আরিফুল হক
উত্থান, পতন, সংগ্রাম, স্বাধীনতা, একটা জাতিকে বড় হতে সাহায্য করে। আত্ম-সচেতন করে তোলে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার ৫২টা বছর পার হয়ে গেল, বড় জাতি হওয়া তো দুরের কথা, তারা কোন জাতি সে পরিচয়টা আজও নির্ণয় হলনা।
বাংলার মুসলমানদের শোষণ বঞ্চনার ভারতীয় প্রতিনিধি, রবীন্দ্র, বঙ্কিম, গান্ধী প্যাটেল, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, ণ্ডজরাল, মোদী আদানী প্রমূখ। কিন্তু এদের ণ্ডণকীর্তন অষ্টপ্রহর দেশের ভিতরে বাজছে। শিল্পী নামধারী ভারতীয় নাভি-নৃত্যপটীয়সীদের জন্য বর্ডার খুলে দেয়া আছে। তারা দলে দলে আসছে, নাচছে, তরুণ কিশোরদের নাচাচ্ছে, কোটি কোটি টাকার নজরানা নিয়ে চম্পট দিচ্ছে। দেশের দোকান বাজার ণ্ডলো দেখলে কোলকাতার বাজারের সাথে পার্থক্য বোঝা যাবেনা। ৫২ বছর আগে আমরা দেশের তৈরি টুথব্রাশ ব্যবহার করতাম, দেশের তৈরি টিউব-লাইট জ্বালাতাম, দেশের তৈরি ফ্যানে হাওয়া খেতাম। সেণ্ডলো সব উবে গেছে। দেশের শিল্প-কারখানা যা ছিল সবই প্রায় নির্মূল হয়ে গেছে।
দেশটার যা কিছু অর্জন ছিল, ৫২ বছর ধরে সবই প্রায় ভারতের পায়ে অঞ্জলি দিয়েছে এ জাতি। লাভের পাট- ব্যবসা ভারতকে ছেড়ে দিয়েছে। পানির হিস্যা ভারতকে ছেড়ে দিয়েছে। দেশের ভেতর দিয়ে ওদের ইচ্ছেমত যাতায়াতের রাস্তাঘাট ছেড়ে দিয়েছে। নদীবন্দর ব্যবহারের অধিকার দিয়েছে। বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার দিয়েছে। দেশে গ্যাস বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব দিয়েছে। আমাদের সমুদ্র তদারকির ভার ভারতের হাতে তুলে দিয়ে দিয়েছে। খবরে দেখলাম বাংলাদেশ তার নিজস্ব সমুদ্র এলাকায় সম্পদ খোঁজ করার চেষ্টা করলে, ভারত বাধা দিচ্ছে। এদিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন ভারতকে যা দিয়েছি ভারত তা চিরকাল মনে রাখবে। দেশটা কি প্রধানমন্ত্রীর পৈত্রিক সম্পত্তি, যে তিনি নিজ ইচ্ছায় দেশের যা কিছু দিয়ে দিতে পারেন যা দেশের মানুষের জানারও অধিকার নেই? তাহলে তো শঙ্কা হয় দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব শব্দটা টিকে আছে তো?
দেশের এ হেন পরিস্থিতির মধ্যে একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া তারস্বরে চিৎকার করছে_ আমাদের মুসলমানিত্বসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা জয় করে বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
এই বাঙালিত্ব প্রতিষ্ঠার অর্থ জানতে কি বেশি লেখাপড়ার হয়? না, হয়না সামান্য বুদ্ধি থাকলেই চলে। কেউ মুখ খুলে বলছেনা, ওরে মূর্খ – মুসলমানিত্বসৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা যে তোর বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডটা নিজেই। মুসলমানি-ত্ব নামের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হলে তো বর্ডার তুলে দিয়ে দেশটাকে একাকার করে দিতে হবে। যার ফলে তোদের মত বোকাদের সাজানো খেলাঘরই তো ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
মুসলমানিত্বের বর্ডার আছে বলেই চুপ্পু ণ্ডপ্পু প্রেসিডেন্ট হয়, তামিনা জরিনা প্রধানমন্ত্রী হয়, কাগা বগা মন্ত্রী হয়, চা- ছপ মার্কা ভাইসচ্যান্সালার হয়, একই পদের ব্যাংকার, ব্যবসায়ী বনে যায়। বর্ডার না থাকলে তো এসব যোগ্যতা নিয়ে জুতাপালিশ, নয়ত কাটাকাপড় ব্যবসা ছাড়া ভাগ্যে অন্যকিছু জুটতো কি? আজকের গাড়িহাঁকানো, ছড়িঘোরানো সবই তো এই বর্ডারের কৃপায়। এই সামান্যবুদ্ধিটুকু খুইয়ে বসে আছো?
