মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো
পাক-ভারত-বাংলাদেশ উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসন আমলে সম্ভ্রান্ত উচ্চ শিক্ষিত, আধুনিক চিন্তা মনষ্ক, কৃষ্টিবান, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সমৃদ্ধ মুসলিম পরিবারে বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী, ২২ জুলাই ১৯১৫ সালে কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা স্যার হাসান সোহ্রাওয়ার্দী ১৭ই নভেম্বর ১৮৮৪ সালে ঢাকায় জন্ম গ্রহণ করেন। এ উপমহাদেশে সোহরাওয়ার্দী পরিবারের আছে ৯০০শত বছরের লিখিত পারিবারিক ইতিহাস। তারা মূলত ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবুবক্কর (রাঃ) পরিবার ভুক্ত। আরব থেকে ইরান হয়ে উপ মহাদেশে বিশেষত পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর জেলা অঞ্চলে বসতি করেছেন।
বাবা স্যার হাসান সোহ্রাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ভাইস চ্যান্সেলর।
Vice-Chancellor of Calcutta University. Sir Hassan Suhrawardy.
In office – 8 August 1930 – 7 August 1934. Preceded by W. S. Urquhart – Succeeded by Syama Prasad Mukherjee.
অপর দিকে মা সাহেবজাদী শাহ বানু বেগম ছিলেন বাংলায় মুসলমানদের জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ- ১৮৬৩ সালে কলকাতায় মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটির প্রতিষ্ঠা ফরিদপুরের নবাব আব্দুল লতিফের নাতনি। নবাব আব্দুল লতিফ ১৮৫৭ সালে সম্রাট বাহাদুর শার নেতৃত্বে সিপাহী জনতার প্রথম স্বাধীনতার মহাবিদ্রোহের পর নুতন করে ইংরেজদের দমন পীড়নের মুখে বাংলায় মুসলমানদের স্বার্থ সুরক্ষা এবং শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে আসতে সর্ব প্রকার উৎসাহ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। তিনি কলকাতা, ঢাকা, রাজশাহী চট্টগ্রাম অঞ্চলের মাদ্রাসা ছাত্রদের মহা বিদ্রোহের সঙ্গে ব্যাপক সংপৃক্ততার সূত্র ধরে কলকাতা মাদ্রাসা বন্দ করে দেবার ইংরেজ সিদ্ধান্ত প্রচুর দেন দরবার করে ঠেকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি উত্তর প্রদেশের স্যার সৈয়দ আহম্মদের মতই ছিলেন বাংলার প্রিয় নওয়াব আবদুল লতিফ। (১৮২৮-১৮৯৩) উনিশ শতকের বাংলার মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত ও সমাজসেবক।
বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী, ২২ জুলাই ১৯১৫ সালে কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার একমাত্র সহদর ভাই ছিলেন হাসান মাসুদ সোহরাওয়ার্দী। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং ব্রিটিশ আমলে যুক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ছিলেন তার আপন কাজিন।
তিনি পড়াশোনা করেছেন কলকাতার লরেটো কলেজে। তখন বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী মুসলিম মহিলা ছাত্র ফেডারেশন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম মহিলা উপ-কমিটির নেত্রী ছিলেন। পাকিস্তান আন্দলনের তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। কলকাতায় পড়াশুনা শেষ করে তিনি উচ্চ শিক্ষা লাভে ইংল্যান্ড যান এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি হন পিএইচডি অর্জনকারী প্রথম মুসলিম মহিলা।
তিনি ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৩ সালে করাচিতে কূটনীতিক মোহাম্মদ ইকরামুল্লার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
পরবর্তীতে মোহাম্মদ ইকরামুল্লা পাকিস্তানের প্রথম ফরেন সেক্রেটারি হয়েছিলেন। অপর দিকে বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামউল্লাহ ১৯৪৬ সালে ভারতের গনপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের প্রতিনিধি হয়েছিলেন। ওই গণপরিষদে মাত্র দুজন মহিলা প্রতিনিধির মাঝে
তিনি ছিলেন একজন। পরবর্তীতে তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিও হয়েছিলেন। বিশ্ব মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র রচনায় এবং গণহত্যা-বিরোধী কনভেনশনে তিনি ণ্ডরুত্ব পূর্ণ অবদান রেখেছেন। যা আজও স্বীকৃত। তিনি ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত মরক্কোতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
