম্য প্রাণ শক্তি।’ তিনিও বি আম্মা বেগমকে জন সভায় বক্তব্য রাখতে উৎসাহিত করতেন।
বি আম্মা বেগম উপমহাদেশের দুই সিংহ পুরুষ মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর এবং মাওলানা শওকত আলি জওহর এর মা। এই দুই ভাই ভারতীয় মুসলিম নেতা, বিপ্লবী, আন্দোলনকারী, পণ্ডিত, সাংবাদিক ও কবি। এবং দুজনই ছিলেন খিলাফত আন্দোলনের মূল নেতৃবৃন্দের অন্যতম। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মুসলিম প্রেসিডেন্টদের মধ্যে মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর ছিলেন ষষ্ঠতম। তিনি অল্প সময়ের জন্য এ পদে ছিলেন। তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং এক সময়ের প্রেসিডেন্ট।
১৯০৬ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা বৈঠকে মুহাম্মদ আলি অংশগ্রহণ করেন। ১৯১৮ সালে তিনি এই দলের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপালন করেন। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত তিনি লীগে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
১৯১৯ সালে ইংল্যান্ডে মুসলিম প্রতিনিধিদলে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেন। এ দলের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কের সুলতান ও মুসলিমদের খলিফাকে যাতে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক ক্ষমতাচ্যুত না করেন সে বিষয়ে প্রভাবিত করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে রাজি করানো। ব্রিটিশরা তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। ফলে খিলাফত কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি ভারতের মুসলিমদের ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বয়কটে নেতৃত্ব দেনা।
বি.আম্মা পুত্রবধূও কেও নিজ আদর্শে গড়ে তুলেন। মুহাম্মদ আলি জওহরের স্ত্রী আমজাদি বেগম শাশুড়ির উৎসাহে রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি লন্ডনে প্রথম গোলটেবিল সম্মেলনে আলি জওহরের পাশে ছিলেন। শাশুড়িকে অসহযোগ আন্দোলন এবং খিলাফত আন্দোলনে সাহায্য করার পাশাপাশি তিনি জিন্নাহর পরামর্শে মুসলিম লীগের প্রথম কার্যনির্বাহী কমিটিতে পঁচিশ জন সদস্যের মধ্যে একমাত্র মহিলা হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সালে লখনৌতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে আমজাদি বেগম নারীদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণে উৎসাহ দেন। মহাত্মা গান্ধি তাঁর উদ্দেশে ”আ ব্রেভ উওম্যান” শিরোনামের একটি নিবন্ধ উৎসর্গ করেছিলেন।
১৯২৪ সালের ১৩ই নভেম্বর তিনি ইন্তেকাল করেন। আজীবন সংগ্রামী বি আম্মা বেগম ছিলেন একজন আদর্শ বেটি, বেগম ও মা জননী। প্রজন্মের জন্য রেখে গেছেন এক অনুপম উদাহরণ।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)