লিখেছেন মাহবুব মাসুম
গত বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে ইউক্রেনে শুরু হয় রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান। সামরিক অভিযান শুরুর সময় মনে হয়েছিল, রাশিয়ার সামরিক সক্ষমতা আর কৌশলগত দক্ষতার কাছে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, ইউক্রেনে প্রতিষ্ঠিত হবে রাশিয়ার আধিপত্য। কিন্তু, এক বছর পরেও ইউক্রেনে রাশিয়া কাঙ্ক্ষিত সামরিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি, কিয়েভে এখনও রয়েছে জেলনস্কির নেতৃত্বাধীন সরকার। রাশিয়ার আক্রমণের মুখেও ইউক্রেনের স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখার সুযোগ হয়েছে ইউক্রেনের প্রতি পাশ্চাত্যের নিরঙ্কুশ সমর্থনের কল্যাণে।
যুদ্ধের এক বছর পূর্তির সপ্তাহখানেক আগেই কিয়েভ সফর করেছেন জো বাইডেন, নিশ্চিত করেছেন আগামী দিনগুলোতেও ইউক্রেনের প্রতিরক্ষায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখার কথা। যুদ্ধের এক বছর পূর্তির দিনে ইউরোপীয় মিত্রদের কাছ থেকে পেয়েছে বহুল কাঙ্ক্ষিত লেপার্ড টু ট্যাংকের চালান, পাশ্চাত্যের দেশগুলোও আগামী দিনগুলোতে ইউক্রেনকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে।
ইউক্রেন কেন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ?
ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর প্রেক্ষাপটই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্বগুলো পরিষ্কার করে দেয়। রঙিন বিপ্লবের প্রভাব গত এক দশক ধরেই ইউক্রেনে পরিষ্কার, ইউক্রেনের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি চাচ্ছে ইউরোপীয় সংস্কৃতি আর মূল্যবোধের অংশ হতে। ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হয়ে উঠেছে গণতন্ত্র আর মুক্তবাজার অর্থনীতি। এই মূল্যবোধগুলোকে কেন্দ্র করেই ইউক্রেন ন্যাটো আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হতে চেয়েছে। আবার, রাশিয়ান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের এই স্তম্ভগুলোকে ধারণ করেই যুদ্ধ করছে ইউক্রেনীয়রা, ইউক্রেনের যোদ্ধারা চায় না ইউক্রেনে রাশিয়ার মতো কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠিত হোক।
ইউক্রেনীয় নাগরিকদের মধ্যেই এই আদর্শিক অবস্থান ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাচারাল অ্যালাই’ হিসেবে পরিণত করেছে, রাজনৈতিক স্বার্থ আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইউক্রেন হয়ে উঠেছে নির্ভরযোগ্য মিত্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সেক্রেটারি মার্শাল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হেনরি এস. ট্রুম্যানকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক না গড়তে। হেনরি এস. ট্রুম্যান তখন মার্শালের পরামর্শকে উপেক্ষা করে যে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, পর্যায়ক্রমে সেটি স্থায়ী মিত্রতায় রূপ নেয়। ট্রুম্যানের এই পদক্ষেপের পেছনে আমেরিকান জনগণের জনমতের চাপ ছিল, চাপ ছিল আমেরিকার মতো মোড়লদেরও। পরবর্তী দশকগুলো ইসরায়েল নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে, পেয়েছে বিপুল প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। যুক্তরাষ্ট্রের করদাতাদের অর্থেই আধুনিক হয়েছে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
বর্তমানে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের মুখে একই রকমের সমর্থন পাচ্ছে ইউক্রেন। ইউক্রেনে সামরিক সহযোগিতার পক্ষে জনমত রয়েছে বেশিরভাগ আমেরিকান নাগরিকের, বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী গ্রুপও সমর্থন দিচ্ছে ইউক্রেনের প্রতিরোধ যুদ্ধকে। ফলে, প্রেসিডেন্ট বাইডেনের জন্য ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া একটি বাধ্যবাধকতার পর্যায়ে পৌঁছেছে, বাইডেনের কিয়েভ সফরও হয়েছে জনমতকে সামনে রেখেই। ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতার ব্যাপারে বাই-পার্টিজান ঐক্যমত্য দেখা গেছে, আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের অব্যবস্থাপনা থেকে নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে সহযোগিতা করেছে ইউক্রেন যুদ্ধ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত প্রতিরক্ষা খাত, গ্রেট ডিপ্রেশন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বেরিয়ে আসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলো অস্ত্রশিল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সেই অভিজ্ঞতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আর বেরিয়ে আসতে পারেনি, অস্ত্র আর যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। অর্থনীতিকে সচল রাখতে প্রতিরক্ষা শিল্পে নতুন নতুন ক্রয়াদেশের প্রয়োজন হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্র একদিকে যেমন প্রতিরক্ষা শিল্পকে সচল রাখতে পারছে, অন্যদিকে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রদর্শনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। যুদ্ধের ফলাফলের উপরই নির্ভর করে, অস্ত্রের ক্রেতা দেশগুলো কোন দেশ থেকে অস্ত্রের ক্রয়াদেশ দেবে নিজেদের করদাতাতের অর্থ নিয়ে।
বর্তমানে আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে বৈশ্বিক আধিপত্যবাদের প্রতিযোগিতা। অন্তত, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিনির্ধারকরা সেভাবেই ভাবছেন, প্রবেশ করেছেন আধিপত্য বিস্তারের এক নতুন প্রতিযোগিতায়। তাদের দৃষ্টিতে, আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, তারপরের প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া। চীনকে মোকাবেলার জন্য ইন্দো-প্যাসিফিকি স্ট্র্যাটিজি নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়াকে মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত উপলক্ষ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে একদিকে যেমন রাশিয়ার অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্বল হচ্ছে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার প্রভাববলয়।
‘নতুন ইসরায়েল’
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থে, গড়ে তোলা হয়েছে যেকোনো আরব বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সক্ষমতা নিয়ে। পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশগুলোও একইভাবে সমর্থন জুগিয়ে গেছে ইসরায়েলকে, বর্তমানের পশ্চিমা সরকারগুলোতে ইসরায়েলের সমর্থক আছেন। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে মানুষ যত ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের বৈষম্যমূলক আচরণ দেখেছে, ইহুদিদের নিপীড়ন দেখেছে, ইসরায়েলের প্রতি মানুষের সমর্থন ততই কমেছে। মানুষের সমর্থনের শূন্যস্থান বর্তমানে পূরণ করছে ইউক্রেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান।
মধ্যপ্রাচ্যে অনেক নির্ভরযোগ্য মিত্র থাকার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় ইসরায়েলকে প্রয়োজন হয়েছিল। পূর্ব ইউরোপেও ক্ষেত্রেও, যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশ্বাসযোগ্য মিত্র থাকার পরেও, যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ তৈরি করছে, যেখানের নীতিনির্ধারণী পরিসরে হস্তক্ষেপের সরাসরি সুযোগ থাকবে। যেকোনো যুদ্ধের প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র নিজস্ব পরিসরে ইউক্রেনের মধ্যে প্রভাব রাখতে চাইবে, যুক্তরাষ্ট্রের বিবেচনায় থাকবে ইউক্রেনের মাধ্যমে ক্রিমিয়া পুনরায় দখল করার লক্ষ্যও। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দর ইউক্রেন দখল করতে পারলে, ভূরাজনৈতিকভাবে রাশিয়াকে আরো কোণঠাসা অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যাবে।
ইউক্রেন সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন ইসরায়েল হয়ে উঠছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ইহুদি বলে নয়, ইউক্রেনের মানুষের মূল্যবোধের জন্য, ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য।