তিনি তেহজিব-ই-নিশান এবং ইসমত নামে দুটি উর্দু পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। পরে ইংরেজি সংবাদপত্রের জন্যও লিখতেন। ১৯৫০ সালে তাঁর কোশিশ- নামে একটি ছোটগল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৫১ সালে তাঁর লেটার্স টু নীনা বইটি প্রকাশিত হয়েছিল । পারিবারিক জীবনে মোহাম্মদ ইকরামুল্লাহ ও তিনি চার জন সন্তানের পিত মাতা হন। তাদের নাম – মোহাম্মদ ইনাম ইকরামুল্লাহ, মোহাম্মদ নাজ ইকরামুল্লাহ, সালমা ইকরামউল্লাহ ও ছোট মেয়ে সারভাত ইকরামুল্লাহ।
বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দীর বাংলা, উর্দু, ফার্সি এবং ইংরেজিতে পান্ডিত্য ছিল। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন অমায়িক – বন্ধু প্রিয়। অবসরে প্রচুর পড়াশুনা ও লিখা লিখি করতেন। বাংলা, উর্দু গজল ও পশ্চিমা সংগীত শুনতেন। পছন্দ করতেন।
বেগম শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী জীবনের একটি চমৎকার ঘটনা এখানে উল্লেখ করতেই হয়। তার ছোট মেয়ে সারভাত এর বিয়ে হয়েছিল জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্স হাসান বিন তালালের সাথে। সে সময় ক্ষমতায় ছিলেন হাসানের বড় ভাই, বাদশাহ হুসেইন বিন তালাল। হুসেইনের মৃত্যু হলে হাসানেরই রাজা হওয়ার কথা ছিল। কারন তিনিই ছিলেন জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্স। পরবর্তীতে তিনি- সারওয়াত বা প্রিন্সেস সারভাত নামেই পরিচিতি লাভ করেন। সারওয়াত এর জন্মও হয় কলকাতায়। তার বাবা ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্র সচিব, আর মা ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম দুই নারী এমপির একজন। এবং মরোক্কতে পাকিস্তানের এক কালীন রাষ্ট্র দূত। ২০০২ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার থেকে নিশান-ই-ইমতিয়াজ সম্মাননা লাভ করেন।
তার কিন্তু বলবার মত আরও দুটি পরিচয় আছে। তিনি হচ্ছেন পাকিস্তানের এককালের প্রধানমন্ত্রী, এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর ভাগ্নি। তার মা ছিলেন হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর মামাতো বোন। একইসাথে তিনি বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের শ্যালিকা। আর এই সারভাতেরই হওয়ার কথা ছিল জর্ডানের রানি!
নিয়ম অনুযায়ী অবশ্য ক্রাউন প্রিন্স হবার কথা ছিল হুসেইনের বড় ছেলে আব্দুল্লাহর। কিন্তু আব্দুল্লাহর মা, রানি মুনা ছিলেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত। সে হিসেবে আব্দুল্লাহ ছিলেন হাফ ব্রিটিশ। বাদশাহ হুসেইনের বিরুদ্ধে তখন চলছিল নানান ধরনের ষড়যন্ত্র। তাই বিতর্ক এড়ানোর জন্য এবং পুত্রের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই তিনি বড় ছেলে আব্দুল্লাহর পরিবর্তে ভাই হাসানকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনীত করেন। আজ জর্দানের বাদশা ঘুরে ফিরে সেই বড় ছেলে আব্দুল্লাই।
১৯৬৮ সালে বাদশা হোসেনের ভাই ক্রাউন প্রিন্স হাসান বিয়ে করেন সারভাত একরামউল্লাহকে। ফলে বাঙালি নারী সারভাত হয়ে যান জর্ডানের ক্রাউন প্রিন্সেস এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ রানি। তৎকালীন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ আলোচিত এই বিয়েটি হয় করাচিতে। বর পক্ষের সাক্ষী উকিল ছিলেন জর্দানের বাদশা হোসেন। এবং কনে পক্ষের সাক্ষী উকিল ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান। সালটি ছিল ১৯৬৮। পরবর্তী ৩০ বছর তিনি এই পদে বহাল থাকেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে মৃত্যুর মাত্র দুই সপ্তাহ আগে হাসপাতালের বিছানায় শোয়া বাদশাহ হুসেইন হঠাৎ তার ভাইয়ের মনোনয়ন বাতিল করে নিজের বড় ছেলে আব্দুল্লাহকে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে মনোনীত করেন। এভাবেই এক বাঙালি মেয়ের নিশ্চিত জর্দানের রানী হওয়াটি ঘুরে যায়। আর সারভাতের স্বপ্নটি হয়ে যায় চুরমার।
মাহবুবুর রব চৌধুরী, টরন্টো।
(লেখক পরিচিতি : ইতিহাস গবেষক, রাজনীতি বিশ্লেষক)