বাংলাদেশের বোকাবাস্ক টেলিভিশনণ্ডলো তাদের মগজধোলাই মেশিনে, দিনে রাতে একই গান বাজাচ্ছে, সেটা হল- ওরা বাঙালী আমরা বাঙালী। ওদের ভাষা বাংলা আমাদের ভাষা বাংলা। ওদের সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতি ও এক।
সুতরাং বর্ডারের চেকপোস্ট ছাড়া আমাদের কোন বিভেদ নেই। বাঙ্গালী সুক্তো খেতে, পূজোউপাচার সাজাতে, সিঁদুর পরতে, শাঁখবাজাতে, সন্ধ্যাপ্রদীপ, মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালাতে ভুলে যাচ্ছে বলে গানে কবিতায় সে কি আকুলতা! ওরা মানুষকে বুঝায়, ভাষা এক হলে নাকি জাতিসত্ত্বা আলাদা থাকতে পারেনা।
ওদের কে বোঝাবে যে ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড -আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড, একই ইংরেজি ভাষার দেশ হয়ে আলাদা আলাদা দেশ আছে কি করে! সৌদি আরব, মিশর, কুয়েত, কাতার আরবি ভাষাভাষীর দেশ হলেও মিলেমিশে একহয়ে যাচ্ছেনা কেন! বিশাল কানাডা দুই ভাষা নিয়ে একদেশ, একজাতি হয়ে বাস করছে কি করে!
মানুষের বুদ্ধির গোড়ায় ধূয়া দিয়ে অন্ধকার করার জন্য ভারতের খরিদা এদেশীয় দাসরা ভারতের শেখান আরেকটি বানী খুব জোরেশোরে উচ্চারণ করেন। সেটা হল- ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়েছিল বলেই নাকি পাকিস্তান টেকেনি।
তাহলে ভারত টিকে আছে কি করে? উত্তর ভারতের উত্তর ভারতের ব্রাক্ষণদের সাথে, পশ্চিম ভারতের মারাঠারা টিকে আছে কি করে? ভারতের দ্রাবিড়দের সাথে বাঙ্গালার মছলীখোর বাঙালীরা একই রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে বাস করছে কি করে। তাদের মধ্যে হিন্দু ধর্মীয় বন্ধন ছাড়া, খাবার দাবার, আচার ব্যবহার, পোষাক সংস্কৃতির কিছুরই তো মিল নেই। একমাত্র হিন্দু ধর্মিয় বন্ধনই তো ভারতকে অখন্ড-ভারত করে রেখেছে।
সেখানে কেউ তাদের বর্ণবাদীও বলেনা সাম্প্রদায়িকও বলেনা। বরং তারা এক হয়ে উগ্র হিন্দুত্ত্ববাদী দল বাজপা এর হাতে ভারতের শাসনভার তুলে দিয়েছে। ণ্ডজরাটের কসাই নামে পরিচিত মোদী কে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। ভারতে বসবাসকারী ১৮ কোটি মুসলমান, সেখানে কসাইয়ের খামারে বাঁধা গরু ছাগলের মত বাস করছে। কখন কার গর্দান যাবে কেউ জানেনা।
এই ভারত প্রেমী বাঙ্গালীরা একবারও ভেবে দেখছেনা যে, ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা হয়েছিল বলেই জঁৎধষ ংষঁস নামের ব্রিটিশদের অবহেলিত পূর্ববাংলার ৫৫হাজার বর্গ মাইলের নাঙ্গা ভুখা হাড় জিড়জিড়ে সেদিনের ৪ কোটি মুসলমানের মৃতদেহে প্রাণ ফিরে এসেছিল। লাঙ্গলের পেছনের মানুষ আখ্যায়িত মানুষণ্ডলো রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে পেরেছিল। ২০০শ বছর পর জেলা শহর ঢাকা, রাজধানীর মর্যাদা পেয়ে ঝলমল করে উঠেছিল। দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত শিল্পকারখানায় ভরে উঠেছিল। ঢাকা কে কেন্দ্র করে শিল্প সাহিত্য অঙ্গনে অচ্ছুৎ মুসলমান ছেলেমেয়েদের দৃপ্ত পদচারনা শুরু হয়েছিল।
Physically Unfit নামের কলঙ্ক ঘুচিয়ে বাংলাভাষী ছেয়েমেয়েরা দেশের স্থল, বিমান, নৌবাহিনীতে প্রবেশাধিকার পেয়েছিল। কোটা সিস্টেমের সুযোগ পেয়ে বাংলাভাষী মুসলমানের ছেলেরা সচিব, উপসচিব, পুলিশ সার্ভিস, ফরেন সার্ভিসে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিল।
নৌকরের জাত নামে চির ভাগ্যবিড়ম্বিত পূর্ব বাংলার মানুষ একাধিক জুটমিলের মালিক হতে পেরেছিল। এসবই ছিল ১৯৪৭এর দান।
সেই দানকে আজ অস্বীকার করা হচ্ছে কেন? ১৯৪৭ সালে যারা পাকিস্তানে যোগ দেবার জন্য আইন সভায় ভোট দিয়ে পাকিস্তান ছিনিয়ে এনেছিল, পরবশ্যরা পরোক্ষভাবে সেই সংগ্রামী পূর্বপুরুষদের দেশদ্রোহী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হচ্ছে কেন জানতে হবে।
নিজেরা তুর্কি বা ফারসী ভাষী হয়েও আমাদের পূর্বপুরুষ, যারা পতিত বাংলাভাষাকে জাতে তুলেছিলেন। যারা জীবন বাজী রেখে এদেশের মানুষকে বর্গী-মারাঠা দস্যুদের খুন লুণ্ঠন থেকে বাঁচাতে সংগ্রাম করেছিলেন। যারা নিজেদের জমিদারি বন্ধক রেখে এদেশের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে দিয়েছিলেন_তারা হয়ে গেলেন বহিরাগত, উৎপীড়ক। আর যে শিবাজী ভাস্করপন্ডিতের দল এদেশকে লুণ্ঠন করলো, এদেশের হাড় জিড়জিড়ে মানুষের উৎপাদিত কাঁচামালের পয়সায় কলকাতার সমৃদ্ধি ঘটালো, যে রবিঠাকুর এদেশের গরীব চাষীদের দমন পীড়নের পয়সায় বোলপুরে শান্তিনিকেতন গড়লেন। যে বাঙালী বাবুরা রাতারাতি বড়লোক হয়ে এদেশের মানুষকে বাড়ীর ভিতরে ঢুকতে দিতনা, এক আসনে বসতে দিতনা, তারা হয়ে গেলেন পরমপূজ্য আপন জন। আজকের প্যান্ট শার্ট পরা মুসলমান বুদ্ধিজীবীরা তাদেরই নান্দীপাঠ করছেন। কেন?
এর রহস্য অনুধাবন করতে হবে। বুঝতে হবে, এভাবেই শিক্ষায় সংস্কৃতিতে, মিডিয়া প্রচারে, চালচলনে, বিগত ৫২ বছর ধরে ওরা আমার আমিত্বকে ভুলিয়ে দিয়েছে। আমরা মুসলমানিত্ব ছেড়ে বাঙ্গালী হয়েছি। আমরা এক আল্লার উপর আস্থা ছেড়ে ওদের মত অগ্নিপূজক
শিখাঅনির্বানের উপর আস্থা রাখছি। আমরা ছেলেমেয়েদের নাম রাখছি ওদের মত। ভাষা বলছি ওদের মত। পোষাক নকল করছি ওদের মত। অনুষ্ঠান পালা পার্বণ পালন করছি ওদের মত। সংস্কৃতি পালন করছি ওদের মত। রাজনীতি করছি ওদের মত। দেশ চালাচ্ছি ওদের নির্দেশ মত।
এভাবে বাংলাদেশের মানুষের চৈতন্য, বুদ্ধি, আবেগ, চিন্তাশক্তিকে ভোঁতা করে রোবটের মত ভারতীয় আজ্ঞাদাসে পরিণত করা হয়েছে। ওরা যা বলছে বাংলাদেশ মানুষ তাই করছে।
নেতারা গলা ফাটিয়ে বলছে – আমরা এগিয়ে চলেছি। কিন্তু কোন দিকে? তিন দিকই বন্ধ। একমাত্র দখিনা দুয়ার খোলা! তবে কি সাগরে!
লেখক: বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও বহু গ্রন্থের লেখক